সাংবাদিকদের নিয়ন্ত্রণে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ক্ষমতাসীনদের হাতিয়ার: আরএসএফ
2021.07.06
ঢাকা

ক্ষমতাসীনেরা নিজেদের মতকে নিরঙ্কুশভাবে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন তৈরি করেছে এবং সাংবাদিকদের নিয়ন্ত্রণ করতে ওই আইনটি হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে—এমন অভিযোগ করেছে রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার (আরএসএফ)।
মঙ্গলবার প্যারিসভিত্তিক আন্তর্জাতিক ওই সংস্থাটি তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানায়, ইচ্ছাকৃতভাবে এমন কিছু শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে যা আইনটি ইচ্ছামাফিক প্রয়োগের সুযোগ তৈরি করে দেয়।
“সচেতনভাবে এমন কিছু শব্দ এই আইনে ব্যবহার করা হয়েছে যা এটিকে সাংবাদিকদের নিয়ন্ত্রণে আনতে বা সেন্সর করার ক্ষেত্রে চুড়ান্ত হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে,” বলা হয় ওই প্রতিবেদনে।
আরএসএফ-এর এসব অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বেনারকে বলেন, অভিযোগগুলো পুরোপুরি মিথ্যা এবং ভুল তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি করা হয়ে থাকতে পারে।
“ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি কোথাও অপব্যবহার হয়েছে—এমন কথা আমার মনে পড়ে না। কেউ ব্যক্তিগতভাবে যদি কাউকে শত্রুতাবশত হয়রানি করে থাকে সেটা অবশ্য ভিন্ন এবং সেসব ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার হয়ে থাকে,” বলেন জব্বার।
তিনি আরও বলেন, “সরকার রাজনৈতিক বা অন্য কোনও কারণে কোথাও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপপ্রয়োগ করছে না। বরং রাষ্ট্রবিরোধী, নৈরাজ্যবাদী, সাম্প্রদায়িক এবং উগ্রবাদীরা অনলাইন প্লাটফর্ম ব্যবহার করে জঘন্য অপপ্রচার চালাচ্ছে, তাদের বিরত রাখা যাচ্ছে না, এ নিয়ে আমরা প্রচণ্ড সংকটে পড়ছি।”
জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে কোনও অপপ্রচার চালালে এর সাজা ১৪ বছরের কারাদণ্ড রাখার বিধানকে প্রতিবেদনে নেতিবাচকভাবে তুলে ধরা হয়েছে।
“এই আইনটিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বা তাঁর দলের কর্মীরা সেই সব সাংবাদিক ও ব্লগারদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করছে যারা সরকারের সমালোচনা করছেন বা প্রধানমন্ত্রীর বিরক্তির কারণ হচ্ছেন,” বলছে আরএসএফ।
“গত দুই বছরে অথবা আইনটি প্রণয়নের পর থেকে প্রায় চারশ’ ব্যাক্তির বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে যার মধ্যে ৭০ জনেরও বেশি সাংবাদিক ও ব্লগার,” প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে করা অভিযোগ সম্পর্কে মোস্তফা জব্বার বলেন, “আমাদের প্রধানমন্ত্রী খুবই সহনশীল। ওনার বিরুদ্ধে কার্টুনসহ যেসব অশ্লীল প্রচারণা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চালানো হয়, সেসব ঘটনার প্রায় সবক্ষেত্রে তিনি সহনশীলতার পরিচয় দেন।”
তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর সমালোচনা করা হয়েছে সেজন্য কোনও ব্যবস্থা কোথাও নেয়া হয়নি।
“বরং যেসব প্রচারণা প্রধানমন্ত্রী বা বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে করা হয়েছে আমরা সেগুলো যাতে সরানো যায় সেই চেষ্টা করেছি। কারো বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে, এমন দৃষ্টান্ত নেই,” দাবি করেন জব্বার।
এদিকে বিতর্কিত ওই আইনের অধীনে গ্রেপ্তার ব্যাক্তিদের কারাগারে চরম দুরাবস্থার মধ্যে থাকার দৃষ্টান্ত হিসেবে লেখক মুশতাক আহমেদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার লেখক মুশতাক (৫৩) গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগারে মারা যান গত ফেব্রুয়ারিতে।
মুশতাকের মৃত্যু দেশে–বিদেশে আলোড়ন তৈরি করে এবং এর প্রেক্ষিতে আইনটি বাতিলের দাবি জোরদার হয়।
আরএসএফ-এর প্রতিবেদনে বলা হয়, আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ কর্মীরা মাঠে তৎপর থাকে। তারা রাজপথে কোনও ধরনের আন্দোলন, প্রতিবাদ, প্রতিরোধ বা বিক্ষোভ অথবা অন্য যে কোন ধরনের অস্বাভাবিক পরিস্থিতি তৈরি হলে বিশেষ করে নির্বাচন কভার করতে যাওয়া সাংবাদিকদের ওপর আক্রমণ করে।
“সাংবাদিকদেরকে প্রায়ই হাসপাতালে যেতে হয় এবং কখনো কখনো তাদের লাশ হয়ে মর্গে যেতে হয়,” প্রতিবেদনে বলা হয়।
প্রতিবেদনটিতে আরও বলা হয় ২০০৮ সালে বিপুল ব্যবধানে জয় পায় শেখ হাসিনার দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। ক্ষমতায় আসার পর তিনি মুক্ত গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব করতে কর্তৃত্বপরায়ণ হয়ে ওঠেন।
“এই ধারা আরও নিশ্চিত হয়ে যায় যখন প্রায় সব বিরোধী দলের অংশগ্রহণ ছাড়াই ২০১৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে তাঁর দল আবারও ক্ষমতায় আসে,” প্রতিবেদনে বলা হয়।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রনয়নকল্পে ২০১৮ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, যেসব সাংবাদিক মিথ্যা সংবাদ করে না তাদের এই আইন নিয়ে চিন্তিত হবার কোনও কারণ নেই।
প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্য উদ্ধৃত করে আরএসএফ বলেছে, এই আইন সরকারকে ‘সত্য’ ও ‘মিথ্যা’ সংবাদ নির্ধারণের সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে।
প্রতিবেদনে প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্সে বাংলাদেশের অবস্থান তুলে ধরে বলা হয়, আরএসএফ প্রকাশিত বার্ষিক সূচক অনুযায়ী বাংলাদেশ ১৫২তম স্থানে রয়েছে ১৮০ টি দেশের মধ্যে। গত ২০ এপ্রিল সূচকটি প্রকাশ করে আরএসএফ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক এ প্রসঙ্গে বেনারকে বলেন, ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার করে অপকর্ম রোধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের প্রয়োজন আছে। তবে এটি সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে প্রয়োগের ক্ষেত্রে আরও সতর্ক হতে হবে কর্তৃপক্ষকে।
আরএসএফ-এর প্রতিবেদনটি না দেখায় প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে যেসব কথা বলা হয়েছে সে বিষয়ে কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সাবেক এই অধ্যাপক।