ভারতে পুলিশ হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা বাড়ছে: হিউম্যান রাইটস ওয়াচ
2017.01.12

ভারতে পুলিশ হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যুর ঘটনা বেড়েই চলছে। দেশটির পুলিশ বাহিনী সমস্ত নিয়মকানুন অগ্রাহ্য করে সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের হেফাজতে নিয়ে পাশবিক অত্যাচার চালিয়ে খুন করছে।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এক প্রতিবেদনে এ কথা বলা হয়েছে। বৃহস্পতিবার কলকাতার প্রেস ক্লাবে ‘বাউন্ড বাই ব্রাদারহুড—ইন্ডিয়াস ফেইলুর টু এন্ড কিলিংস ইন পুলিশ কাস্টডি’ শীর্ষক ১২১ পৃষ্ঠার ওই প্রতিবেদন প্রকাশ করেন সংস্থার দক্ষিণ এশিয়ার পরিচালক মীনাক্ষী গাঙ্গুলি।
সরকারের জাতীয় ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ২০১০ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে পুলিশ হেফাজতে কমপক্ষে ৫৯১ ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। যদিও মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, প্রকৃত ওই সংখ্যা আরও বেশি।
প্রকাশিত প্রতিবেদনে ভারতের পুলিশবাহিনী কীভাবে গ্রেপ্তারের নিয়ম অবমাননা করে, কীভাবে হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা ঘটে—সেসব বিষয় তুলে ধরা হয়। ১৭টি পুলিশ হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনার মূল্যায়ন করে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ নিশ্চিত হয়েছে যে, প্রতিটি ক্ষেত্রে পুলিশ আধিকারিকরা গ্রেপ্তারের নিয়ম লঙ্ঘণ করে নির্যাতিতকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন সিকিম হাইকোর্টের সাবেক প্রধান বিচারপতি মলয় সেনগুপ্ত, বাংলার মানবাধিকার সুরক্ষা মঞ্চের (মাসুম) সম্পাদক কিরীটী রায় ও পুলিশ হেফাজতে মৃত এক ব্যক্তির বিধবা স্ত্রী রেবা বিবি।
প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি মলয় সেনগুপ্ত সম্মেলনে বলেন, “পুলিশের করণীয় সম্পর্কে ভারতের সংবিধানে সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ এবং ভারতের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের অসংখ্য নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও সেগুলোকে মান্য করা হচ্ছে না।”
পুলিশ হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা কমানোর জন্য ১৯৯৭ সালে ডি কে বাসু বনাম পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মামলার রায়কে ভারতের ফৌজদারি কার্যবিধির সঙ্গে যুক্ত করা হয়। কিন্তু এর কোনোটাই পুলিশ আধিকারিকরা মেনে চলছেন না বলেও অভিযোগ করেন তিনি।
মাসুমের সম্পাদক কিরীটী রায় বলেন, “পুলিশ হেফাজতে মৃত্যুর সঠিক তথ্য পাওয়াই কঠিন। সরকারিভাবে ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর যে প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয় তাতে সব হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা উঠে আসে না।”
২০১৬ সালে মাসুম জাতীয় মানবাধিকার সংস্থার কাছে পুলিশ হেফাজতে ও পুলিশি নির্যাতনে মৃত্যু, হেফাজত থেকে পালিয়ে যাওয়ার সময় মৃত্যু ও হেফাজতে থাকাকালীন ধর্ষণের মতো ১২১টি ঘটনাকে চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়ার আরজি জানায়।
পুলিশ হেফাজতে মৃত রাজীব মোল্লার স্ত্রী রেবা বিবি অভিযোগ করেন, “পুলিশের অকথ্য নির্যাতনের ফলেই আমার স্বামীর মৃত্যু হয়েছে। অথচ পুলিশের কাছে জানতে চাইলে বলা হয়, গলায় মাফলার জড়িয়ে সে আত্মহত্যা করেছে।”
এ দাবি না মেনে পুলিশের কাছে অভিযোগ দায়ের করেছেন জানিয়ে রেবা বিবি বলেন, “ওই অভিযোগ তুলে নিতে আমাকে নানাভাবে হুমকি দেওয়া হচ্ছে। বিষয়টি জানিয়ে সুরক্ষার আবেদন চেয়ে সরকারের বিভিন্ন স্তরে চিঠি লিখেও কোনো সাড়া মেলেনি।”
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের পরিচালক মীনাক্ষী গাঙ্গুলি বেনারকে বলেন, “ভারতে অভিযোগ নথিভুক্তকরণ, গ্রেপ্তার ও অভিযুক্তকে জিজ্ঞাসাবাদ করার সুনির্দিষ্ট নিয়ম থাকা সত্ত্বেও অভিযুক্তের বিরুদ্ধে প্রমাণ সংগ্রহের জন্য পুলিশ সন্দেহভাজন ব্যক্তির ওপর পাশবিক অত্যাচার চালায়। বুটের আঘাত, বেল্টের আঘাত বা হাত বেঁধে ঝুলিয়ে রাখার মতো সব ধরনের অত্যাচার করা হয়।”
গবেষণার তথ্য উল্লেখ করে ওই মানবাধিকার কর্মী বলেন, “পুলিশি হেফাজতে মৃত্যুর ক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ বিভাগীয় তদন্তে সাধারণত পুলিশকে দোষী সাব্যস্ত করা হয় না।”
পুলিশ হেফাজতে মারা যাওয়ার দৃষ্টান্ত
পশ্চিমবঙ্গের হুগলির ৩৫ বছরের কাজি নাসিরুদ্দিনকে ২০১৩ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি আটক করা হয়েছিল। পুলিশ হেফাজতে তাঁর মৃত্যু হয়। ধনেখানি পুলিশ স্টেশনের আধিকারিকরা তাঁর মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে জানিয়েছেন, সেখানকার শৌচাগারে পড়ে গিয়ে তাঁর মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু তার স্ত্রী মনাজা বিবি অভিযোগ করেন যে, পুলিশ হেফাজতে অমানুষিক নির্যাতনের ফলেই তাঁর স্বামীর মৃত্যু হয়েছে।
মনাজা বিবি রাজ্যের গভর্নরকে লিখিতভাবে এই ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্তের আবেদন জানান। এর পরেই ওই ঘটনার তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন বিভাগ বা সিআইডিকে। কিন্তু সিআইডি সঠিকভাবে তদন্ত করতে ব্যর্থ হয়।
২০১৩ সালের মে মাসে কলকাতা হাইকোর্ট নাসিরুদ্দিনের মামলা সিবিআইয়ের হাতে তুলে দেওয়ার নির্দেশ দেয়। হাইকোর্ট রায় দেয়, এই ঘটনায় গ্রেপ্তারের নিয়ম লংঘন করা হয়েছে।
পুলিশ নিজেদের কার্যবিধি মেনে কাজ করে
পুলিশ আইন না মানার ফলে ২০১৫ সালের ৯৭টি হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনার মধ্যে ৬৭টির ক্ষেত্রে হয় নির্যাতিত ব্যক্তিকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে পেশ করা হয়নি, নয়তো নির্যাতিত ব্যক্তির গ্রেপ্তারের ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই মৃত্যু হয়েছে।
তামিলনাড়ু রাজ্যে একজন বিচারক হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে জানিয়েছেন, পুলিশ নিজেদের কার্যবিধি মেনে কাজ করে, ভারতের ফৌজদারি কার্যবিধি মেনে কাজ করে না।
অন্যদিকে ভারতের জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের প্রাক্তন সদস্য সত্যব্রত পাল হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে জানিয়েছেন, পুলিশের অভ্যন্তরীণ তদন্তের উদ্দেশ্য হলো বিষয়টিকে ধামাচাপা দেওয়া।