মৃত্যুদণ্ডের রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন করলেন নিজামী
2016.03.29

সাবেক শিল্পমন্ত্রী ও জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামী মৃত্যুদণ্ডের রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন করেছেন, যাঁর নির্দেশে বা অংশগ্রহণে একাত্তরে নির্বিচারে হত্যা ও ধর্ষণের শিকার হয়েছেন বেশ কিছু মানুষ।
মঙ্গলবার বেলা ১১টার দিকে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখায় নিজামীর রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন করেন তাঁর আইনজীবীরা। ওই আবেদনের ফলে রায়ের কার্যকারিতা স্থগিত থাকবে। তবে গতকাল আদালত রিভিউ আবেদনের শুনানির দিন ধার্য করেনি।
আগামী সপ্তাহে রিভিউয়ের শুনানি হতে পারে। এরপর মৃত্যুদণ্ড বহাল বা খারিজের আদেশ দেবেন আদালত। ওই আদেশ পাওয়ার কয়েক দিনের মধ্যে তা কার্যকর হবে।
আইনজ্ঞরা বলছেন, মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকলে তা এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে কার্যকর হতে পারে। তাঁদের মতে, রিভিউয়ের রায় ঘোষণার পর তা কার্যকর করার বিষয়টি সরকারের এখতিয়ার।
“পুনর্বিবেচনার আবেদনটি ৭০ পৃষ্ঠার। এতে ৪৬টি যুক্তি তুলে ধরে সাজা থেকে নিজামীর খালাস চাওয়া হয়েছে,” সাংবাদিকদের জানান নিজামীর ছেলে ও আইনজীবী নাজিব মোমেন।
নিজামীর প্রধান আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, যেহেতু অপরাধের সঙ্গে নিজামীর সরাসরি অংশগ্রহণ নেই, তাই তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া ন্যায়বিচারের পরিপন্থী হবে।
“আপিল বিভাগ অনেক ক্ষেত্রে সঠিকভাবে সাক্ষ্য পর্যালোচনা করেননি। সবকিছু বিবেচনা করা হলে নিজামী খালাস পাবেন বলে আশা করছি,” বেনারকে জানান খন্দকার মাহবুব।
রাষ্ট্রপক্ষ অবশ্য আশা করছে, গুপ্তঘাতক আলবদর বাহিনীর নেতা নিজামীর মৃত্যুদণ্ডের রায় বহাল থাকবে।
“পুনর্বিবেচনার আবেদন যাতে দ্রুত শুনানি হয়, এ জন্য রাষ্ট্রপক্ষ প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ নেবে,” বেনারকে জানান অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা।
আইনজ্ঞরা বলছেন, রিভিউ খারিজ হলেই মৃত্যুদণ্ড কার্যকর প্রক্রিয়া শুরু হবে। সে ক্ষেত্রে সর্বশেষ সুযোগ হিসেবে আসামি রাষ্ট্রপতির কাছে অপরাধ স্বীকার করে প্রাণভিক্ষা চাইতে পারবেন।
প্রাণভিক্ষার আবেদন না করলে কিংবা আবেদন করার পর নাকচ হয়ে গেলে ফাঁসি কার্যকর করা হবে।
ফাঁসির রায় বহাল রেখে আপিলের পূর্ণাঙ্গ রায় ১৫ মার্চ প্রকাশিত হয়। ওই দিন রাতেই পূর্ণাঙ্গ রায়ের অনুলিপি সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয় থেকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে পৌঁছায়। আপিল বিভাগের চূড়ান্ত রায় ঘোষণার প্রায় আড়াই মাস পর পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়।
২০১৪ সালের ২৯ অক্টোবর নিজামীকে ফাঁসির আদেশ দিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল বলেছিলেন, নিজামী যে ঘৃণ্য অপরাধ করেছেন, মৃত্যুদণ্ড ছাড়া আর কোনো সাজা তাঁর জন্য যথেষ্ট নয়। ট্রাইব্যুনালের ওই রায়ের বিরুদ্ধে নিজামী আপিল বিভাগে যান। গত ৬ জানুয়ারি ট্রাইব্যুনালের দেওয়া সর্বোচ্চ দণ্ড বহাল রাখেন আপিল বিভাগ।
এ মামলায় নিজামীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ যে ১৬টি অভিযোগ আনে, ট্রাইব্যুনালে তাঁর মধ্যে আটটি প্রমাণিত হয়। এর মধ্যে পাবনার বাউস গাড়ি ও ডেমরা গ্রামে ৪৫০ জনকে নির্বিচারে হত্যা ও ধর্ষণ, করমজা গ্রামে ১০ জনকে হত্যা ও তিনজনকে ধর্ষণ, ধুলাউড়ি গ্রামে ৫২ জনকে হত্যা এবং বুদ্ধিজীবী হত্যার পরিকল্পনার দায়ে (২,৪, ৬ ও ১৬ নম্বর অভিযোগ) নিজামীকে মৃত্যুদণ্ড দেন ট্রাইব্যুনাল। আপিল বিভাগের রায়ে করমজা গ্রামে ১০ জনকে হত্যা ও ৩ জনকে ধর্ষণের দায় (৪ নম্বর অভিযোগ) থেকে নিজামীকে খালাস দেওয়া হয়। বাকি তিন অভিযোগে তাঁর ফাঁসি বহাল রাখা হয়।
ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগে করা এক মামলায় ২০১০ সালের ২৯ জুন নিজামীকে গ্রেপ্তার করা হয়। একই বছরের ২ আগস্ট তাঁকে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। ২০১২ সালের ২৮ মে ট্রাইব্যুনাল তাঁর বিরুদ্ধে ১৬টি অভিযোগ গঠন করে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার বিচার শুরু করেন।
নিজামীর মামলার রায়ে ট্রাইব্যুনাল বলেন, আলবদর বাহিনী একাত্তরে যে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড চালিয়েছিল, তার ওপর নিজামীর প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণ ছিল। রাষ্ট্রপক্ষের দাখিল করা বিভিন্ন নথি এবং মৌখিক সাক্ষ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, একাত্তরের মে মাসে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বাঙালি নিধনযজ্ঞে যোগ দেয় জমিয়তে তলাবা (জামায়াতের তৎকালীন ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘ)।
মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিহত করার জন্য ছাত্র সংঘ দুটি আধা সামরিক জঙ্গি বাহিনী গঠন করে: আলবদর ও আলশামস। এর মধ্যে আলবদরে যোগ দেয় জমিয়তে তলাবার বিপুলসংখ্যক সদস্য। এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন মতিউর রহমান নিজামী, তখন তিনি ছিলেন জমিয়তের নাজিম-এ-আলা (প্রধান)।
১৯৬৬ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত নিজামী ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র সংঘের সভাপতি, এরপর তিনি নিখিল পাকিস্তান ছাত্র সংঘের সভাপতি হন। ১৯৭১ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নিজামী ছাত্র সংঘের প্রধান ছিলেন।