কর্মকর্তাদের সম্পদের খবর প্রকাশে গণমাধ্যমকে সতর্ক করেছে পুলিশ
2024.06.21
ঢাকা

আয়ের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ বিপুল সম্পদ অর্জনের ঘটনায় সাবেক দুই পুলিশ কর্মকর্তার বিষয়ে খবর প্রকাশের ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করে ভবিষ্যতে পুলিশকে নিয়ে খবর প্রকাশের ক্ষেত্রে ‘অধিকতর সতর্কতা অবলম্বন’ করতে গণমাধ্যমের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশ পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন (বিপিএসএ)।
শুক্রবার পুলিশের বিসিএস ক্যাডারভুক্ত কর্মকর্তাদের সংগঠন বিপিএসএর সভাপতি ও পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের (এসবি) অতিরিক্ত আইজিপি মো. মনিরুল ইসলাম এবং অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশ সুপার গোলাম মোস্তফা রাসেলের স্বাক্ষরে গণমাধ্যমে পাঠানো বিবৃতিতে সাংবাদিকতার নৈতিকতা ও দায়িত্ব প্রসঙ্গে বক্তব্য দিয়েছে সংগঠনটি।
সম্প্রতি পুলিশের সাবেক প্রধান (আইজিপি) বেনজীর আহমেদের বিপুল সম্পদের খবর প্রকাশের পর হঠাৎ করেই সামনে আসে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সাবেক কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া ও তার পরিবারের সদস্যদের বিপুল সম্পদ অর্জনের খবর।
কর্মজীবনে প্রভাবশালী দুই পুলিশ কর্মকর্তাই বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের খুবই ঘনিষ্ঠ হিসেবে প্রায় সবমহলে স্বীকৃত।
অনুসন্ধান শুরু করে বেনজীরের বিপুল পরিমাণ সম্পদ ইতোমধ্যে জব্দ করার পাশাপাশি আছাদুজ্জামানের বিষয়ে স্থানীয় গণমাধ্যমগুলোতে প্রকাশিত খবর নিয়ে যাচাই-বাছাই শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
এ বিষয়ে দুদকের প্রধান আইনজীবী খুরশিদ আলম খান বেনারকে বলেন, “বেনজীর আহমেদের বিপুল সম্পদ ইতোমধ্যে অনুসন্ধানের স্বার্থে জব্দ করা হয়েছে। নতুন করে আছাদুজ্জামান মিয়ার খবর সামনে এসেছে, খবরগুলো যাচাই-বাছাই শুরু করেছে দুদক। তার ক্ষেত্রে আনুষ্ঠানিক অনুসন্ধান শুরুর সিদ্ধান্ত নিতে দুদকের কিছুটা সময় প্রয়োজন হবে।”
সাংবাদিকতার নৈতিকতা প্রসঙ্গে পুলিশ সমিতি
পুলিশের সাবেক দুই কর্মকর্তার দুর্নীতির খবর প্রকাশের ঘটনাকে ‘ধারাবাহিকভাবে আংশিক, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও ঢালাও’ হিসেবে আখ্যায়িত করে এক্ষেত্রে গণমাধ্যমকে ‘অধিকতর সতর্কতা অবলম্বন ও সাংবাদিকতার নীতিমালা যথাযথভাবে’ অনুসরণের অনুরোধ জানিয়েছে বিপিএসএ।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, কোনো কোনো গণমাধ্যম ব্যক্তিগত আক্রোশ ও নিজস্ব স্বার্থ রক্ষায় কোনো কোনো পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অবমাননাকর নেতিবাচক সংবাদ প্রকাশ ও প্রচার করছে, যা সাংবাদিকতার নীতিমালা বিরোধী।
“এমতাবস্থায়, কী কারণে, কার উদ্দেশ্য হাসিল এবং কার নির্দেশ (ম্যানডেট) বাস্তবায়নের জন্য কতিপয় গণমাধ্যম বাংলাদেশ পুলিশের বিরুদ্ধে এ ধরনের কুৎসা রটনায় লিপ্ত, সেই প্রশ্ন উত্থাপন করা অযৌক্তিক নয়,” বলা হয় বিবৃতিতে।
পুলিশ সমিতি বলেছে, “কোনো এক রহস্যময় কারণে এক শ্রেণির গণমাধ্যম অতি সুকৌশলে পুলিশকে বিতর্কিত করে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর অপচেষ্টায় মেতেছে, যা সৎ সাংবাদিকতার কণ্ঠরোধকারী অপসাংবাদিকতারই নামান্তর বলে পরিগণিত হয়। গণমাধ্যমের এ ধরনের একপেশে আচরণ সাধারণ পাঠকের সঙ্গে প্রতারণার শামিল। এ ধরনের অপসাংবাদিকতা পুলিশের সৎ, নিষ্ঠাবান, পেশাদার ও দেশপ্রেমিক সদস্যদের মনোবল ধ্বংসের অপপ্রয়াস বলে প্রতীয়মান হয়, যা তাঁদের পেশাগত দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে বিরূপ প্রতিক্রিয়া ফেলতে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে।”
এই বিবৃতি গণমাধ্যমের প্রতি হুমকি: বিশেষজ্ঞ
ভবিষ্যতে গণমাধ্যমকে অধিকতর সতর্ক হওয়ার যে আহ্বান পুলিশ সমিতি জানিয়েছে সেটিকে গণমাধ্যমের প্রতি সরাসরি হুমকি বলে মনে করেন আর্টিকেল নাইনটিনের আঞ্চলিক পরিচালক (বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়া) শেখ মনজুর-ই-আলম।
"দেখুন আমার কাছে মনে হয়েছে এই বিবৃতির মাধ্যমে পুলিশ দায়মুক্তি চেয়েছে এবং কোন রাখঢাক ছাড়াই গণমাধ্যমকে হুমকি দিয়েছে," বেনারের সঙ্গে আলাপকালে বলেন মনজুর-ই-আলম।
তিনি বলেন, দুর্নীতির খবর বেরিয়ে আসার পর পুলিশের উচিত ছিলো অভিযোগগুলোর বিষয়ে চলমান তদন্তকে সহযোগিতার ঘোষণা দেয়া। সেটা না করে যে অবস্থান নিয়েছে কর্মকর্তাদের সমিতি তা এই সমিতির উদ্দেশ্য প্রশ্নবিদ্ধ করে।
সরকারবিরোধী বলে পরিচিত ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের (ডিইউজে) একাংশের সাধারণ সম্পাদক খুরশীদ আলম বেনারকে বলেন, “পুলিশ সমিতির এই বিবৃতি স্বাধীন গণমাধ্যমের জন্য সরাসরি হুমকি।”
তিনি বলেন, প্রকাশিত সংবাদ নিয়ে কারো কোন আপত্তি থাকলে প্রচলিত আইন মেনে প্রেস কাউন্সিলের মাধ্যমে প্রতিকার চাওয়া যেতে পারে। কিন্তু সেসব না করে এই বিবৃতির মাধ্যমে কিছু ব্যক্তির স্বার্থে রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে ব্যবহার করা হয়েছে। অনতি বিলম্বে এটা প্রত্যাহারের দাবি জানান তিনি।
আছাদুজ্জামান মিয়ার বিপুল সম্পদ
ঈদুল আযহার ছুটির আগে স্থানীয় একটি গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে দেখা যায় নিজের, স্ত্রীর, ছেলে, মেয়ে ও নিকট আত্মীয়দের নামে বিপুল পরিমাণ সম্পদ গড়েছেন জাতীয় নিরাপত্তা সংক্রান্ত সেলের সাবেক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আছাদুজ্জামান মিয়া।
আছাদুজ্জামান মিয়া ও তার পরিবারের সদস্যদের এই বিপুল সম্পদ নিয়ে একটি গোয়েন্দা সংস্থার গোপন প্রতিবেদনের একটি কপি বেনারের হাতে এসেছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, আছাদুজ্জামান ও তার পরিবারের নামে বিপুল পরিমাণে সম্পদ রয়েছে।
আসাদুজ্জামান পরিবারের সম্পদের মধ্যে গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, ফরিদপুর এবং রাজধানীর বসুন্ধরা, আফতাবনগর, মোহাম্মদপুর, জোয়ার সাহারা, সাভার ও পূর্বাচলে জমি, প্লট ও বাড়ির খোঁজ মিলেছে। অন্তত দুটি কোম্পানিরও খোঁজ পাওয়া গেছে তাদের নামে।
এ ছাড়া সন্তানদের নামে ঢাকার ইস্কার্টন, সিদ্ধেশ্বরী ও নিকুঞ্জ এলাকায় রয়েছে অভিজাত ফ্ল্যাট। নিজের নামে রাজউকের ১০ কাঠা প্লট থাকার পরও আইন ভেঙে বিশেষ কোটায় স্ত্রীর নামে নিয়েছেন আরো সাত কাঠার প্লট।
পুলিশে চাকরির মেয়াদ শেষ হলে ২০১৯ সালের জাতীয় নিরাপত্তা সংক্রান্ত সেলে আছাদুজ্জামানকে নিয়োগ দেয় সরকার। ২০২২ সালে তার চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়।
অভিযোগের বিষয়ে বর্তমানে বিদেশে অবস্থান করা আছাদুজ্জামান ১৮ জুন এক ভিডিও বার্তায় বলেন, “আমার বিরুদ্ধে দু-একটি মিডিয়া অবৈধ সম্পদ অর্জনের যে খবর প্রকাশ করেছে—সেটি অসত্য, বানোয়াট, অতিরঞ্জিত, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। আমার জ্ঞাত আয়ের বাইরে কোনো ধরনের কোনো সম্পদ নেই এবং বৈধ আয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, এমন কোনো সম্পত্তি আমার নেই বা আমার পরিবারের নেই।”
তিনি বলেন, “আমি দেশে ফেরার পরে প্রয়োজনে কর্তৃপক্ষের কাছে প্রয়োজনীয় প্রমাণ এবং তথ্যাদি পেশ করব।”
বেনজীরের আরো সম্পদের খোঁজ
এদিকে আগে থেকেই দুদকের অনুসন্ধানের আওতায় থাকা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনে অভিযুক্ত সাবেক আইজিপি বেনজীরের আহমেদের আরো সম্পদের খোঁজ পেয়েছে দুদক।
গত ১২ জুন তার পরিবারের সদস্যদের নামে থাকা ঢাকায় আরো আটটি ফ্ল্যাট ও প্রায় ৭৬ বিঘা জমি জব্দ করেছে। সিটিজেন টেলিভিশন ও টাইগার ক্রাফটের শেয়ার অবরুদ্ধ করা হয়েছে। বেনজীর পরিবারের নামে এ নিয়ে ঢাকায় মোট ১২টি ফ্ল্যাটের খোঁজ মিলেছে।
এর আগে দুই দফায় বেনজীর ও তাঁর পরিবারের নামে গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর, কক্সবাজার ও ঢাকার সাভারে থাকা ৬২১ বিঘা জমি, ১৯টি কোম্পানির শেয়ার এবং গুলশানের ৪টি ফ্ল্যাট জব্দের আদেশ দিয়েছিলেন। তখন ৩০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র ও ৩৩টি ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ করা হয়।
জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হতে গত ৬ জুন বেনজীর এবং ৯ জুন তার স্ত্রী-সন্তানরা উপস্থিত না হলে ২৩ ও ২৪ জুন নতুন সময় নির্ধারণ করে দেয় দুদক। তবে রোববার হাজির না হলে দুদক আর সময় দিবে না জানিয়ে খুরশিদ আলম বলেন, কমিশন মনে করলে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করা হবে।
অভিযোগগুলো ‘ঢালাও’: কাদের
পুলিশ ও সেনা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগগুলো ‘ঢালাও’ বলে মন্তব্য করেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তিনি এসব অভিযোগের গুজব বিএনপি ছড়াচ্ছে বলেও অভিযোগ করেছেন।
শুক্রবার রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার ইনস্টিটিউট গেটে আওয়ামী লীগের ৭৫ তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত শোভাযাত্রা পূর্ব সমাবেশে এসব কথা বলেন ওবায়দুল কাদের।
একই সঙ্গে একে সরকার হটানোর ষড়যন্ত্র কিনা তাও ভেবে দেখে আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীদের সতর্ক থাকার নির্দেশনা দেন তিনি।