পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে মজুতবিরোধী অভিযানে সরকার
2024.01.23
ঢাকা

চালের অবৈধ মজুতসহ বিভিন্ন অনিয়মের দায়ে মঙ্গলবার দেশব্যাপী শতাধিক প্রতিষ্ঠানকে প্রায় সাড়ে আট লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা কামাল হোসেন বেনারকে এ তথ্য জানিয়েছেন।
এর আগের দিন সোমবার শতাধিক প্রতিষ্ঠানকে প্রায় ২২ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছিল।
এদিকে অবৈধ মজুতদারকে কারাগারে পাঠানোর মতো কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
গতকাল গণভবনে আওয়ামী লীগের জরুরি সভায় তিনি বলেন, ‘এবারও কিন্তু আমাদের ফসল খুব ভালো হয়েছে। চাল উৎপাদন আমাদের বেড়েছে কিন্তু ঠিক নির্বাচনের পরে হঠাৎ দাম বাড়াটা এ রকম ভরা মৌসুমে; এটা খুব একটা অস্বাভাবিক পরিস্থিতি।’
তিনি বলেন, “অস্বাভাবিকভাবে বেশি পরিমাণে মজুত করে রাখা, দুরভিসন্ধি নিয়ে মজুত করে রাখা, এ রকম যাদেরই পাওয়া যাবে মোবাইল কোর্ট দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব। তাদের দরকার হলে জেলে ঢুকিয়ে দিতে হবে।”
পণ্যমূল্য স্থিতিশীল রাখতে গত ২১ জানুয়ারি সরকারের নতুন দায়িত্ব পাওয়া চার মন্ত্রী বৈঠক করেছেন। এছাড়া খাদ্যমন্ত্রী, কৃষিমন্ত্রী ও বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী গত এক সপ্তাহে একাধিকবার সভা করেছেন ব্যবসায়ীদের সঙ্গে।
খাদ্যমন্ত্রী গত ১৭ জানুয়ারি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করে অনুমোদনহীন গুদাম সিলগালা করার হুমকি দিয়েছিলেন।
আমদানি নির্ভর পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে কর কমানোর জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কাছে সোমবার চিঠি দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব তপন কান্তি ঘোষ বেনারকে বলেন, “ভোজ্য তেল, চিনি ও খেজুর আমদানিতে শুল্ক-কর কমানোর জন্য আমরা আবারও এনবিআরকে অনুরোধ জানিয়েছি। আশা করছি ভোক্তা পর্যায়ে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।”
পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে মঙ্গলবার ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠককালে ব্যবসায়ীদের সহায়তা চেয়েছেন বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু।
কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুস শহীদ জানিয়েছেন, “মজুতদারি এবং সিন্ডিকেট যাতে না হয় সেদিকে সরকারের কঠোর নজর রয়েছে।”
অবশ্য এতসব উদ্যোগ সত্ত্বেও বাজার ঘুরে দেখা গেছে, ভোক্তা পর্যায়ে ইতিবাচক প্রভাব পড়েনি।
এদিন রাজধানীর মিরপুর, রামপুরা ও মগবাজার এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, এক মাস আগের তুলনায় চাল পাঁচ শতাংশ বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। দুই সপ্তাহ আগের তুলনায় নতুন পেঁয়াজের দাম বেড়েছে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ। নতুন আলুর দাম কেজিপ্রতি গড়ে ৬০ টাকা।
পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণই হবে এখন বড় চ্যালেঞ্জ
আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণই হবে বড় চ্যালেঞ্জ।
সাবেক কৃষি সচিব আনোয়ার ফারুক বেনারকে বলেন, “দাম খুব একটা কমার সম্ভাবনা নেই।”
ব্যবসায়ীদের অতি মুনাফার মনোভাব ছাড়াও মূল্যস্ফীতি, ডিজেলের দাম বৃদ্ধি, বৈরী আবহাওয়ায় উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া, সুশাসনে অভাব, সরবরাহ ব্যবস্থায় চাঁদাবাজিকে অন্যতম কারণ হিসেবে মনে করেন তিনি।
ফারুক বলেন, একজন ফেরিওয়ালাকে তাঁর পণ্য বিক্রি করতে প্রতিদিন ২০০ টাকা চাঁদা দিতে হচ্ছে।
টিসিবির হিসাব অনুসারে, গত এক মাসের ব্যবধানে দাম বেড়েছে আটা, ময়দা, ডাল, ছোলা, ব্রয়লার মুরগিসহ আরও কিছু মসলা পণ্যের।
“কেবল ভারতের ওপর নির্ভর করে থাকলেই হবে না। আমদানির জন্য বিকল্প হিসেবে অন্যান্য দেশের দিকেও মনোযোগ দিতে হবে,” বলেন ফারুক।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান মনে করেন, সরকারের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজারে স্থিতিশীলতা আনাই বড় চ্যালেঞ্জ।
একই মত দিয়েছেন অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।
দায় নিচ্ছেন না ব্যবসায়ীরা
রাজধানীর মগবাজার এলাকার মাহবুব স্টোরের বিক্রয়কর্মী মুকুল বিশ্বাস মঙ্গলবার বেনারকে বলেন, “সোমবার থেকে বাজারে পেঁয়াজের দাম বেড়েছে। যে পেঁয়াজ দুই সপ্তাহ আগেও ৮০ টাকায় বিক্রি হয়েছে, তা এখন ৯০ টাকা।”
এছাড়া চালের দামও (মোট ও সরু) দুই থেকে পাঁচ টাকা বেশি দরে বিক্রি হচ্ছে তার দোকানে।
আরেক দোকানের কর্মী এই প্রতিবেদকের কাছে নতুন পেঁয়াজের দাম চান ১০০ টাকা কেজি।
দাম বৃদ্ধির কারণ জানিয়ে মুকুল বলেন, “যাদের কাছ থেকে কিনি, সেখানে দাম বেড়েছে।”
বগুড়া জেলা চালকল মালিক সমিতির সভাপতি আমিনুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “আমরা আগের দামেই চাল বিক্রি করছি। কিছু পাইকার ও মিল মালিক হয়তো বাড়িয়েছে।”
চালের দাম আর বাড়ার সম্ভাবনা নেই বলে জানান তিনি।
টিসিবির তথ্য অনুসারে, গত বছরের ২৩ জানুয়ারি নতুন আলু বিক্রি হয়েছে সর্বোচ্চ ৩০ টাকা কেজি দরে।
আলুর দাম আর কমার সম্ভাবনা নেই জানিয়ে বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু বেনারকে বলেন, “গত নভেম্বরে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে আলুর ফলন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তিনি মনে করছেন, এ বছর আলুর দাম কমার সম্ভাবনা কম।”
মধ্যস্বত্বভোগীরা লাভবান হচ্ছে না দাবি করে তিনি বলেন, “সরকারের কাছে চাহিদা ও যোগানের সঠিক তথ্য না থাকায় সমস্যা হচ্ছে।”
বেশি চাপ পড়ছে প্রান্তিক শ্রেণির মানুষের ওপর
ঝালকাঠির রাজাপুর উপজেলার বাসিন্দা মোহাম্মদ মোস্তফা বর্তমানে রাজধানীর রামপুরা এলাকায় একটি ভবনে তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে কাজ করছেন। বেতন পান মাসে ১০ হাজার টাকা। তিনি বলেন, “গত দুই বছরে আমার বেতন বাড়েনি। বছরের এই সময়ে চাল, আলু, পেঁয়াজের দাম কমার কথা কিন্তু কমেনি, বরং বেড়েছে।”
তিনি বলেন, “মাছ-মাংস কিনে খেলে বাড়িতে টাকা পাঠানো সম্ভব হয় না। আলু ভর্তা, ডাল দিয়ে খেলে বাড়িতে সংসার খরচের জন্য কিছু টাকা পাঠাতে পারি।”
ভয় দেখিয়ে বাজার নিয়ন্ত্রণ সম্ভব না
সিপিডির ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বেনারকে বলেন, “জেল-জরিমানা বা ভয় দেখিয়ে বাজার স্থিতিশীল করা সম্ভব নয়। বাজারকে বাজারের গতিতে চলতে দিতে হবে।”
তিনি আরও বলেন, “সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোকে চাহিদা, যোগান ও মজুতের সঠিক তথ্য সরবরাহ করতে হবে এবং সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে।”