যুদ্ধাপরাধীকে ‘শহীদ’ লেখা সংগ্রাম পত্রিকার সম্পাদকের জামিন নামঞ্জুর
2019.12.18
ঢাকা

‘যুদ্ধাপরাধী’ জামায়াত নেতা কাদের মোল্লাকে ‘শহীদ’ আখ্যা দিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশের মাধ্যমে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে অভিযুক্ত সংগ্রাম পত্রিকার সম্পাদক আবুল আসাদের জামিন নামঞ্জুর করে তাঁকে কারাগারে পাঠিয়ে দিয়েছে ঢাকার একটি আদালত।
বুধবার তাঁর জামিন শুনানি শেষে ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টের ১১ নম্বর আদালতের বিচারক বাকী বিল্লাহ এই আদেশ দিয়ে বলেন, সংগ্রাম পত্রিকার সম্পাদক আবুল আসাদসহ অভিযুক্ত আরও ছয়জনের বিরুদ্ধে মামলা চলবে।
গত ১২ ডিসেম্বর জামায়াত নেতা আব্দুল কাদের মোল্লার ফাঁসি দিবসে তাকে ‘শহীদ’ উল্লেখ করে প্রতিবেদন প্রকাশ করায় কিছু ব্যক্তি পরদিন সংগ্রাম অফিসে ঢুকে ভাঙচুর চালায়।
এরপর ১৪ ডিসেম্বর মো. আফজাল নামের একজন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার সংগ্রাম সম্পাদকসহ মোট সাত/আটজনের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা করেন।
পরে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। আদালত তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে। রিমান্ড শেষে বুধবার জামিন বিষয়ে আদালতে শুনানি শেষে তাঁকে জেলে পাঠানো হয়।
নিউ ইয়র্ক ভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংগঠন কমিটি-টু-প্রটেক্ট জার্নালিস্ট আবুল আসাদের মুক্তি দাবি করেছে। একই সাথে সংগ্রাম সংবাদপত্রটির কাজ চালিয়ে যাবার সুযোগ দাবি করেছে সংগঠনটি।
আসামিপক্ষের আইনজীবী শিশির মনির বেনারকে বলেন, “আইন লঙ্ঘন করে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে এই মামলা করা হয়েছে। সংগ্রাম সম্পাদকের বিরুদ্ধে দায়ের করা এই মামলা কোনোভাবেই চলতে পারে না।”
তিনি বলেন, বাদী মো. আফজালসহ অন্যান্য ব্যক্তিরা সংগ্রাম অফিসে ঢুকে ভাঙচুর করেছেন। সম্পাদককে টেনে হেনস্তা করেছেন।
তবে মামলার বাদী মো. আফজাল বেনারকে বলেন, “আমি আজ আদালতে ছিলাম না। আর সংগ্রাম অফিস ভাঙচুরের ব্যাপারে আমি কিছু জানি না।”
আদালতে শুনানি
বয়সের কথা বিবেচনা করে সংগ্রাম সম্পাদককে আদালতে হাজিরা থেকে নিষ্কৃতি দেন বিচারক বাকী বিল্লাহ।
আবুল আসাদের জামিন চেয়ে আদালতে আবেদন করেন তাঁর প্রধান আইনজীবী আব্দুর রাজ্জাক। তিনি বলেন, “আইন অনুযায়ী, সংগ্রাম সম্পাদকের বিরুদ্ধে এই মামলা চলতে পারে না।”
তাঁর পক্ষে যুক্তি তুলে ধরতে নির্দেশ দিলে আব্দুর রাজ্জাক তাঁর সহযোগী আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনিরকে যুক্তি তুলে ধরতে বলেন।
শিশির মনির আদালতে বলেন, “সংগ্রাম সম্পাদক আবুল আসাদের বিরুদ্ধে যে মামলা করা হয়েছে এটি আইনসিদ্ধ হয়নি। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন অনুযায়ী, ডিজিটাল মাধ্যমে কোনো কিছু প্রচার করলে এই আইন প্রযোজ্য হবে। কিন্তু সংগ্রাম সংবাদটি প্রিন্ট সংস্করণে প্রচার করেছে।”
বিচারক তাঁকে প্রশ্ন করেন, “সংগ্রামের অনলাইন নেই?”
জবাবে শিশির মনির বলেন, “আছে। তবে সংবাদটি অনলাইনে প্রচার করা হয়নি।”
তাঁর যুক্তি খণ্ডণ করে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মো. হেমায়েত উদ্দিন খান হিরন বলেন, “সংগ্রাম যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লাকে শহীদ লিখেছে। আর সেই লেখা ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। এর মাধ্যমে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কাজ হয়েছে। এটি রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল। সেকারণে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের আওতায় আসবে।”
শিশির মনির বলেন, “ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন অনুযায়ী, এফআইআর দিয়ে এই মামলা করা যাবে না।”
তিনি বলেন, “জনৈক মো. আফজালের এজাহারের ভিত্তিতে হাতিরঝিল থানার একজন এসআই এফআইআর করে এই মামলা করেছেন। তাঁকে কে এই ক্ষমতা দিয়েছে? এই মামলা চলতে পারে না।”
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মো. হেমায়েত উদ্দিন বলেন, “কাদের মোল্লা একজন চিহ্নিত রাজাকার। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আদালত তাঁকে যুদ্ধাপরাধী হিসাবে রায় দিয়েছে। তাঁকে সংগ্রাম শহীদ লিখেছে।”
তিনি বলেন, “রাষ্ট্র তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে। দেশের সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে কাজ করেছে সংগ্রাম। দেশের বিরুদ্ধে কাজ করেছে। রাষ্ট্রদ্রোহের কাজ করেছে। তাঁর বিরুদ্ধে মামলা চলতে পারে।”
আবুল আসাদের প্রধান আইনজীবী আব্দুর রাজ্জাক বলেন, “সংগ্রাম সম্পাদকের বিরুদ্ধে নয়, উল্টো আমাদের মামলা করা উচিত। একদল লোক পত্রিকা অফিসে ঢুকে ভাঙচুর করেছে। কোটি টাকার সম্পদ বিনষ্ট করেছে।”
এই পর্যায়ে বিচারক বাকী বিল্লাহ প্রশ্ন করেন, “আপনারা মামলা করেননি।”
জবাবে আব্দুর রাজ্জাক বলেন, “আমরা মামলা করার জন্য থানায় গিয়েছিলাম। কিন্তু পুলিশ মামলা নিচ্ছে না। আজকেও আমরা মামলা করতে গেছি। কিন্তু পুলিশ মামলা নেয়নি।”
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী হেমায়েত উদ্দিন বলেন, “সংগ্রাম অফিস ভাঙচুর করা হয়নি।”
আব্দুর রাজ্জাক সংগ্রাম অফিস ভাঙচুর সংক্রান্ত দেশি-বিদেশি মিডিয়ার খবরের তালিকা আদালতে পেশ করেন।
তিনি বলেন, “আমার মক্কেলের বয়স ৭৮ বছর বিবেচনা করে তাঁকে জামিন দেওয়া হোক। আর মামলা বাতিল করা হোক।”
দুপক্ষের যুক্তি শেষে বিচারক বাকী বিল্লাহ বলেন, “জামিন আবেদন নামঞ্জুর। মামলা চলবে।”
শিশির মনির বেনারকে বলেন, “আমরা রায়ে খুশি নই। তবে আমরা বিষয়টি আইনিভাবে লড়ব।”
তিনি বলেন, “কোনভাবেই সংগ্রাম সম্পাদকের বিরুদ্ধে এই মামলা চলতে পারে না।”
হেমায়েত উদ্দিন বেনারকে বলেন, “আমরা আদালতের রায়ে সন্তষ্ট। আদালতের রায়ে প্রমাণিত হয়েছে, তাঁদের যুক্তি গ্রহণযোগ্য নয়।”
‘অফিস ভাঙচুরে সরকারের সায় আছে’
বিএনপি-জামায়াত সমর্থিত বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের মহাসচিব মো. আব্দুল্লাহ বেনারকে বলেন, “আমাদের অবস্থান হচ্ছে সংগ্রাম পত্রিকা অফিস ভাংচুরের ঘটনায় সরকারের উচ্চ পর্যায়ের সায় আছে। ঘটনার সময় পুলিশ নীরব দর্শক হয়ে দেখেছে। সায় না থাকলে কেন পুলিশ নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করল?”
তিনি বলেন, “কোনো পত্রিকার কোনো সংবাদে কেউ সংক্ষুব্ধ হয়ে থাকলে তারা প্রতিবাদ দিতে পারে, প্রেস কাউন্সিলে মামলা করতে পারে, প্রয়োজনে আদালতে মামলা করতে পারে। কিন্তু তা না করে পত্রিকা অফিসে ঢুকে ভাঙচুর করে, সম্পাদককে টেনে বের করে হেনস্তা করা সভ্য কাজ নয়।”
আব্দুল্লাহ বলেন, “এই ঘটনার কারণ হলো, ভিন্ন মতের যে পত্রিকা আছে সেগুলো বন্ধ করে দেয়া। ইতোমধ্যে, সংগ্রামের ডিক্লারেশন বাতিলের ব্যাপারে সরকারের পক্ষ থেকে চিঠি দেয়া হয়েছে।”
সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বেনারকে বলেন, “সংগ্রাম যুদ্ধাপরাধীকে শহীদ লিখে আইনের পরিপন্থী কাজ করেছে। প্রথমত, বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ কাদের মোল্লাকে যুদ্ধাপরাধী বলে রায় দিয়েছে। যার ভিত্তিতে তাঁর ফাঁসি হয়েছে। তাকে শহীদ বলা আদালতের বিরুদ্ধে বলা।”
তিনি বলেন, “দ্বিতীয় কথা হলো, সংবাদপত্র এমন কোনো সংবাদ প্রকাশ করতে পারে না, যা দেশের মানুষের সেন্টিমেন্টকে আঘাত করে। কাদের মোল্লাকে শহীদ লিখে সংগ্রাম পত্রিকা দেশের মানুষকে আঘাত দিয়েছে।”
শফিক আহমেদ বলেন, “সংক্ষুব্ধ কেউ আদালতে বিষয়টির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে মামলা করলে আইনি প্রতিকার পাওয়া যেত।”
তিনি বলেন, “সংগ্রাম জামায়াতে ইসলামীর পত্রিকা। কিছু অতি উৎসাহী মানুষ সংগ্রাম অফিসে ভাংচুর করেছে। তবে আইন কোনো মানুষকে সহিংসতার এই অধিকার দেয়নি। এতে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা খর্ব হয়েছে বলে প্রশ্ন যে কেউ প্রশ্ন তুলতে পারে।”