তিনবারের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে রায় ঘিরে উৎকণ্ঠা
2018.02.07
ঢাকা

রাজনীতি ও আসন্ন জাতীয় নির্বাচন থেকে দূরে রাখার জন্য ক্ষমতাসীনরা আদালতকে ব্যবহার করে ‘সাজানো রায়’ দেওয়ার পাঁয়তারা করছে বলে দাবি করেছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। আর এ কারণেই মামলায় ন্যায়বিচার পাওয়া নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন তিনি।
“আমাকে রাজনীতি ও নির্বাচনের ময়দান থেকে দূরে রাখতে আদালতকে ব্যবহার করা হচ্ছে,” বলেন খালেদা জিয়া।
বহুল আলোচিত ও রাজনৈতিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার রায় ঘোষণার আগের দিন বুধবার রাজধানীর গুলশানে নিজের রাজনৈতিক কার্যালয়ে দলীয় সংবাদ সম্মেলনে এসে এ দাবি করেন খালেদা।
২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় দুর্নীতি দমন কমিশনের দায়ের করা দুই কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার ৬৭১ টাকা আত্মসাতের এ মামলার আসামি সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী, তাঁর ছেলে তারেক রহমানসহ ছয়জন।
এই তহবিলে কোনো দুর্নীতি হয়নি দাবি করে ন্যায় বিচার হলে নিজে বেকসুর খালাস পাবেন বলেই মনে করেন তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া।
তবে এ রায়ের সঙ্গে সরকারের কোনো সম্পৃক্ততা নেই জানিয়ে বিএনপি চেয়ারপারসনের অভিযোগকে অস্বীকার করেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ।
খালেদা জিয়ার বক্তব্যের পরপরই সন্ধ্যায় আওয়ামী লীগের ধানমন্ডি কার্যালয়ে প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে এ মন্তব্য করেন দলটির সাধারণ সম্পাদক ও ওবায়দুল কাদের।
অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে দেশ
দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) এবং দণ্ডবিধির ৪০৯ ও ১০৯ ধারায় করা এই মামলা দোষী প্রমাণিত হলে আসামিদের সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হতে পারে। তবে নিম্ন আদালতে যে রায়ই হোক, তার বিরুদ্ধে উচ্চতর আদালতে আপিলের সুযোগ রয়েছে উভয় পক্ষের।
এদিকে বৃহস্পতিবার রায় ঘোষণাকে কেন্দ্র করে যাতে কোনো ধরনের অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি না হয় সে ব্যাপারে সতর্ক অবস্থায় রয়েছে আইনশৃঙ্খলা-রক্ষাকারী বাহিনী। এদিন সারা দেশে নিরাপত্তাবলয় তৈরির পাশাপাশি রাজধানীসহ বিভিন্ন বিভাগীয় ও জেলা শহরে বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে।
“ঢাকাসহ সারা দেশের ২৭ টি জেলায় ৬৯ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকায় ২০ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন রয়েছে,” বেনারকে জানান বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) জনসংযোগ কর্মকর্তা মহসীন রেজা।
গতকাল থেকেই নগরীর বিভিন্ন স্থানে পুলিশের চেকপোস্ট বসিয়ে পথচারীদের ওপর কড়া নজরদারি চালানো হচ্ছে। অব্যাহত রয়েছে বিরোধী দলীয় নেতা-কর্মীদের ধরপাকড়।
পুলিশের হিসেব অনুযায়ী গতকাল রাজধানীতে গ্রেপ্তার হয়েছেন ২৩৩ জন। আর ঢাকার বাইরে ৩৭ জেলায় গ্রেপ্তার হয়েছে ৯৭৯ জন। সব মিলে গতকাল একদিনে সারাদেশ গ্রেপ্তারের সংখ্যা ১২শ ছাড়িয়ে গেছে। এই ধরপাকড় শুরুর পর থেকে গত নয় দিনে বিএনপির আড়াই হাজারেরও বেশি নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হলো।
গত ৩০ জানুয়ারি হাইকোর্ট এলাকায় প্রিজন ভ্যানে হামলার পর থেকে দেশব্যাপী ধরপাকড় শুরু করে পুলিশ। আটকের পর বিএনপি নেতা-কর্মীকে পুরনো জ্বালাও-পোড়াও মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হচ্ছে।
জনগণের নিরাপত্তা ও রায়ের প্রতিক্রিয়ায় বিএনপির সম্ভাব্য নৈরাজ্য ঠেকাতে ব্যাপক প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
“২০১৩-১৪ সালে যেসব সহিংস ঘটনা ঘটেছে, সেসব মাথায় রেখেই নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। বিগতদিনে যারা জড়িত ছিল, তাঁদের বাড়িঘর তল্লাশি, সন্দেহভাজনদের জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। এসবই জননিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে,” বেনারকে বলেন রাজশাহী নগর পুলিশের উপকমিশনার আবু জাফর।
তবে রায়কে ঘিরে কোনো কর্মসূচি রাখেনি বিএনপি। বরং সংবাদ সম্মেলনে এসে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের পরামর্শ দিয়েছেন খালেদা। আওয়ামী লীগ অবশ্য বিএনপির নৈরাজ্য সৃষ্টির আশঙ্কায় রাজপথে থেকে আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সহায়তা করতে নেতা-কর্মীদের নির্দেশনা দিয়েছে।
তবে এই পরিস্থিতি চলমান থাকলে দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতার পাশাপাশি সামাজিক, অর্থনৈতিক পরিস্থিতিও নড়বড়ে হবে বলে মনে করেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী দিলারা চৌধুরী।
এদিকে “পুরো বিষয়টি নিয়ে দু’পক্ষই বাড়াবাড়ি করছে” বলে মনে করেন মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান।
শঙ্কায় পুরো দেশ
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বাড়তি নজরদারির মধ্যেই বুধবার দুপুরের পর থেকে গণপরিবহন এবং দূরপাল্লার যানবাহন এমনকি ব্যক্তিগত যান চলাচলেও অস্বাভাবিকতা দেখা দেয়। এতে করে দারুণ এক শঙ্কায় রয়েছে পুরো দেশ। বিশেষ করে বৃহস্পতিবারেও এসএসসি পরীক্ষা থাকায় প্রায় ২০ লাখ পরীক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকেরা অজানা আশঙ্কায় ভুগছেন।
আতিয়ার রহমান নামে একজন অভিভাবক বেনারকে বলেন, “মেয়ের এসএসসি পরীক্ষা চলছে। কালও পরীক্ষা রয়েছে। অথচ বুধবার থেকে রাস্তাঘাটের যে অবস্থা দেখছি, আর বাইরের যে পরিবেশ তাতে সন্তানকে নিয়ে বের হওয়ার সাহসই পাচ্ছি না। কারণ, ভয়ংকর রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে আমরা জানি।”
এদিকে বৃহস্পতিবার সকাল থেকে ঢাকার মিরপুর শেরে বাংলা স্টেডিয়ামে বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার মধ্যকার দ্বিতীয় স্টেট ম্যাচও শুরু হচ্ছে।
কোনো দুর্নীতি করিনি: খালেদা
ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে তাঁকে ফাঁসাতে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে বলে সংবাদ সম্মেলনে দাবি করেন খালেদা জিয়া।
নিজেকে নির্দোষ দাবি করে বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, “কোনো দুর্নীতি আমি করিনি। ন্যায়বিচার হলে আমি বেকসুর খালাস পাব।”
যে কোনো পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত জানিয়ে খালেদা বলেন, “জেল বা সাজার ভয় দেখিয়ে কাজ হবে না। আমি মাথা নত করব না।”
এই রায়কে কেন্দ্র করে মিছিল, সমাবেশ বন্ধ করার সমালোচনা করে তিনি বলেন, “এই অবৈধ সরকার জনগণের প্রতিবাদের ভয়ে ভীত হয়ে হীন পথ খুঁজে নিয়েছে। তারা সারা দেশে বিভীষিকা ও ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে।”
দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে নিয়ে আসা এ সংবাদ সম্মেলন থেকে সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য আলোচনায় বসতে সরকারকে আবারও আহ্বান জানান খালেদা।
এদিকে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, “খালেদা জিয়া বেকসুর খালাস পেলে আওয়ামী লীগের কোনো অসুবিধা নেই। সেখানে বড় দল হিসেবে বিএনপিও নির্বাচনে অংশগ্রহণ করুক সেটা আমরা চাই।”
মামলা সম্পর্কে তিনি বলেন, “এটা দুর্নীতির বিষয়। আদালতে দুর্নীতির অপরাধের বিচার হবে। অথচ বিএনপি আইন-আদালতের বিষয়কেও নোংরা রাজনীতির খেলায় নিয়ে এসেছে।”
রায় ঘোষণার সময় খালেদা জিয়া আদালতে উপস্থিত থাকবেন।
‘নাশকতা করলে ছাড় নয়’
এদিকে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মামলার রায়কে ঘিরে কেউ সহিংসতা করলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানিয়েছেন ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার (ডিএমপি) আছাদুজ্জামান মিয়া। বুধবার দুপুরে এক ব্রিফিংয়ে এক বিন্দু ছাড় দেওয়া হবে না বলে হুশিয়ারি দেন তিনি।
“যান চলাচলে বাধা না দিয়ে ও জনগণের ভোগান্তি না সৃষ্টি করে গণতান্ত্রিক কর্মসূচি ও রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করলে বাধা দেওয়া হবে না। তবে কেউ যদি সহিংসতা করে, কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে,” বলেন তিনি।
এর আগে মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে ৮ ফেব্রুয়ারি ভোররাত চারটা থেকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত মিছিল, জমায়েত এবং ছুরি-লাঠির মতো অস্ত্র বহন নিষিদ্ধ করে এক বিবৃতি দেয় ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)।
তবে এ রায়কে ঘিরে উদ্বেগের কিছু নেই বলে দেশবাসীকে আশ্বস্ত করেছেন পুলিশ প্রধান মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী। বুধবার এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, জননিরাপত্তা নিশ্চিত করার স্বার্থে ইতিমধ্যে দেশব্যাপী সর্বাত্মক প্রচেষ্টা গ্রহণ করেছে পুলিশ। আগামীকাল দেশের আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক ও নিয়ন্ত্রণাধীন থাকবে বলে আশা করি।”