উখিয়ায় স্থাপিত হতে যাচ্ছে বাংলাদেশের প্রথম ‘উন্মুক্ত কারাগার’
2024.05.02
ঢাকা

কক্সবাজার জেলায় স্থাপিত হতে যাচ্ছে বাংলাদেশের প্রথম ‘উন্মুক্ত কারাগার’। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বৃহস্পতিবার সংসদ অধিবেশনের প্রশ্নোত্তর পর্বে সরকারের এই পরিকল্পনার কথা জানান।
এক প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “উন্নত দেশের ন্যায় বাংলাদেশে উন্মুক্ত কারাগার নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।”
তিনি বলেন, “মালয়েশিয়ার কমিউনিটি রিহ্যাবিলিটেশন প্রোগ্রামের আদলে উন্মুক্ত কারাগার নির্মাণের জন্য কক্সবাজার জেলার উখিয়া উপজেলায় ১৬০ একর জমি বন্দোবস্ত পাওয়া গিয়েছে। উন্মুক্ত কারাগার নির্মাণের কার্যক্রম শিগগির শুরু করা হবে।”
এ ব্যাপারে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বৃহস্পতিবার বেনারকে বলেন, “উন্মুক্ত কারাগারে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে এবং মালয়েশিয়ায় রয়েছে। এর মূল কথা হলো, সাজাপ্রাপ্ত কয়েদিদের সাজা শেষ করার আগে তাদের সামাজিকীকরণ করা।”
তিনি বলেন, “উন্মুক্ত বলার কারণ হলো, এই কারাগারে কয়েদিরা অনেকটা ইচ্ছামত ঘোরাঘুরি করতে পারবে এবং মানুষের সাথে মেশার সুযোগ পাবে যা প্রথাগত কারাগারে নেই।”
বিষয়টি ব্যাখ্যা করে মন্ত্রী আরও জানান, “কয়েদিদের সাজার মেয়াদ শেষ হওয়ার এক বছর অথবা ছয় মাস আগে তাদেরকে উন্মুক্ত এই কারাগারে নেয়া হবে। সেখানে বিরাট ক্যাম্পাস থাকবে; প্রথাগত কারাগারের মতো অবকাঠামো নয়। এখানে কয়েদিরা পুরো এলাকায় ঘুরতে পারবে, কিন্তু বাইরে যেতে পারবে না। এখানকার নিরাপত্তা ব্যবস্থাও থাকবে কিছুটা শিথিল।”
তিনি আরও বলেন, “আমাদের অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, সাজার মেয়াদ শেষ হওয়ার দিকে কয়েদিরা পালানোর চেষ্টা করে না। তবে কেউ যদি এই উন্মুক্ত কারাগার থেকে পালিয়ে যায় অথবা পালানোর চেষ্টা করে তাহলে তাদের সাজার পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে এবং আবার তাদের প্রথাগত কারাগারে নেওয়া হবে।”
উন্মুক্ত কারাগারের ব্যাপারে জানতে যোগাযোগ করা হলে কারা অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ.এস.এম. আনিসুল হক বৃহস্পতিবার বেনারকে বলেন, “উন্মুক্ত কারাগার বাংলাদেশে একটি নতুন ধারণা। এটি মালয়েশিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন উন্নত দেশে রয়েছে। এর মাধ্যমে একজন দণ্ডিত ব্যক্তিকে সমাজে পুনর্বাসিত করা সম্ভব হবে।”
তিনি বলেন, “আমাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী, যেসব ব্যক্তি যাবজ্জীবন বা বিভিন্ন দীর্ঘ মেয়াদের সাজা পেয়েছেন, তাঁদেরকে কারাগার থেকে এই উন্মুক্ত কারাগারে স্থানান্তর করা হবে।”
আনিসুল হক বলেন, “এসব বন্দিদের সাজার মেয়াদ শেষ হওয়ার কিছু দিন আগে এই কারাগারে আনা হবে। এই উন্মুক্ত কারাগারে কাউন্সেলর থাকবেন। তাঁরা তাঁদের পরামর্শ দেবেন। আবার যেসব দণ্ডিত ব্যক্তিদের সাজার পরিমাণ কম, তবে আচার-ব্যবহার ভালো, সংশোধন হতে চায়, তাদের এই উন্মুক্ত কারাগারে রাখা হবে।”
তিনি বলেন, “এখানে তাদের বিভিন্ন ধরনের পেশাগত প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে।”
উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, “যদি একজন দণ্ডিত ব্যক্তির মুদি দোকান পরিচালনার অভিজ্ঞতা থাকে, আমরা সেই ব্যক্তিকে মুদি দোকান পরিচালনার প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দেবো। ফলে ওই ব্যক্তি কারাগার থেকে বেরিয়ে সমাজের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে অবদান রাখতে পারবেন। সমাজের মূল ধারায় ফিরে আসবেন।”
বাংলাদেশের কারাগারগুলোতে ধারণ ক্ষমতার প্রায় দ্বিগুণ আসামি রয়েছে। সরকারি হিসাবে, দেশের সব কারাগারের ৪২ হাজার ৮৬৬ জনের থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। বৃহস্পতিবার পর্যন্ত অবস্থান করছেন ৭১ হাজার ১৯৮ কয়েদি ও হাজতি।
তাঁদের মধ্যে হাজতির সংখ্যা ৫১ হাজার ৫৯৭ ও কয়েদি রয়েছেন ১৯ হাজার ৬০০ জনের বেশি। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তি রয়েছেন দুই হাজার ৫৫১ জন।
সরকারের উন্মুক্ত কারাগার স্থাপনের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক এ.কে.এম. শহীদুল হক বৃহস্পতিবার বেনারকে বলেন, “বাংলাদেশে এটি একটি নতুন ধারণা। তবে আমার মনে হয়, এর মাধ্যমে মাদকসহ বিভিন্ন অপরাধীদের সংশোধনের একটি নতুন সুযোগ আসতে পারে।”
তিনি বলেন, “মাদকসেবী, মাদক বহনকারী, কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের এখানে রেখে কাউন্সেলিং করে সংশোধন করা যেতে পারে। তবে সব কিছু নির্ভর করছে এই উন্মুক্ত কারাগারটি কীভাবে পরিচালনা করা হবে তার ওপর।”
সরকারের এই সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক মিজানুর রহমান।
তিনি বৃহস্পতিবার বেনারকে বলেন, “আমি বুঝলাম না, উন্মুক্ত কারাগার কী! কারাগার তো কারাগার, সেটি উন্মুক্ত হয় কীভাবে? কারাগার হলো এমন একটি স্থান, যেখানে কারও স্বাধীনতা নেই।”
তিনি বলেন, “কমিউনিটি রিহ্যাবিলিটেশন প্রোগ্রামের আদলে উন্মুক্ত কারাগার স্থাপনের কথা বলা হচ্ছে কিন্তু কমিউনিটি রিহ্যাবিলিটেশন প্রোগ্রাম বিষয়টি সম্পূর্ণ আলাদা। এই কর্মসূচির আওতায় একজন লঘু সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে সমাজে পুনর্বাসিত করা হয়। গুরুতর অপরাধ করা কোনো ব্যক্তিকে পুনর্বাসন কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয় না।”
বিষয়টি ব্যাখ্যা করে অধ্যাপক মিজানুর রহমান বলেন, “যদি কোনো ব্যক্তি লঘু অপরাধ; যেমন মারামারি, চুরি, মাদক পরিবহন করার অপরাধে দণ্ডিত হন। অথবা যদি দেখা যায়, কোনো ব্যক্তিকে কোনো অপরাধে ফাঁসিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং তিনি দণ্ডিত হয়েছেন, সেক্ষেত্রে তাঁকে এই কর্মসূচির আওতায় আনা হয়।
“সাধারণত এই কর্মসূচির আওতায় ওই ব্যক্তিকে তাঁর নিজের এলাকায়, নিজের বাড়িতে রাখা হয় এবং বলা হয়, ‘তুমি আগামী ছয় মাস অথবা এক বছর মসজিদের মেঝে পরিষ্কার করবে।’ যদি ওই ব্যক্তি দায়িত্ব পালন না করেন অথবা কোনো অপরাধে যুক্ত হন, তাহলে তাঁকে কারাগারে যেতে হয়। যদি কোনো অপরাধ না করেন, তাহলে তিনি সমাজে অন্তর্ভুক্ত হন,” যোগ করেন তিনি।
মিজানুর রহমান আরও বলেন, “সরকার যেভাবে করতে যাচ্ছে, সেটি কমিউনিটি রিহ্যাবিলিটেশন প্রোগ্রামের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।”