পাঠ্যবইয়ে সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন, দেশ জুড়ে প্রতিবাদ
2017.01.10

চলতি শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যবইয়ে বিভিন্ন ধরনের ভুলভ্রান্তি থাকায় এবং কয়েকটি পাঠ্যপুস্তক থেকে আলোচিত কিছু গল্প-কবিতা বাদ দেওয়ায় বিতর্কের মুখে পড়েছে সরকার। বাদ পড়া বিষয়গুলো আবার ইসলামভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের দাবির সঙ্গে মিলে যাওয়ায় আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে বেশি।
শিক্ষাবিদদের অনেকেই বলছেন, এর মাধ্যমে পাঠ্যবইয়ে সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন ঘটেছে, যার সুদূর প্রসারী প্রভাব পড়বে শিক্ষার্থীদের ওপর। পাঠ্যপুস্তকে সাম্প্রদায়িক ও ধর্মীয় বৈষম্যমূলক বিষয় অন্তর্ভুক্তি, দেশের গুরুত্বপূর্ণ ও প্রগতিশীল লেখকদের লেখা বাদ দেওয়াসহ নানা অসংগতির তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে গতকাল মঙ্গলবার বিবৃতি দিয়েছেন দেশের ৮৫ জন বিশিষ্ট ব্যক্তি।
গতকালই (মঙ্গলবার) এক সংবাদ সম্মেলনে হেফাজতে ইসলামের ১৭ দফা দাবি অনুযায়ী বইয়ের বিষয়বস্তুতে পরিবর্তন আনা হয়েছে কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেছেন, “এখানে কারও দাবিকে প্রাধান্য দেওয়ার সুযোগ নেই, আমরা সবার মতামত নিয়েছি। এখানে হেফাজতও মতামত দিয়ে থাকতে পারে।”
নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, “দেশের কৃষ্টি, কালচার, ধর্ম সবকিছু বিবেচনায় নিতে হয়। তাতে কোনো সময় পাল্লা এদিক-ওদিক হতেই পারে, সমালোচনা থাকতে পারে, আমরা সেগুলোও বিবেচনায় নেই।”
গত ১ জানুয়ারি সারা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে উৎসব করে প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের বিনা মূল্যে নতুন পাঠ্যবই দেয় সরকার। চার কোটিরও বেশি শিক্ষার্থীর জন্য এবার ৩৬ কোটিরও বেশি বই ছাপানো হয়েছে।
বইগুলো শিক্ষার্থীদের হাতে যাওয়ার পর থেকে বিভিন্ন ধরনের ভুলভ্রান্তি ধরা পড়তে শুরু করে। প্রথম বিতর্ক শুরু হয়, প্রথম শ্রেণির ‘আমার বাংলা বই’-এর বর্ণ শিখি অধ্যায়ে ‘ও’ বর্ণ শেখাতে গিয়ে একটি কন্যাশিশুর গায়ে ওড়না জড়িয়ে থাকার ছবি নিয়ে। ছবির নিচে লেখা হয় ‘ওড়না চাই’।
কয়েকজন শিক্ষক ও অভিভাবক বলেছেন, প্রথম শ্রেণির একটি শিশুকে এ ধরনের পোশাক দিয়ে বর্ণ শেখানোর কোনো যুক্তি হতে পারে না। একই বইয়ের ১১ নম্বর পৃষ্ঠায় একটি ছবিতে দেখা যায়, একটি ছাগল গাছ থেকে আম খাচ্ছে, যা নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে।
বই জুড়ে অযত্নের ছাপ
তৃতীয় শ্রেণির ‘আমার বাংলা বই’-এর ৬৮ পৃষ্ঠায় কুসুমকুমারী দাশের ‘আদর্শ ছেলে’ কবিতায় শব্দ যেমন উল্টোপাল্টাভাবে ছাপা হয়েছে, তেমনি ভুল শব্দও ছাপা হয়েছে। এক জায়গায় ‘চায়’ কে ‘চাই’ হিসেবে ছাপা হয়েছে।
নতুন ইংরেজি বইগুলোর পেছনে ‘...বাই দ্য গভর্নমেন্ট অব বাংলাদেশ’ লেখা। এটা গভর্নমেন্ট অব দ্য পিপলস রিপাবলিক অব বাংলাদেশ হওয়ার কথা। তৃতীয় শ্রেণির হিন্দু ধর্ম শিক্ষা বইয়ের শেষ পৃষ্ঠায় লেখা হয়েছে DO NOT HEART ANYBODY. আঘাত বোঝাতে গিয়ে এখানে হৃদয় করে ফেলা হয়েছে। অবশ্য সরকার থেকে বলা হয়েছে, ভুলের সংশোধনী দিয়ে খুব দ্রুত সবাইকে জানিয়ে দেওয়া হবে।
এবারে বিভিন্ন বই থেকে প্রগতিশীল লেখকদের কিছু আলোচিত কবিতা ও গল্প বাদ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে পঞ্চম শ্রেণির বই থেকে প্রথাবিরোধী লেখক হুমায়ুন আজাদের ‘বই’ কবিতাটি বাদ দেওয়া হয়েছে। এ বইয়ে ‘শহিদ তিতুমীর’ লেখা যোগ হয়েছে।
সপ্তম শ্রেণির সপ্তবর্ণা বই থেকে বাদ পড়েছে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘লাল ঘোড়া’, যুক্ত হয়েছে হাবিবুল্লাহ বাহারের ‘মরু-ভাস্কর’। এ ছাড়া শরৎ চন্দ্রের ‘লালু’ ও উপেন্দ্রকিশোরের লেখা ‘রামায়ণের কথা’, সত্যেন সেনের লাল গরুটাও বই থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। বাদ পড়েছে ‘রাচী ভ্রমণ’ গল্প।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়, বই ছাপার দায়িত্বে থাকা প্রতিষ্ঠান জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাদ পড়া কবিতা ও গল্প নিয়ে বিতর্কের সুযোগ রয়েছে— এমন চিন্তা থেকেই তা বাদ দেওয়া হয়। এখন এটি নিয়েই বিতর্ক শুরু হয়েছে।
অভিযোগ উঠেছে, পাঠ্যবইয়ে পরিবর্তন আনতে হেফাজতে ইসলাম যে ১৭ দফা দাবি জানিয়েছিল, সেগুলোর অনেকগুলোই পূরণ হয়েছে।
তবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেছেন, জাতীয় শিক্ষাক্রম সমন্বয় কমিটির (এনসিসিসি) সবাই মিলে এসব সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তার মানে এই নয়, ওই সব লেখকের সব লেখা বাদ দেওয়া হয়েছে। অন্যান্য বইয়ে তাঁদের অনেকেরই লেখা রয়েছে।
৮৫ বিশিষ্ট ব্যক্তির প্রতিবাদ
পাঠ্যপুস্তকে সাম্প্রদায়িক ও ধর্মীয় বৈষম্যমূলক বিষয় অন্তর্ভুক্তি, দেশের গুরুত্বপূর্ণ ও প্রগতিশীল লেখকদের লেখা বাদ দেওয়াসহ নানা অসংগতির তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন দেশের ৮৫ জন বিশিষ্ট ব্যক্তি। গতকাল যৌথ বিবৃতিতে তাঁরা বলেন, প্রাথমিকভাবে ঘটনাগুলোকে দায়িত্বে অবহেলা হিসেবে চালানোর চেষ্টা করা হলেও, ধীরে ধীরে বের হয়ে এসেছে এসব ‘বিকৃতির’ পেছনের ঘটনা।
পশ্চাৎপদ ও মৌলবাদের তোষণনীতির কারণেই পাঠ্য পুস্তকে এই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত পরিবর্তনগুলো আনা হয়েছে। এর পেছনে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির যে ভয়ানক বিস্তার রয়েছে, তা গত কয়েক বছর ধরেই স্পষ্ট। এ বছরের পাঠ্যপুস্তক সেই সাম্প্রদায়িক অপ-রাজনীতির সঙ্গে সরকারের আপস রফারই চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ।
বিবৃতিদাতাদের মধ্যে রয়েছেন; আহমেদ রফিক, কামাল লোহানী, যতীন সরকার, অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, ড. হায়াৎ মামুদ, সৈয়দ হাসান ইমাম, হাসান আজিজুল হক প্রমুখ।
পাঠ্যবইয়ের ভুলভ্রান্তি ও বিভিন্ন বিষয় বাদ দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বেনারকে বলেন, “বিভিন্ন গল্প–কবিতা যেভাবে বাদ দেওয়া হয়েছে তাতে মনে হয় এখানে মৌলবাদীদের কাছে আত্মসমর্পণের ভাব আছে।”
তিন কর্মকর্তাকে অব্যাহতি
বিনা মূল্যের পাঠ্যপুস্তকে ভুলভ্রান্তি নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার মধ্যে গত সোমবার এনসিটিবির দুই কর্মকর্তাকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করা হয়েছে । তাঁরা হলেন এনসিটিবির প্রধান সম্পাদক প্রীতিশ কুমার সরকার ও ঊর্ধ্বতন বিশেষজ্ঞ লানা হুমায়রা খান।
একই দিনে পাঠ্যপুস্তকে ভুলত্রুটি নির্ণয় ও দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে সুপারিশ দিতে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব রুহী রহমানকে আহ্বায়ক করে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
এর একদিন পর মঙ্গলবার এনসিটিবির আর্টিস্ট কাম ডিজাইনার সুজাউল আবেদীনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।
মন্ত্রী যা বললেন
সচিবালয়ে সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ গতকাল বলেন, মানুষের ভুলত্রুটি হতেই পারে। তবে কিছু ভুল হওয়া উচিত ছিল না। এই ভুলের জন্য তাদের বিচার হওয়া উচিত।
“যাঁরা ভুল করেছেন, তাঁরা রেহাই পাওয়ার যোগ্য নন। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন পাওয়ার পর ভুল সংশোধনসহ অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেওয়া হবে,” জানান নুরুল ইসলাম নাহিদ।
তবে শিক্ষাবিদ ও গবেষকদের অনেকেই বলছেন, সূক্ষ্মভাবে পাঠ্যবইয়ে মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক চিন্তা ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে।
“কেউ যদি হেফাজতের দাবির সঙ্গে পাঠ্যবইয়ের পরিবর্তন মিলিয়ে দেখে তাহলে বোঝাই যাবে যে, কৌশলে এসব কাজ করা হয়েছে,” বেনারকে জানান বাংলাদেশ উন্নয়ন পরিষদের নির্বাহী পরিচালক নিলুফার বানু।
পাঠ্যবই নিয়ে কাজ করা ওই গবেষক বলেন, “আমরা পাঠ্যবইয়ের অসংগতিগুলো চিহ্নিত করছি। এটা সরকারকে দেওয়া হবে।”