পার্বত্য এলাকায় পাহাড় ধসে সেনা কর্মকর্তাসহ নিহত ১২৬
2017.06.13
ঢাকা

নিম্নচাপের প্রভাবে টানা বর্ষণে পাহাড়ধসে বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলের তিন জেলায় ব্যাপক প্রাণহানি হয়েছে। মঙ্গলবার মধ্যরাত পর্যন্ত সেনাবাহিনীর চার সদস্যসহ মৃতের সংখ্যা ১২৬ বলে জেলাপ্রশাসনগুলোর সূত্রে জানা গেছে। এ সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
সূত্রমতে রাঙ্গামাটিতে ৯৮, চট্টগ্রামে ২৪ ও বান্দরবানে ৪ জনের নিহত হয়েছেন।
গত ১০ বছরের মধ্যে এটি বড় পাহাড়ধস। এর আগে বড় পাহাড়ধসের ঘটনা ঘটে ২০০৭ সালের ১১ জুন। তখন এক দিনে চট্টগ্রাম নগরের বিভিন্ন স্থানে ১২৭ জন নিহত হয়েছিল। ডিজাস্টার ফোরামের তথ্য অনুযায়ী ২০১০ সাল ৫৮ এবং ২০১২ সালে পাড়ার ধসে ৮৬ জনের মৃত্যু হয়।
বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট নিম্নচাপের প্রভাবে গত রোববার থেকে দেশের দক্ষিণ পূর্বের জেলাগুলোতে ভারী বৃষ্টিপাত চলছে। ভারী বর্ষণে পাহাড়ি ঢলে চট্টগ্রামের সঙ্গে রাঙ্গামাটি ও বান্দরবানসহ কক্সবাজারের সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে।
তবে এই ব্যাপক প্রাণহানির জন্য নিছক প্রাকৃতিক দুর্যোগকে দায়ী করতে নারাজ পরিবেশবাদীরা। তাঁদের অভিযোগ, এই মহাবিপর্যয় মনুষ্য সৃষ্ট। নানা অনিয়মে পাহাড় ও প্রকৃতিকে ধ্বংস করার ফলস্বরূপ প্রতিবছরই এমন দুর্যোগ এই অঞ্চলের মানুষের নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পরিবেশ আন্দোলন কর্মী অধ্যাপক ইদ্রিস আলীর মতে, প্রতিবছর পাহাড় ধসে মানুষ মৃত্যুর জন্য রাজনীতিবিদ ও স্থানীয় প্রশাসন দায়ী।
তিনি বেনারকে বলেন, “রাজনীতিবিদদের ছত্রছায়ায় কিছু লোক বিভিন্ন এলাকার বানে ভাসা মানুষদের এনে প্রথমে এসব পাহাড়ের পাদদেশে ঘর তুলে থাকার জন্য ভাড়া দেয়। জীবনের ঝুঁকির বিনিময়ে কম পয়সায় তারা সেখানে বসবাস করে। একসময় প্রভাবশালীরা সেসব পাহাড় পুরোপুরি দখল করে দালান তৈরি করে।”
তিনি বলেন, “চট্টগ্রামের পাহাড়গুলোতে বালু’র পরিমাণ বেশি। পাহাড়গুলোতে বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ায় কখনো বনায়ন হয়নি। যেগুলো গাছ আগে ছিল, সেগুলো কমতে কমতে শেষ পর্যায়ে আছে। বস্তির লোকজন সেসব গাছও কেটে আবাস তৈরি করে। পরে অতি বর্ষণে এসব পাহাড় ধসে পড়ে।”
সেনা সদস্যসহ নিহত শতাধিক
স্থানীয় প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, সোমবার মধ্য রাত থেকে মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম, রাঙ্গামাটি ও বান্দরবানে পাহাড় ধসে নারী ও শিশুসহ শতাধিক নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে রাঙ্গামাটিতে সেনা কর্মকর্তাসহ ৯৮ জন, চট্টগ্রামে ২৪৭ জন ও বান্দরবানে ৪ জন মারা যাওয়ার সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া গেছে।
পাহাড়ধসে প্রাণহানি আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন রাঙামাটি জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা। ফায়ার সার্ভিস ও জেলা প্রশাসন উদ্ধার তৎপরতা চালাচ্ছে। বুধবার রাঙ্গামাটি গিয়ে চট্টগ্রাম ফায়ার সার্ভিসের ৬০ জনের একটি দল উদ্ধার কাজে অংশ নেবেন। পাহাড়ধসের ঘটনায় মারা যাওয়া বেশির ভাগ ব্যক্তি একই পরিবারের। কেউ হারিয়েছেন স্ত্রী-সন্তান, কেউ হারিয়েছেন মা ও ভাইবোন। আবার কয়েকটি পরিবারে কেউ বেঁচে নেই।
এর আগে মঙ্গলবার বিকেলে সচিবালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে চার সেনাসহ মোট ৩৯ জন নিহতের কথা জানিয়েছিলেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া। নিহত সেনাবাহিনীর চার সদস্যের মধ্যে মেজর ও ক্যাপ্টেন পদমর্যাদার দুই কর্মকর্তা রয়েছেন বলে জানান তিনি।
নিহতরা হলেন, সেনাবাহিনীর মেজর মাহফুজুল হক, ক্যাপ্টেন তানভীর সালাম শান্ত, করপোরাল আজিজ ও সৈনিক শাহীন।
আন্তবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) সহকারী পরিচালক রেজাউল করিম বেনারকে বলেন, “এখনো একজন নিখোঁজ রয়েছেন। আহত হয়েছেন আরও ১০ জন। এদের মধ্যে পাঁচজন গুরুতর অসুস্থ। হেলিকপ্টারযোগে তাঁদের ঢাকায় এনে সিএমএইচে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।”
আইএসপিআর মহাপরিচালক রাশেদুল হাসান বেনারকে বলেন, “মঙ্গলবার সকালে চট্টগ্রাম-রাঙ্গামাটি মহাসড়কের মানিকছড়িতে পাহাড় ধসের ঘটনায় উদ্ধারকাজ করছিলেন সেনা সদস্যদের একটি দল। এর মধ্যেই দুপুর ১২টার দিকে আবার ধসের ঘটনা ঘটে।”
চাল ও টাকা পাঠিয়েছে সরকার
পাহাড় ধসে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ৫০০ মেট্রিক টন চাল ও ১২ লাখ টাকা পাঠানো হয়েছে বলে বলে জানিয়েছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী।
মঙ্গলবার সংবাদ সম্মেলনে তিনি জানান, নিহতদের প্রত্যেকের পরিবারকে ২০ হাজার টাকা আর্থিক সহায়তা দেওয়া হবে। আহতরা ১০ হাজার টাকা করে পাবেন। প্রত্যেক পরিবারকে ৩০ কেজি করে চালও দেওয়া হবে।
নিম্ন চাপে সৃষ্টি হওয়ায় গত দুই দিন ধরে মাইকিং করা হলেও ওই এলাকার লোকজন আশ্রয় কেন্দ্রে যাননি বলে দাবি করেন মন্ত্রী।
এখনো অনেকেই মাটিচাপা পড়ে আছেন জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, “সেনাবাহিনী উদ্ধার কাজ চালাচ্ছে। ১৮টি আশ্রয়কেন্দ্র খুলে চার থেকে সাড়ে ৪ হাজার মানুষকে সেখানে রাখা হয়েছে।”
পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বেনারকে বলেন, “পাহাড় ধসের ঘটনা হৃদয়বিদারক। ওই এলাকায় আবহাওয়া এখনো প্রতিকূল। স্থানীয় প্রশাসন সার্বক্ষণিক কাজ করে যাচ্ছে।”
পাহাড়শূন্য হয়ে পড়বে চট্টগ্রাম
পাহাড় দখল ও কাটার মহোৎসবে চলতে থাকলে আগামী এক দশকের মধ্যে চট্টগ্রামের সকল পাহাড় বিলীন হওয়ার আশঙ্কা করছেন পরিবেশবিদরা। এসব কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবিও জানিয়েছেন তাঁরা।
ইদ্রিস আলী বলেন, চট্টগ্রামে একশ’র মতো পাহাড় ছিল। এর মধ্যে গত দুই দশকে ৪০’টির মতো পাহাড় সমভূমির কাছাকাছি চলে এসেছে।”
তিনি বলেন, “প্রতি বছর বর্ষার আগে আগেই শুধু প্রশাসনের তোড়জোড় শুরু হয়। সেটা লোক দেখানো। বাকি ১১ মাসে এরা কোনো ব্যবস্থা নেয় না।”
ইদ্রিস আলী বলেন, এইভাবে পাহাড় দখল চললে আগামী এক দশকে চট্টগ্রাম পাহাড়শূন্য হয়ে পড়বে। এতে করে এ অঞ্চলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ আরও বাড়বে। নান্দনিকতা হারাবে পার্বত্য চট্টগ্রাম।
পরিবেশ আন্দোলনের সংগঠক শরীফ চৌহান বেনারকে বলেন, “অবাধে পাহাড় দখল ও কাটা চললেও এর সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি প্রশাসন। এর ফলে দখলদারদের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। আর ধ্বংস হচ্ছে পাহাড়।”
সব পাহাড় শেষ হওয়ার আগেই কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।