খালেদার আইনজীবী লর্ড কার্লাইলের ভারত সফর বাতিল, বাংলাদেশে বিতর্ক
2018.07.12
ঢাকা
বাংলাদেশে বিরোধী দল বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার আইনজীবী আলেক্স কার্লাইলের ভারত সফরকে কেন্দ্র করে দুই দেশের রাজনীতি সরগরম হয়ে উঠেছে। গত বুধবার রাতে ভারতে নামার পর তাঁকে পরের বিমানেই লন্ডন ফিরে যেতে হয়।
সাবেক ব্রিটিশ সাংসদ ও খ্যাতিমান আইনজীবী কার্লাইল ভারতে গিয়ে বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থা ও রাজনীতির বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরার উদ্যোগ নেন। তাঁর মূল লক্ষ্য ছিল, খালেদা জিয়াকে কীভাবে ‘সাজানো মামলায়’ ফাঁসানো হচ্ছে ও রাজনৈতিক কারণে হেনস্তা করা হচ্ছে তা তুলে ধরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ড. শান্তনু মজুমদার বলেন, “লর্ড কার্লাইলকে প্রবেশ করতে না দিয়ে ভারত এই মেসেজ দিয়েছে যে তারা বাংলাদেশে সরকারের সঙ্গেই আছে। বিএনপিকে কোনো ছাড় দেবে না।”
দুর্নীতির একটি মামলায় বেগম খালেদা জিয়া এখন জেলে রয়েছেন। এর আগে কার্লাইলকে বাংলাদেশে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। সরাসরি নাকচ না করা হলেও তাঁর ভিসা আবেদন ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে বলে জানান কার্লাইল।
বৃহস্পতিবার দুপুরে লন্ডন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে সংবাদ সম্মেলন করে কার্লাইল তাঁর বক্তব্য তুলে ধরেন। কার্লাইল জানান, তাঁকে কেন্দ্র করে যে ঘটনা ঘটল, তা নিয়েও তিনি শিগগিরই লন্ডনে সংবাদ সম্মেলন করবেন।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক চাপের মুখে ভারত নতি স্বীকার করেছে বলে বৃহস্পতিবার জানান কার্লাইল। তিনি এও বলেন, ভারতের গণতন্ত্রের প্রতি তাঁর যাবতীয় শ্রদ্ধা শেষ হয়ে গেছে। ভারতের লজ্জিত হওয়া উচিত বলে জানান তিনি।
‘বিভেদ সৃষ্টির’ অভিযোগ
কার্লাইল ভারত ও বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে ‘বিভেদ সৃষ্টির’ উদ্দেশ্য নিয়ে ভারতে আসতে চেয়েছিলেন বলে মনে করেন ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রবীশ কুমার। ঢাকা ও দিল্লীর বিভিন্ন গণমাধ্যমে এই খবর প্রকাশ হয়।
বৃহস্পতিবার দিল্লীতে সাপ্তাহিক প্রেস ব্রিফিংয়ে রবীশ বলেছেন, সফরের প্রকৃত উদ্দেশ্য গোপন রেখে কার্লাইল ভারতে আসতে চেয়েছিলেন। তাই তিনি দুই দেশের মধ্যে ভুল-বোঝাবুঝির সৃষ্টি করতে চাইছেন এমনটি মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে।
রবীশ কুমার আরও বলেন, এই ধরনের কাজের জন্য যে ধরনের ভিসা নেওয়ার প্রয়োজন, কার্লাইল তা নেননি। তিনি ‘বিজনেস ভিসা’ নিয়ে এখানে এসে যা করতে চেয়েছিলেন, তা আর যাই হোক ব্যবসাসংক্রান্ত নয়।
প্রথমে দিল্লির ফরেন করেসপন্ডেন্টস ক্লাবের (এফসিসি) সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন কার্লাইল। কথা ছিল ক্লাবের অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করবেন কার্লাইল। পরে ক্লাব অনুষ্ঠান বাতিল করে। এরপর কার্লাইল ঠিক করেন, রাজধানীর এক পাঁচতারা হোটেলে সংবাদ সম্মেলন করবেন। কিন্তু গত রাতে দিল্লি নামার সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে জানানো হয়, তাঁর ভিসা বাতিল করা হয়েছে।
বাংলাদেশ সরকারের একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে, কার্লাইল যাতে ভারতের মাটিতে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের বিরুদ্ধাচরণ করতে না পারেন, সে জন্য বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। রবীশ কুমারের বক্তব্যে সেই আভাস পাওয়া যায়। বৃহস্পতিবার রবীশ বলেন, কার্লাইলের উদ্দেশ্যই ছিল ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্কে চিড় ধরানো।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পলিটিক্যাল সায়েন্স বিভাগের শিক্ষক ড. শান্তনু মজুমদার বেনারকে বলেন, “দেখুন দিল্লি গিয়ে প্রেস কনফারেন্স করার সিদ্ধান্তটি লর্ড কার্লাইলের নয়। এটি আসলে বিএনপি’র সিদ্ধান্ত। তাঁকে দিল্লি পাঠিয়ে বিএনপি আসলে বুঝতে চেয়েছে যে, তাদের ব্যাপারে ভারতের অবস্থান কী। কারণ বিএনপি গত কয়েক বছর ধরে ভারতের সাথে তাদের সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা চালাচ্ছে।”
তিনি বলেন, “মূলত ভারত বিরোধীরাই বিএনপি’র ভোটার। কিন্তু তারা বুঝে গেছে যে আগামী ভোটে ক্ষমতায় আসতে হলে ভারতের সমর্থন প্রয়োজন। বিএনপি চায় ভারত তাদের সমর্থন না করলেও তারা যেন আওয়ামী লীগকে সমর্থন না করে, নিরপেক্ষ থাকে।”
বিস্মিত বিএনপি
খালেদা জিয়ার ব্রিটিশ আইনজীবী লর্ড কার্লাইলকে দিল্লি বিমানবন্দর থেকে ফিরিয়ে দেওয়ার ঘটনায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
বৃহস্পতিবার গণমাধ্যমে পাঠানো বিবৃতিতে মির্জা ফখরুল বলেন, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য অন্যায়ভাবে খালেদা জিয়াকে কারারুদ্ধ করে সরকার এ দেশে গণতন্ত্র অনুশীলনে বাধা সৃষ্টি করছে। এটা তুলে ধরার জন্য বিশ্বখ্যাত আইনজীবী লর্ড কার্লাইল দিল্লিতে সংবাদ সম্মেলন করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ ভারতে মুক্তচিন্তা অনুশীলনের অবস্থা দেখে তিনি হতাশ হয়েছেন।
মির্জা ফখরুল বলেন, বাংলাদেশ সরকার ভিসা না দেওয়ার কারণেই লর্ড কার্লাইল ভারতে যেতে চেয়েছিলেন। তাঁকে ভারতে প্রবেশ করতে না দেওয়ায় তিনি মর্মাহত।
খালেদার আপিলের ওপর শুনানি শুরু
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় সাজার রায়ের বিরুদ্ধে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার করা আপিলের ওপর হাইকোর্টে শুনানি শুরু হয়েছে। ওই মামলায় বিচারিক আদালতের রায়ের পাঁচ মাসের মাথায় গতকাল বৃহস্পতিবার এই শুনানি শুরু হলো। এ দিন খালেদা জিয়ার জামিনের মেয়াদ ১৯ জুলাই পর্যন্ত বৃদ্ধি করেছেন আদালত।
বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহিমের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ গতকাল আপিলের ওপর প্রথম দিনের মতো শুনানি নিয়ে আগামী রোববার শুনানির পরবর্তী দিন রেখেছেন।
বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে আদালতের কার্যক্রম শুরু হলে খালেদার আইনজীবী এ জে মোহাম্মদ আলী পেপারবুকে (মামলার বৃত্তান্ত) গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ও প্রয়োজনীয় কিছু কাগজপত্র নেই উল্লেখ করে এসব সরবরাহের জন্য আবেদন দেন। তখন আদালত বলেন, “পরবর্তী দিন আবেদনটি তালিকায় আসবে, আমরা শুনব।”
খালেদার পক্ষে আইনজীবী এ জে মোহাম্মদ আলী ও আবদুর রেজাক খান শুনানিতে অংশ নেন।
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় গত ৮ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ডাদেশ দিয়ে রায় দেন বিচারিক আদালত। এরপর থেকে নাজিমুদ্দিন রোডের পুরোনো কেন্দ্রীয় কারাগারে আছেন তিনি। এই সাজার রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে জামিন আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ১২ মার্চ হাইকোর্ট থেকে জামিন পান তিনি।
প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন জেসমিন পাপড়ি