সুদবিহীন বিনিয়োগে আকৃষ্ট করে ১৭ হাজার কোটি টাকা লোপাট
2021.09.10
ঢাকা
মক্কা থেকে ইসলামী চিন্তাবিদ ভাড়া করে এনে ‘শরিয়ত সম্মত সুদবিহীন’ বিনিয়োগে লাখো মুসলিমকে আকৃষ্ট করে প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছেন এহসান গ্রুপের প্রধান এবং তার এক সহযোগী।
র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ান—র্যাবের মুখপাত্র খন্দকার আল মঈন শুক্রবার বেনারকে জানান, গত বৃহস্পতিবার ঢাকার তোপখানা রোড এলাকা থেকে এহসান গ্রুপের প্রধান রাগীব আহসান (৪১) ও তার সহযোগী মো. আবুল বাশার খানকে (৩৭) আটক করা হয়।
এ ছাড়া বৃহস্পতিবার পিরোজপুর থেকে রাগীবের দুই ভাই মাহমুদুল হাসান ও খায়রুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। ওই দিন রাতে রাগীব ও তার চার ভাইকে আসামি করে সদর থানায় মামলা করেন পিরোজপুর সদর উপজেলার মূলগ্রাম গ্রামের বাসিন্দা হারন অর রশিদ।
আল মঈন জানান, ইসলামী অনুভূতিকে অপব্যবহার করে রিয়েল এস্টেটসহ বিভিন্ন ধরনের ১৭টি প্রতিষ্ঠানের মালিক হয়েছেন পিরোজপুর জেলার এই রাগীব। তার প্রতারণার শিকার হয়ে প্রায় লক্ষাধিক পরিবার পথে বসেছে। মূলত নিষিদ্ধ মাল্টি লেভেল মার্কেটিংয়ের (এমএলএম) মাধ্যমে সাধারণ মানুষদের প্রতারণা করতেন ওই ব্যক্তি, জীবনের শুরুতে মাত্র ৯০০ টাকা মাসিক বেতনে একটি এমএলএম প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন তিনি।
এহসান গ্রুপের মূল প্রতারণা শুরু হয় রাগীবের নিজ জেলা পিরোজপুর থেকে। শুধু পিরোজপুর নয়, গোপালগঞ্জ, বাগেরহাট, ঢাকা, নারায়নগঞ্জ, সিলেট, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মাল্টি লেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) ব্যবসার প্রসার ঘটিয়ে প্রতারণার মাধ্যমে টাকা হাতিয়ে নেন রাগীব।
কীভাবে প্রতারণা?
রাগীবের প্রতারণার শিকার পিরোজপুর জেলা সদরের এক হাজার ২০০ মানুষের সংগঠনের কর্মীরা। ওই সংগঠনের সাবেক সভাপতি এখলাসুর রহমান শুক্রবার বেনারকে বলেন, “রাগীব তার প্রতারণার জন্য ধর্মকে ব্যবহার করেছে।”
এখলাসুর রহমান পিরোজপুরের দূর্গাপুর চুঙ্গাপাশা আলিয়া মাদ্রাসার অধ্যক্ষ। তিনি বলেন, রাগীব তার প্রতিষ্ঠানের প্রচারণার জন্য ভারত ও মক্কা থেকে ইসলামী চিন্তাবিদ এনে পিরোজপুরে ওয়াজ-মাহফিল করেছে। হেফাজতে ইসলামের প্রধান আহমেদ শফীকে পিরোজপুরে এনে ওয়াজ মাহফিল করেছে।
এখলাসুর বলেন, “এই সকল মাহফিলে ওনারা বলতেন, ইসলামে সুদ হারাম। সুদবিহীন ব্যবসা করতে হবে। আমরা সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে সহজ-সরল মহিলারা ওনাদের কথা শুনে আমাদের সকল সঞ্চয় রাগীবের প্রতিষ্ঠানে দিয়েছেন।”
তিনি বলেন, “১০ বছর আগে আমার এক ছাত্র রাগীবের প্রতিষ্ঠানের কর্মী ছিল। সে আমাকে সুদবিহীন ব্যবসার কথা বলে উচ্চহারে লভ্যাংশ দেয়ার প্রস্তাব দেয়। আমি তার কথায় আকৃষ্ট হয়ে ইসলামের কথা চিন্তা করে ১০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করি।”
এই ভুক্তভোগী জানান, প্রস্তাবে বলা হয় জমা দেওয়া টাকার শতকরা ৬৫ ভাগ লভ্যাংশ আমানতকারীদের দেয়া হবে এবং বাকি ৩৫ ভাগ অফিস পরিচালনার জন্য তারা নেবে।
এখলাসুর রহমান বলেন, “আমাকে এক লাখ টাকার বিপরীতে প্রতি মাসে সর্বোচ্চ দুই হাজার টাকা দিয়েছে। আমি সেই টাকা আবার তাদের দিয়ে দিয়েছি। এভাবে আমার ২০ লাখ টাকা রাগীবের প্রতিষ্ঠানের কাছে দেওয়া আছে।”
তিনি বলেন, “গত দুবছর ধরে আমাদের আর টাকা দেয়নি। টাকা চাইলে টাকা দেয় না। তখন আমরা বাধ্য হয়ে রাস্তায় নেমে আন্দোলন করেছি, মানববন্ধন করেছি। এখনও করে যাচ্ছি।”
পিরোজপুর জেলার সাবেক পুলিশ সুপার এবং বরিশাল বিভাগের ডিআইজি এস এম আক্তারুজ্জামান শুক্রবার বেনারকে বলেন, “রাগীব মূলত পিরোজপুরে সমবায় ভিত্তিক ব্যবসা শুরু করে। তারা প্রথমদিকে ভালোই করছিল। কিন্তু পরে তারা লোভে পড়ে জমির ব্যবসা শুরু করে।”
তিনি বলেন, “এরপর থেকে মানুষের কাছ থেকে টাকা নেওয়া শুরু করে। এমএলএম ব্যবসায় যেমন হয়: একজনের কাছ থেকে টাকা তুলে আরেকজনকে দেয় এবং শেষের দিকে যারা থাকেন তাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।”
আক্তারুজ্জামান বলেন, “করোনা মহামারির কারণে মানুষ টাকা দেওয়া বন্ধ করে দিলে সমস্যা সামনে আসে। সবাই বুঝতে পারে যে তারা টাকা দিয়ে ভুল করেছে।”
এহসান গ্রুপের উপদেষ্টা মাকফুর রহমান বেনারকে বলেন, “আমি রাগীবের উপদেষ্টা হয়ে কাজ করি। এহসান গ্রুপের এই জালিয়াতির বিষয়ে তদন্ত করতে সরকারের কয়েকজন কর্মকর্তা আমার কাছে এসেছিল। আমি চাচ্ছিলাম রাগীব যেন মানুষের টাকা ফেরত দেয়।”
তিনি বলেন, “সবাই আমার কাছে টেলিফোন করে টাকা ফেরত চায়। এমন হতদরিদ্র লোক আছেন যাদের পাঁচশ থেকে এক হাজার টাকা রাগীবের প্রতিষ্ঠানকে দিয়েছে। আমি ভীষণ কষ্ট পাই ওইসব মানুষের জন্য।”
মাকফুর বলেন, “রাগীবের প্রতিষ্ঠানের প্রায় সবাই ধর্মীয় লেবাসধারী, যাদের হুজুর বলা হয়। আমি বলেছি তোমরা মানুষের টাকা ফেরত দাও, দরিদ্র মানুষের টাকা ফেরত দাও। নইলে হুজুরদের সম্পর্কে দেশের মানুষের নেতিবাচক ধারণা হবে।”
“কিন্তু সে আমার কথা শুনলো না। আটক হলো, বিষয়টি আইনি প্রক্রিয়ায় চলে গেল। এখন দেখা যাক মানুষ কবে তাদের টাকা ফেরত পায়”, তিনি যোগ করেন।
কে এই রাগীব?
র্যাব জানায়, গ্রেফতারকৃত রাগীব আহসান ১৯৮৬ সালে পিরোজপুরের একটি মাদ্রাসায় লেখাপড়া শুরু করেন। ১৯৯৬ থেকে ১৯৯৯ পর্যন্ত হাটহাজারীর একটি মাদ্রাসা থেকে দাওরায়ে হাদিস ও ২০০০ সালে খুলনার একটি মাদ্রাসা হতে মুফতি সম্পন্ন করেন।
লেখাপড়া শেষ করে পিরোজপুরে একটি মাদ্রাসায় চাকরি শুরু করেন রাগীব। ২০০৬-২০০৭ সালে তিনি ইমামতির পাশাপাশি “এহসান এস মাল্টিপারপাস” নামে একটি এমএলএম কোম্পানীতে ৯০০ টাকা বেতনের চাকরি করতেন।
২০০৮ সালে তিনি নিজেই এহসান রিয়েল এস্টেট নামে একটি এমএলএম কোম্পানী প্রতিষ্ঠা করেন। জিজ্ঞাসাবাদে রাগীব র্যাবকে জানান, তিনি মূলত ধর্মীয় আবেগ-অনুভূতিকে কাজে লাগিয়ে এমএলএম কোম্পানীর ফাঁদ তৈরি করেন। তার মূল প্রচার ছিল “শরীয়ত সম্মত সুদবিহীন বিনিয়োগ”।
এই ফাঁদের শিকার হতো মূলত বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তের ধর্মপ্রাণ সাধারণ মানুষ, ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যুক্ত ব্যক্তিবর্গ, ইমাম শ্রেণি ও অন্যান্য মানুষ যাঁরা সুদকে হারাম মনে করেন।
তিনি এর বিষয়টি ব্যাপক প্রচারণা করে গ্রাহকদের আকৃষ্ট করেন। এ ছাড়াও তিনি ওয়াজ মাহফিল আয়োজনের নামে ব্যবসায়িক প্রচার প্রচারণা করতেন।
যাঁরা টাকা বিনিয়োগ করতেন তাদের এক লাখ টাকার বিনিয়োগে মাসিক মাত্রাতিরিক্ত টাকা প্রাপ্তির প্রলোভন দেখানো হতো।
রাগীব ২০০৮ সালে ১০ হাজার গ্রাহক সংগ্রহ করে। সেই সংখ্যা এখন প্রায় লক্ষাধিক বলে জানায় র্যাব।
এহসান গ্রুপের আওতায় ১৭টি প্রতিষ্ঠানে মালিক এই রাগীব যেগুলো প্রায় সব দেউলিয়া বলা যায়।
প্রতিষ্ঠানগুলো হলো: (১) এহ্সান গ্রুপ বাংলাদেশ, (২) এহ্সান পিরোজপুর বাংলাদেশ (পাবলিক) লিমিটেড, (৩) এহ্সান রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড বিল্ডার্স লিমেটেড, (৪) নূর-ই মদিনা ইন্টারন্যাশনাল ক্যাডেট একাডেমি, (৫) জামিয়া আরাবিয়া নূরজাহান মহিলা মাদরাসা, (৬) হোটেল মদিনা ইন্টারন্যাশনাল (আবাসিক), (৭) আল্লাহর দান বস্ত্রালয়, (৮) পিরোজপুর বস্ত্রালয়-১ ও ২, (৯) এহ্সান মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড, (১০) মেসার্স বিসমিল্লাহ ট্রেডিং অ্যান্ড কোং, (১১) মেসার্স মক্কা এন্টারপ্রাইজ, (১২) এহ্সান মাইক অ্যান্ড সাউন্ড সিস্টেম, (১৩) এহ্সান ট্যুর অ্যান্ড ট্রাভেলস, (১৪) ইসলাম নিবাস প্রজেক্ট, (১৫) এহ্সান পিরোজপুর হাসপাতাল, (১৬) এহ্সান পিরোজপুর গবেষণাগার, (১৭) এহ্সান পিরোজপুর বৃদ্ধাশ্রম।
র্যাব মুখপাত্র মঈন জানান, ভুক্তভোগীরা তাদের জানিয়েছেন এসব প্রতিষ্ঠানের নামে অর্থ সংগ্রহ করে রাগীব পরিবারের সদস্য ও নিকট আত্মীয়দের নামে-বেনামে সম্পত্তির পাহাড় গড়েছেন।