৫ জানুয়ারি: বিরোধীদের ঠেকিয়ে ক্ষমতাসীনেরা মাঠে
2018.01.05
ঢাকা

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং তার মিত্ররা শুক্রবার নির্বিঘ্নে ৫ জানুয়ারি ‘গণতন্ত্রের বিজয় দিবস’ পালন করলেও পুলিশি বাধা ও লাঠিপেটায় সমাবেশ করতে পারেনি প্রধান বিরোধী দল বিএনপি। ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় পূর্ব নির্ধারিত ‘গণতন্ত্র হত্যা দিবস’র কর্মসূচি পালন করতে পারেনি দলটি।
খুলনা, চট্টগ্রাম, ঢাকার কেরানীগঞ্জ ও বান্দরবানে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়েছে বিএনপি ও এর অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীদের সাথে। খুলনায় গ্রেপ্তার হয়েছেন পাঁচজন, আহতের সংখ্যা কমপক্ষে ১০।
ঢাকায় বিএনপিকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করতে না দিলেও সেখানে সভা করার অনুমতি পেয়েছে বাংলাদেশ ইউনাইটেড ইসলামী পার্টি নামে কম পরিচিত একটি রাজনৈতিক দল। সেখানে বক্তব্য রেখেছেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা।
শুক্রবার নয়াপল্টনে দলীয় অফিসে সাংবাদিক সম্মেলন করে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রুহুল কবির রিজভী অভিযোগ করেন, বরিশাল, গাজীপুর ও ময়মনসিংহে দলীয় নেতা-কর্মীদের আটকে রেখে ‘গণতন্ত্র হত্যা দিবস’ পালন করতে দেয়নি পুলিশ। এর প্রতিবাদে কাল শনিবার ঢাকার সকল থানায় বিক্ষোভ কর্মসূচির ঘোষণা দেন তিনি।
রিজভী বলেন, “গাজীপুর, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন স্থানে দলের কার্যালয়ে তালা ঝুলিয়ে দিয়েছে পুলিশ। সারা ময়মনসিংহ জেলাতে যেন এক অঘোষিত কারফিউ চলছে। ৫ জানুয়ারির কালো দিবসের কর্মসূচিতে বাধা দিতে উন্মুক্ত সন্ত্রাসী দলের ন্যায় আচরণ করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। বিভিন্ন স্থানে চলছে পুলিশের তাণ্ডব।”
রিজভী বলেন, “আজ বিএনপিকে ঢাকায় সমাবেশ করতে বাধা দেওয়াই প্রমাণ করে আওয়ামী লীগ গণতন্ত্র হত্যাকারী দল।”
“বিএনপিকে সমাবেশে করতে বাধা দিয়ে সরকার গণতন্ত্র ও গণতন্ত্রের স্বীকৃত বিরোধী দলের অধিকারের ওপর দুর্বৃত্তমূলক আচরণের বহিঃপ্রকাশ ঘটাল,” বলেন তিনি।
তবে রিজভীর অভিযোগ অস্বীকার করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বেনারকে বলেন, “তাঁদের অভিযোগ একেবারে ঠিক নয়। এগুলো তাঁদের রাজনৈতিক বক্তব্য।”
তবে সরকারের এ আচরণ অগণতান্ত্রিক বলছেন রাজনীতি বিশ্লেষকেরা।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বেনারকে বলেন, “ক্ষমতাসীনরা রাজনৈতিক সভা করতে পারবে অথচ বিরোধী দলকে করতে দেওয়া হবে না, এটা গণতন্ত্রের ভাষা নয়।”
শুভ বুদ্ধির উদয়ের মাধ্যমে সরকার বিরোধী দলকে সম্মান দেখাবে আশাবাদ ব্যক্ত করে তিনি বলেন, “আরেকটি নির্বাচন যদি একতরফাভাবে অনুষ্ঠিত হয় তাহলে আমরা খাদে পড়ে যাব আর সেখান থেকে বেরিয়ে আসা খুব কঠিন হবে।”
প্রসঙ্গত, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেয়নি। তাই আওয়ামী লীগ টানা দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতায় আসে। বিএনপি দিনটিকে ‘গণতন্ত্র হত্যার কালো দিবস’ আখ্যায়িত করে। আর আওয়ামী লীগ দিনটিকে পালন করে ‘গণতন্ত্রের বিজয় দিবস’ হিসেবে।
সোহরাওয়ার্দীতে সরকার সমর্থকদের সমাবেশ
শুক্রবার বিএনপি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করার জন্য ঢাকা মহানগর পুলিশের কাছে আবেদন করে। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সভা করার আবেদন করে। কিন্তু নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে কাউকেই সেই অনুমতি দেয়া হয়নি।
ঢাকায় বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে ও আশে-পাশে বিপুলসংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করা হয়। প্রস্তত রাখা হয় জল-কামান।
এদিকে সেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেই শুক্রবার সমাবেশ করেছে বাংলাদেশ ইউনাইটেড ইসলামী পার্টি। সেখানে বক্তব্য রাখেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহাবুব-উল হানিফ।
বক্তৃতায় হানিফ বলেন, “নির্বাচনে আসা না আসা একটি দলের গণতান্ত্রিক অধিকার। আগামী নির্বাচন সঠিক সময়ে সংবিধান অনুযায়ী হবে। সে নির্বাচনে কে আসল না আসল তা বিবেচ্য বিষয় নয়।”
ইউনাইটেড ইসলামী পার্টির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান মো. ইসমাইল হোসাইনের সভাপতিত্বে সমাবেশে আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক হাছান মাহমুদও বক্তব্য রাখেন।
বিএনপিকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করতে না দেওয়া প্রসঙ্গে হাছান মাহমুদ বেনারকে বলেন, “ইউনাইটেড ইসলামিক পার্টি বিএনপির এক মাস আগে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশের অনুমতি চায়। পুলিশ তাঁদের অনুমতি দিয়েছে।”
‘নির্বাচনী ট্রেন বিএনপির স্টেশনে থামবে না’
শুক্রবার বিকেলে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কার্যালয়ের সামনে ‘গণতন্ত্রের বিজয় দিবস’ উপলক্ষে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের জনসভায় বক্তব্য দেন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।
তিনি বলেন, “সময় ও স্রোত কারও জন্য অপেক্ষা করে না। আগামী সংসদ নির্বাচনও কারও জন্য অপেক্ষা করবে না। নির্বাচনী ট্রেন বিএনপির স্টেশনে থামবে না।”
“বিএনপি নির্বাচনে অংশ না নিলে তাদের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয়ে যাবে। বিরল প্রাণীর মতো বিলুপ্ত হয়ে যাবে বিএনপি। পৃথিবীতে অনেক রাজনৈতিক দল বিলুপ্ত হয়ে গেছে। তাদের অবস্থা মুসলিম লীগের চেয়েও খারাপ হয়ে যাবে,” বলে তিনি।
পুলিশি বাধা-সংঘর্ষ
গণতন্ত্র হত্যা দিবস পালন করতে গিয়ে ঢাকার বাইরে খুলনা, নারায়ণগঞ্জ, বান্দরবান ও দক্ষিণ কেরানীগঞ্জে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে হয় বিএনপির নেতা-কর্মীদের। দেশের অন্তত ২০টি স্থানে পুলিশ বিএনপিকে বাধা দিয়েছে।
খুলনায় মিছিলে বাধা দেওয়ায় বিএনপির কর্মীরা পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ান। এ ঘটনায় পুলিশের লাঠিপেটায় কমপক্ষে ১৪ জন নেতা-কর্মী আহত হয়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও খুলনা মহানগর বিএনপি সভাপতি নজরুল ইসলাম মঞ্জু। পুলিশ পাঁচজনকে আটক করে বলেও জানান তিনি।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, বিএনপির ‘গণতন্ত্রের কালো দিবস’ পালন উপলক্ষে শনিবার বেলা সোয়া ১১টার দিকে নগরের বিএনপি কার্যালয় চত্বরের আয়োজিত কালো পতাকা মিছিল ও সমাবেশ শুরুর আগে ওই সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।
খুলনা সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এমএম মিজানুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, “পিকচার প্যালেসের দিক থেকে থানা মোড়ের দিকে মিছিল নিয়ে আসার সময় বিএনপির নেতা কর্মীরা উচ্ছৃঙ্খল আচরণ করতে থাকে। পুলিশ নিষেধ করা সত্ত্বেও তারা শোনেনি। এরপর আমরা লাঠিপেটা করেছি। সেখান থেকে ৫ জনকে আটক করা হয়েছে।”
খুলনা মহানগর সভাপতি নজরুল ইসলাম মঞ্জু বেনারকে বলেন, “পুলিশ বিনা উসকানিতে আমাদের নেতা-কর্মীদের ওপর আক্রমণ করে ১৪জনকে আহত করেছে। আমরা এই আচরণের তীব্র নিন্দা জানাই।”
ঢাকার বাইরে নারায়ণগঞ্জ ও দক্ষিণ কেরানীগঞ্জে বিএনপির কালো পতাকা মিছিল ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশের লাঠিপেটার অভিযোগ পাওয়া গেছে। নারায়ণগঞ্জে চাষাঢ়া বালুর মাঠ এলাকায় সংক্ষিপ্ত সমাবেশের পর প্রেসক্লাবের সামনে মিছিল বের করলে লাঠিপেটায় পাঁচজন আহত হয়।
কেরানীগঞ্জে মিছিল ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশের লাঠিপেটা ও কাঁদানে গ্যাসে ২৫ জন নেতা-কর্মী আহত হয়। মিছিলকারীদের সঙ্গে পুলিশের পাল্টাপাল্টি ধাওয়াও হয়। এ সময় পুলিশ কয়েক রাউন্ড ফাঁকা গুলি ছোড়ে এবং ছয়জন নেতা-কর্মীকে আটক করে।
চট্টগ্রামের বান্দরবানের বিএনপির এক অংশ (ম্যামাচিং) সমাবেশ করতে জড়ো হলে লাঠিপেটা করে নেতা-কর্মীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয় পুলিশ। এ সময় ছাত্রদলের জেলা সভাপতিসহ তিনজনকে আটক করা হয়। বিকেলে অপরপক্ষ (সাচিংপ্রু) দলীয় কার্যালয় থেকে মিছিল করতে চাইলে সেখানেও পুলিশ বাধা দেয়।
তবে চট্টগ্রামে কালো পতাকা হাতে না রাখার শর্তে পুলিশ মিছিলের অনুমতি দেয়। বিকেলে চট্টগ্রামে কাজীর দেউরি থেকে কয়েক হাজার নেতা-কর্মীর মিছিল নিয়ে দলীয় কার্যালয় ভবন চত্বরে সমাবেশ করে।
এর বাইরে যশোর ও লালমনিরহাটে কালো পতাকা মিছিল ও সমাবেশ শান্তিপূর্ণভাবে হয়েছে।
ড. বদিউল আলম মজুমদারের মতে, “গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দলের সমান রাজনৈতিক অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। নির্বাচন যত কাছে আসছে সরকার ততই বিরোধী দলের ব্যাপারে কঠোর হচ্ছে। মনে রাখতে হবে যে, বেশি টাইট দিলে প্যাঁচ কেটে যায়। প্যাঁচ কেটে গেলে তখন কী হবে সে ব্যাপারে সরকারকে চিন্তা করতে হবে।”