মামলা ও বাধায় কোনঠাসা বিএনপি

কামরান রেজা চৌধুরী
2018.01.04
ঢাকা
একটি দুর্নীতি মামলায় হাজিরা দিতে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বকশিবাজারের বিশেষ জজ আদালতে উপস্থিত হন। একটি দুর্নীতি মামলায় হাজিরা দিতে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বকশিবাজারের বিশেষ জজ আদালতে উপস্থিত হন। ৪ জানুয়ারি ২০১৮।
মনিরুল আলম/বেনারনিউজ

বাংলাদেশে সর্বশেষ অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে ৩৭ শতাংশ ভোট পাওয়া বিরোধী দল বিএনপি এখন জনসমা‌বেশ কর‌তে গি‌য়ে হিমশিম খাচ্ছে। যদিও আগামী বছরের জানুয়ারি‌তে পরবর্তী সংসদীয় নির্বাচন অনু‌ষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে।

৫ জানুয়ারির আগে সমাবেশের জন্য মাঠ বরাদ্দ নিয়ে বিএনপির সঙ্গে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের দীর্ঘ চার বছর ধরে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব চলছে। অন্যান্য বারের মতো এবারও এই দিনে ঢাকায় সমাবেশ করার অনুমতি পায়নি বিএনপি। এই দিনটিকে ‘গণতন্ত্র হত্যা দিবস’ হিসেবে পালন করে তারা।

তবে একই দিন দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে ঢাকায় শোভাযাত্রা ও সমাবেশ করবে আওয়ামী লীগ।

এদিকে মামলার মাঠেও বিএনপিকে লড়তে হচ্ছে। ১৯৯১ সাল থেকে তিনবার সরকার গঠন করা বিএনপি’র দলীয় প্রধান খালেদা জিয়া দুটি দুর্নীতি মামলায় নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে নিয়মিতভাবে আদালতে হাজিরা দিচ্ছেন। মামলা দুটি চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে।

কম্বোডিয়ার রাজধানী নমপেনে গার্ড অব অনার গ্রহণ করছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ৪ ডিসেম্বর ২০১৭।
কম্বোডিয়ার রাজধানী নমপেনে গার্ড অব অনার গ্রহণ করছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ৪ ডিসেম্বর ২০১৭।

 

সমাবেশের অনুমতি পায়নি বিএনপি

“৫ জানুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচনের প্রতিবাদ জানাতে আমরা সমাবেশের অনুমতি চেয়েছি। কিন্তু পুলিশ এখনো আমাদের অনুমতি দেয়নি। আমাদেরকে জনসমাবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না,” বৃহস্পতিবার বেনারকে বলেন বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য মাহবুবুর রহমান।

তিনি বলেন, “ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ক্ষমতা কুক্ষিগত করেছে এবং ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের মতো একটি একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতায় আসার লক্ষ্যে বিরোধীদলকে কোনঠাসা করছে।”

“আমাদের দলীয় প্রধান খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মামলাগুলো বিএনপিকে ভয় দেখানোর জন্য ব্যবহার করা হয়েছে। আমাদের নেতাদের বেশিরভাগই মিথ্যা মামলার সম্মুখীন,” বলেন মাহবুবুর রহমান।

এদিকে গত ২ জানুয়ারি খালেদা জিয়া ঢাকায় এক মিটিংয়ে বলেন, “আমরা পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চাই। কেউ নির্বাচনে অংশ নেওয়া থেকে আমাদের বাধা দিতে পারবে না।”

প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ সংবিধান অনুযায়ী, ২০১৯ সালের ২৮ শে জানুয়ারির আগের ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন কমিশনকে পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন আয়োজন করতে হবে।

তবে বিএনপির এসব অভিযোগকে অস্বীকার করছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ।

“এটি সম্পূর্ণ অসত্য যে পরবর্তী নির্বাচনে আমরা তাদের অংশগ্রহণ করতে দিতে চাই না। কিন্তু আমরা তাদের নির্বাচনে আনতে কোনো উদ্যোগ নেব না। তারা নির্বাচনে অংশ নেবে কি না তা সম্পূর্ণ তাদের সিদ্ধান্ত,” বেনারকে বলেন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী।

সর্বশেষ সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বলেন, বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে কোনও পদক্ষেপ তিনি নেবেন না। এসময় প্রধানমন্ত্রী বলেন, নির্বাচনে অংশগ্রহণ বা বয়কট করার সিদ্ধান্ত পুরোপুরিই বিএনপির।

এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে বিরোধী দল বিপাকে রয়েছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. আতাউর রহমান বেনারকে বলেন, “ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ দলটি বিরোধী দলকে পুরো কোনঠাসা করে নিজেদেরকে ক্ষমতায় রেখেছে।”

তিনি বলেন, “আমার সহজ পর্যবেক্ষণ হলো- অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ সংসদীয় নির্বাচনে অংশ নেওয়ার জন্য বিরোধী দলের তেমন কোনো পরিবেশ নেই।”

ড. রহমান বলেন, “বিএনপি চায় আওয়ামী লীগ বিরোধী দলের অন্তত একটি বা দুটি দাবি গ্রহণ করুক। বিএনপির দাবি, নির্বাচনের আগে ‘সহায়ক সরকার’ নামে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রবর্তন করা এবং বিদ্যমান সংসদ বিলুপ্ত করা।”

অধ্যাপক রহমান মনে করেন, আওয়ামী লীগ পরবর্তী নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য বিরোধীদলকে কোনও ছাড় দেবে না।

তবে “শেখ হাসিনার নেতৃত্বেও তারা যদি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে, তাহলে আওয়ামী লীগ একটি কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে থাকবে,” বলেন ড. আতাউর রহমান।

এ প্রসঙ্গে রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. নিজাম উদ্দিন আহমেদ বেনারকে বলেন, “বিএনপিকে হয় শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে অংশ নিতে হবে অথবা দূরে থাকতে হবে।”

তাঁর মতে, “বিএনপি বুঝে গেছে সুষ্ঠু নির্বাচনে অংশ নেওয়ার মতো পরিবশে তারা পাবে না। তবে নির্বাচনে অংশ নেওয়া ছাড়া আর কোনো পথ তাদের নেই।”

৫ জানুয়ারিতে দলগুলোর কর্মসূচি

৫ জানুয়ারি ‘গণতন্ত্র হত্যা দিবস’ সামনে রেখে এদিন ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ ও সারা দেশে কালো পতাকা মিছিলের কর্মসূচি দিয়েছে বিএনপি। তবে সমাবেশের অনুমতি না পেয়ে শুক্রবার সকাল ১১টায় নয়াপল্টনে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন ডেকেছে দেশের প্রধান বিরোধী দলটি।

এদিকে আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে দশম সংসদ নির্বাচনের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে আগামী এক সপ্তাহ রাজনীতির মাঠ দখলে রাখার পরিকল্পনা নিয়েছে দলটি। শুক্রবার ঢাকাসহ সারা দেশে ‘গণতন্ত্রের বিজয় দিবস’ শিরোনামে আনন্দ শোভাযাত্রা পালন করবে তারা। আর সপ্তাহজুড়ে থাকছে সভা-সমাবেশসহ নানা কর্মসূচি।

 

বিপাকে বিএনপি

গত ২ জানুয়ারি ছাত্রদলের ৩৯তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে সভা করার জন্য আগে অনুমতি দিয়েও পরে তা বাতিল করে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াসহ দলের অন্য নেতাকর্মীদের সেখানে ঢুকতে বাধা দেওয়ার ঘটনা ঘটে। খালেদা জিয়া ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটের প্রধান ফটকে প্রায় ঘণ্টা খানেক দাঁড়িয়ে থাকার পর কর্তৃপক্ষ গেট খুলে দেয়।

একই দিন কুমিল্লা জেলার একটি আদালত ২০১৫ সালে গাড়িতে অগ্নিসংযোগের মামলায় খালেদা জিয়া ও দলের অন্যান্য ৪৮ নেতাদের বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট অর্ডার জারি করে।

২০০৮ সাল থেকে লন্ডনে নির্বাসিত খালেদার ছেলে এবং বিএনপি'র আপাত উত্তরাধিকারী তারেক রহমানকে মানি লন্ডারিং মামলায় সাত বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টায় ২০০৪ সালের ২১ শে আগস্ট গ্রেনেড হামলার সঙ্গে জড়িত দুটি মামলায়ও তাঁর বিচার চলছে।

গ্রেনেড হামলা মামলাও চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে বলে জানিয়েছেন আইনজীবীরা।

এদিকে দুর্নীতি, অগ্নিসংযোগ ও সহিংসতার ঘটনায় তারেক রহমানের নামে মোট ৭৬টি ও খালেদা জিয়ার নামে ৩৪টি মামলা রয়েছে বলে বেনারকে জানিয়েছেন খালেদা জিয়ার আইনজীবী ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন।

“আওয়ামী লীগ বিএনপিকে চাপে রাখার জন্য খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের বিরুদ্ধে মামলাগুলো ব্যবহার করছে। তারা আমাদেরকে নির্বাচনে অংশ নিতে দিতে চায় না,” বেনারকে বলেন খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা আসাদুজ্জামান রিপন।

“তাই সরকার চায় আমরা আবার নির্বাচন বয়কট করি। আমরা যদি হাসিনা সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নিই, তাহলে তারা কারচুপির মাধ্যমে আবারও ক্ষমতায় আসবে,” বলেন তিনি।

তবে রিপনের এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন জাতীয় সংসদে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের হুইপ ইকবালুর রহিম।

“খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার কর্তৃক দায়ের করা হয়। তারেক রহমানের বিরুদ্ধে মামলাও তত্ত্বাবধায়ক সরকার দায়ের করেছিল। আওয়ামী লীগ কিছুই করেনি,” বলেন তিনি।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।