এখনো বাড়ির আশা ছাড়েননি মওদুদ
2017.06.08
ঢাকা

চার দশক ধরে বসবাস করা বাড়ির আইনগত অধিকার হারিয়ে সেখান থেকে উচ্ছেদ হলেও এখনো আশা ছাড়েননি ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ। বাড়িটি ফিরে পাবার জন্য বৃহস্পতিবার উচ্চ আদালতে রিট করেছেন তিনি।
সাবেক আইনমন্ত্রী ও বিএনপির এই শীর্ষস্থানীয় নেতার দখলে থাকা গুলশান-২ এর ১৫৯ নম্বরের একতলা বাড়িটি গত বুধবার নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। এর আগে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াও একইভাবে তাঁর বাড়ি থেকে বিতাড়িত হয়েছিলেন।
এদিকে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণেই মওদুদ আহমদকে বাড়ি থেকে তাড়ানোর অভিযোগ এনেছে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি। সরকার সে অভিযোগ অস্বীকার করলেও ঘটনাটিকে রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রতিফলন হিসেবেই দেখছেন বিশ্লেষকেরা।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বেনারকে বলেন, “সম্পূর্ণভাবে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে অমানবিকভাবে মওদুদ আহমদকে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। তাঁর আইনি হার হয়েছে সেটা ভিন্ন ব্যাপার। তবে বাসা থেকে বের হওয়ার জন্যও তাঁকে সময় দেওয়া যেত।”
“তা ছাড়া আদালতে এ বিষয়ে তার একটি আবেদনও ছিল। সেটা নিষ্পত্তি হওয়ার আগেই, জোর করে বের করে দিয়েছে। তাকে কোনো নোটিশ দেওয়া হয়নি,” বলেন তিনি।
তবে মওদুদ আহমদের বাড়ি সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশে ছাড়তে হয়েছে, এতে সরকারের কোনো হস্তক্ষেপ নেই বলে দাবি করেছেন আওয়ামীলীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।
বৃহস্পতিবার দুপুরে গাজীপুরের টঙ্গীর চেরাগ আলী এলাকায় ঢাকা ময়মনসিংহ মহাসড়ক পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে কাদের এ কথা বলেন।
এ প্রসঙ্গে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বেনারকে বলেন, “বিচারিক প্রক্রিয়ায় বাড়ির মালিকানা হারিয়েছেন মওদুদ আহমদ। অতএব বাড়িটির ওপর তাঁর কোনো অধিকার নেই। তবে দীর্ঘদিন ধরে যে বাড়িটিতে তিনি বাস করছিলেন আগে থেকে নোটিশ দিয়ে, সময় দিয়ে ছাড়তে বলাটাই ভদ্রোচিত হতো।”
“তবে আমাদের দেশে তো এই সংস্কৃতি হয়েই আসছে। এটা আমাদের দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিরই প্রতিফলন,” বলেন তিনি।
এর আগে ২০১০ সালে আইনি লড়াইয়ে হারের পর একইভাবে ঢাকা সেনানিবাসের বাড়ি ছাড়তে হয়েছিল খালেদা জিয়াকে। তাঁর পক্ষে আদালতে ওই আইনি লড়াই করেছিলেন ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ। সেনানিবাসের ওই বাড়িটিতে প্রায় ৩৮ বছর বাস করেন খালেদা জিয়া।
মওদুদ আহমদের বাড়ি দখলের খবর পেয়ে বুধবার ঘটনাস্থলে গিয়ে তাঁর (মওদুদ) সঙ্গে দেখা করেন খালেদা জিয়া।
পরে এক অনুষ্ঠানে খালেদা জিয়া বলেন, “ব্যারিস্টার মওদুদ ৩০ বছর যাবৎ আছেন, আজকে তাকে রাস্তায় বের করে দিয়েছে। আমিও আমার বাড়িতে ৪০ বছর ছিলাম। আমাকে এক কাপড়ে বের করে দেওয়া হয়েছে। দুর্নীতিবাজদেরও জনগণ এক কাপড়ে বের করে দেবে।”
আইনি হার
গুলশান-২ এর ১৫৯ নম্বরের একতলা এই বাড়িতে দীর্ঘদিন যাবৎ বসবাস করছিলেন মওদুদ আহমদ। রাজউক কর্মকর্তাদের তথ্য অনুযায়ী, গুলশানের ওই বাড়িটি এক বিঘা ১৩ কাঠা ১৪ ছটাক জমির ওপর। ওই এলাকায় প্রতি কাঠা জমির দাম মোটামুটি ১০ কোটি টাকা। সেই হিসেবে পুরো সম্পত্তির দাম তিনশ থেকে সাড়ে তিনশ কোটি টাকা।
মামলার নথি সূত্রে জানা যায়, বাড়িটির প্রকৃত মালিক পাকিস্তানি নাগরিক মো. এহসান ১৯৬০ সালে তৎকালীন ডিআইটির কাছ থেকে ওই বাড়ির মালিকানা পান। ১৯৬৫ সালে মালিকানার কাগজপত্র এহসানের স্ত্রী অস্ট্রিয়ার নাগরিক ইনজে মারিয়া প্লাজের নামে নিবন্ধন করা হয়।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে স্ত্রীসহ ঢাকা ত্যাগ করা এহসান আর ফিরে আসেননি। ফলে পরের বছর বাড়িটি পরিত্যক্ত সম্পত্তির তালিকাভুক্ত হয়। মওদুদ আহমদ সে বছরই বাড়িটির দখল নেন।
কিন্তু ইনজে মারিয়া প্লাজের মৃত্যুর পর ভুয়া আমমোক্তারনামা তৈরি করে ভাই মনজুর আহমদের নামে মওদুদ আহমদ বাড়িটির দখল নিয়েছেন অভিযোগ এনে চার বছর আগে মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন—দুদক।
বিষয়টি নিয়ে মওদুদ আহমদ সর্বোচ্চ আদালত পর্যন্ত গেলেও রায় তাঁর বিপক্ষে যায়। সর্বশেষ গত রোববার তার আপিলের রায় পুনর্বিবেচনার আবেদনও খারিজ হয়ে যায়। ফলে বাড়ি না ছেড়ে আর কোনো উপায় ছিল না মওদুদ আহমদের।
যেভাবে বাড়ি ছাড়লেন মওদুদ
হঠাৎ করেই বুধবার দুপুর থেকে বাড়িটি দখলের জন্য হাজির হয় রাজউক কর্তৃপক্ষ। এ সময় মওদুদ আহমদ বাড়িতে ছিলেন না। খবর পেয়ে বেলা তিনটার পরে ছুটে আসলেও বাড়ির ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হয়নি তাঁকে। বাড়ির প্রধান ফটকের সামনে দাঁড়িয়েই উচ্ছেদ কর্মকাণ্ড পরিচালনাকারীদের সঙ্গে কথা বলেন তিনি।
এসময় তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “সরকারের প্রতিক্রিয়াশীলতা ও প্রতিহিংসার কারণে এমন করা হচ্ছে। আদালত বাড়ি থেকে উচ্ছেদের কথা বলেননি। রাজউকও উচ্ছেদের কোনো নোটিশ দেয়নি। বিরোধী দলের রাজনীতি করি বলেই বাসা থেকে উচ্ছেদ করা হচ্ছে।”
তবে রাজউকের ম্যাজিস্ট্রেট খন্দকার অলিউর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, “মওদুদ আহমদ এ বাড়ি ‘অবৈধভাবে’ দখলে রেখেছিলেন। আদালত আমাদের পক্ষে রায় দিয়েছেন। এখন রাজউক বিধি অনুযায়ী আমরা দখলমুক্ত করছি।”
সরেজমিনে দেখা যায়, রাজউক কর্তৃপক্ষ বেশ কয়েকটি ট্রাকে করে বাড়িটির মালামাল সরিয়ে নেয়। এ সময় পুলিশ, জলকামান, প্রিজনভ্যান, সাঁজোয়া যান ও বুলডোজারসহ কঠোর নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের উত্তরে বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমদ রাস্তায় শুয়ে থাকা ছাড়া উপায় নেই বলে জানান। যদিও পরে দেখা যায় ১৫৯ নম্বর বাড়িটি থেকে সকল মালামাল ৫১ নম্বর সড়কের ২ নম্বর বাসায় নেওয়া হচ্ছে। জানতে চাইলে মওদুদ আহমদ বলেন, “পাশে আমাদের খালি একটা ফ্ল্যাট আছে, সেখানে নিয়ে রাখা হচ্ছে।”
পরবর্তী শুনানি ২ জুলাই
এদিকে বাড়ি ছাড়ার পরদিনই নোটিশ ছাড়া রাজউকের ওই উচ্ছেদ অভিযানের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে রিট আবেদন করেন মওদুদ। পাশাপাশি বাড়িটির নকশায় কোনো ধরনের পরিবর্তন না করা এবং সেটি ফিরিয়ে দিতে দুটি অন্তর্বর্তীকালীন আদেশও চেয়েছেন তিনি। রিটে রাজউকের পাশাপাশি রাষ্ট্রকেও বিবাদী করা হয়েছে।
বৃহস্পতিবার দুপুরে শুনানি শুরু হলেও ২ জুলাই পর্যন্ত সেটি মুলতবি করেছেন বিচারপতি সৈয়দ মোহাম্মদ দস্তগীর হোসেন ও বিচারপতি মো. আতাউর রহমান খানের বেঞ্চ।