হেফাজত প্রধানের নারী-বিদ্বেষী বক্তব্যে সমালোচনার ঝড়
2019.01.16
ঢাকা

নারী শিক্ষা এবং পর্দা করা সম্পর্কে হেফাজতে ইসলামের প্রধান আহমদ শফীর বিতর্কিত মন্তব্য নিয়ে দেশজুড়ে সমালোচনা হচ্ছে। নারী শিক্ষা নিয়ে এক সপ্তাহে দুবার দেওয়া তাঁর বক্তব্য রাষ্ট্র, সমাজ ও সংবিধান বিরোধী বলে মন্তব্য করেছেন দেশের মানবাধিকার সংগঠন, রাজনৈতিক দল ও নারী সংগঠনের নেতারা।
হেফাজত প্রধানের বক্তব্য দেশকে পশ্চাদমুখী করবে—এমন আশঙ্কা প্রকাশ করে তাঁরা বলেছেন, যেখানে বাংলাদেশ নারী ক্ষমতায়নের দিক থেকে দক্ষিণ এশিয়াসহ বিশ্বে অন্যতম দেশ, সেখানে তাঁর এই বক্তব্য দেশকে পেছনে টেনে নেওয়ার ষড়যন্ত্র।
আহমদ শফীর বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও তার শরিক দলগুলো, যারা গত কয়েক বছর হলো হেফাজতকে কিছুটা সমীহ করে চলছে। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক থেকে শুরু করে সরকারের মন্ত্রীদের অনেকেই প্রকাশ্যে হেফাজত প্রধানের বক্তব্যের সমালোচনা করেছেন।
আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী ফারুক খান বেনারকে বলেন, “বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ নারীর ক্ষমতায়নকে উৎসাহিত করে। আমাদের নেত্রী শেখ হাসিনা কখনোই নারীর ক্ষমতায়নের ব্যাপারে আপস করবেন না। হেফাজত আমিরের উচিৎ ভবিষ্যতে এ ধরনের বক্তব্য দেওয়া থেকে বিরত থাকা।”
আহমদ শফী গত ১২ জানুয়ারি চট্টগ্রামের হাটহাজারি মাঠে দারুল উলুম ময়নুল ইসলাম মাদ্রাসার বার্ষিক সভায় মুসল্লিদের এই বলে শপথ করান যে, তাঁরা তাঁদের মেয়েদের চতুর্থ-পঞ্চম শ্রেণির বেশি পড়াশোনা করাবেন না। কারণ, এর বেশি লেখাপড়া করালে তারা অবাধ্য হবে।
এই খবর সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হলে সমালোচনার ঝড় ওঠে। সবাই তাঁর বক্তব্য প্রত্যাহারের দাবি জানায়। ক্ষমা চাওয়ার আহ্বান জানায়। কিন্তু তিনি তা প্রত্যাহার করেননি।
তবে আহমদ শফীর কার্যালয় থেকে তাঁর বক্তব্যের ব্যাখ্যায় বলা হয়, “দেশের বেশির ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সহশিক্ষা দেওয়া হয়। অর্থাৎ ছেলে-মেয়ে এক সাথে শিক্ষা গ্রহণ করে থাকে। এতে পর্দার লঙ্ঘন হয়। হেফাজত প্রধান মূলত এই সহশিক্ষা গ্রহণের বিষয়ে মানুষকে সতর্ক করতে চেয়েছেন।”
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শিক্ষা উপদেষ্টা রাশেদা কে. চৌধুরী বেনারকে বলেন, “হেফাজত প্রধানের নারী বিরোধী বক্তব্য সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক। এটি কোনো কাণ্ডজ্ঞান সম্পন্ন মানুষ গ্রহণ করতে পারে না। আমরা ঘৃণাভরে এই বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করি।”
তিনি বলেন, “বাংলাদেশের আজকের উন্নতির একটি বড় কারণ নারীর ক্ষমতায়ন। বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়াসহ বিশ্বে নারীর ক্ষমতায়নে একটি অন্যতম উদাহরণ।”
বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে মোট প্রাথমিক শিক্ষার্থীর প্রায় ৫১ ভাগই মেয়ে। মাধ্যমিক পর্যায়ে ৫৪ ভাগের বেশি ও উচ্চ মাধ্যমিকে ৪৮ শতাংশের বেশি মেয়ে।
সরকার স্বীকৃত মাদ্রাসাগুলোতেও নারী শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৫৫ দশমিক পাঁচ ভাগ। সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট শিক্ষার্থীর মধ্যে প্রায় ৩৩ ভাগ নারী।
ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে লিঙ্গ সমতার সূচকে বাংলাদেশ সবচেয়ে ওপরে।
সম্মিলিত গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের প্রধান নাজমা আক্তার বেনারকে বলেন, “আহমদ শফী ইসলামের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে নারীদের অগ্রগতির পথ রুদ্ধ করতে চান।”
তিনি বলেন, “ইসলাম ধর্মের কোথাও নারী শিক্ষার বিরুদ্ধে কিছু নাই। আমাদের দেশের গার্মেন্টস নারীরাই রক্ষা করছে।”
নাজমা বলেন, “এর আগেও উনি আমাদের গার্মেন্টস শ্রমিকদের সম্পর্কে বাজে মন্তব্য করেছিলেন। উনার কথাকে পাত্তা দিয়ে তাঁকে বিখ্যাত করার কোনো দরকার নাই।”
বাংলাদেশের মোট রপ্তানি আয়ের ৮১ শতাংশ যে শিল্প থেকে আসে সেই তৈরি পোশাক খাতের বেশির ভাগই নারী।
আহমদ শফীর বক্তব্যকে “দেশের সংবিধান বিরোধী” এবং “তারা আমাদের নারীদের চার দেয়ালের মধ্যে ঠেলে দিতে চায়,” বলে মন্তব্য করেন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটের শরিক ওয়ার্কার্স পার্টির প্রধান রাশেদ খান মেনন।
তিনি বেনারকে বলেন, “হেফাজত সংগঠন হিসাবে কট্টর। এরা দেশকে, দেশের নারী সমাজকে পিছিয়ে নিতে চায়। এদের সাথে কোনো রাজনৈতিক যোগাযোগ আমাদের নেই। আমরা বরাবর এই সংগঠনের ব্যাপারে সবাইকে সতর্ক থাকতে বলেছি।”
সংসদে বিরোধীদল জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী মুজিবুল হক বেনারকে বলেন, “বাংলাদেশ এমন একটি দেশ যেখানে নারীরা ক্রমেই এগিয়ে যাচ্ছে।"
তিনি বলেন, “বাংলাদেশ যে মধ্যম আয়ের দেশ হতে চলেছে এই অবদানের জন্য নারীদের রয়েছে বিশেষ অবদান। নারীরা ছাড়া এই অর্জন সম্ভব হতো না।”
আদর্শিকভাবে হেফাজত-ই-ইসলাম বিরোধী দল বিএনপির মূল রাজনৈতিক মিত্র বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী বিরোধী।
তবে ২০১৩ সালের ৫ মে বাংলাদেশে শরিয়া আইন বাস্তবায়ন ও নারী-পুরুষের ‘অবাধ মেলামেশা’ বন্ধের দাবিতে সারা দেশ থেকে হাজার হাজার মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষক ঢাকার বাণিজ্যিক কেন্দ্র মতিঝিলে সমবেত হয়ে তাণ্ডব চালায়। তারা বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির কার্যালয় বঙ্গভবন ঘেরাও করার ঘোষণা দেয়।
শেখ হাসিনার সরকারের আইন শৃঙ্খলা বাহিনী অভিযান চালিয়ে সেখান থেকে তাদের সরিয়ে দেয়। তবে কয়েক বছরের মধ্যেই আওয়ামী লীগের সাথে হেফাজতের সম্পর্কের উন্নতি ঘটে।
গত ৩০ ডিসেম্বরের জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও হেফাজত আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করেনি। কওমি মাদ্রাসার সনদের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেওয়ার পর নির্বাচনের আগে ৪ নভেম্বর ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সংবর্ধনা দেয় আহমেদ শফীর নেতৃত্বাধীন হেফাজতে ইসলাম। ওই অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনাকে ‘কওমি জননী’ উপাধি দেওয়া হয়। এ নিয়ে সরকার সমালোচনার মুখে পড়ে।
তবে “আওয়ামী লীগের সাথে হেফাজতে ইসলামের কোনো সম্পর্ক নেই,” বলে মন্তব্য করেন দলটির প্রেসিডিয়াম সদস্য ফারুক খান।