রাস্তায় শৃঙ্খলা আনতে ব্যর্থতা স্বীকার করলেন পুলিশ কমিশনার
2019.03.21
ঢাকা

বাস চাপায় বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র নিহত হওয়ার জেরে শিক্ষার্থীদের টানা বিক্ষোভের পর নড়ে চড়ে উঠেছে ঢাকার পুলিশ। বৃহস্পতিবার শহরজুড়ে ফিটনেসবিহীন গাড়ি এবং ভুয়া লাইসেন্সধারী চালকদের বিরুদ্ধে দিনভর অভিযান চালিয়েছে তারা।
ঢাকার পুলিশ প্রধানও স্বীকার করেছেন, রাজধানীর ট্রাফিক শৃঙ্খলা বজায় রাখতে ব্যর্থ হয়েছে পুলিশ। একই দায়িত্বে থাকা বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সংস্থাও (বিআরটিএ) ব্যর্থ হয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
পাশাপাশি জেব্রা ক্রসিং, ফুটওভারব্রিজ ও আন্ডারপাস ব্যবহার না করে যত্রতত্র রাস্তা পারাপার হলে পথচারীদের জরিমানাসহ আটক করা হবে বলেও হুঁশিয়ার করেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার।
এদিকে টানা তৃতীয় দিনের মতো বৃহস্পতিবারও ঢাকা এবং দেশের কয়েকটি স্থানে নিরাপদ সড়কের দাবিতে বিক্ষোভ ও সমাবেশ করেছে শিক্ষার্থীরা। তবে তা আগের দুদিনের মতো তীব্র ছিল না। এসব সমাবেশ থেকে আগামী রোববার আবার রাস্তায় নামার ঘোষণা দিয়েছে তারা।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, দুর্ঘটনা ঘটার পরে অভিযান শুরু না করে সড়ক নিরাপদ রাখার স্বার্থে নিয়মিত অভিযান পরিচালনাসহ কার্যকরী উদ্যোগ নিতে হবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে।
এ প্রসঙ্গে ওয়ার্ক ফর এ বেটার বাংলাদেশ-ডব্লিউ বিবি ট্রাস্টের প্রোগ্রাম ম্যানেজার ও পরিবহন বিশেষজ্ঞ মারুফ হোসেন বেনারকে বলেন, “ফিটনেসবিহীন গাড়ির মতো অবৈধ লাইসেন্সেধারী কিংবা লাইসেন্স না থাকা চালকদেরও রাস্তায় চলতে দেওয়া ঠিক না। তাদের বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান অব্যাহত রাখতে হবে।”
তাঁর মতে, “দ্রুততম সময়ের মধ্যে সরকারকে বিনিয়োগ করে নতুন যানবাহনের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রয়োজনে ক্রাশ প্রোগ্রামের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ দিয়ে চাহিদা অনুযায়ী চালক তৈরি করতে হবে।”
দিনভর অভিযান
বৃহস্পতিবার এয়ারপোর্ট রোড, মানিক মিয়া এভিনিউসহ রাজধানীর প্রধান সড়কগুলোতে ফিটনেসবিহীন গাড়ির বিরুদ্ধে কঠোর অভিযান চালাতে দেখা যায় পুলিশকে। এসব সড়কের দু’পাশে ফিটনেসবিহীন গাড়িগুলোকে আটক করে রাখা হয়। আবার অনেকে আটক হওয়ার ভয়ে রাস্তায় গাড়ি নামায়নি। ফলে পুরো শহরজুড়ে ছিল তীব্র যানবাহন সংকট।
স্কাইলাইন পরিবহনের বাসচালক মো. সোহেল বেনারকে বলেন, আমি যে বাসটি চালাই, সেটির ফিটনেস না থাকায় এবং এটার নামে পাঁচটি মামলা থাকায় এয়ারপোর্ট এলাকায় বাসটি আটক করেছে পুলিশ।”
এই চালকের মতে, “শিক্ষার্থীরা যে আন্দোলন করছে তা যৌক্তিক তবে শুধু চালকদের নয় পথচারিদেরও আইন মেনে চলতে হবে।”
সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে কাউন্টার সার্ভিস চালুসহ রাজধানীতে পর্যাপ্ত বাস স্টপেজ তৈরি করা উচিত বলে মনে করেন তিনি।
গত ১৭ মার্চ থেকে শুরু হয়েছে পুলিশের ট্রাফিক সপ্তাহ। এর মধ্যেই গত মঙ্গলবার বসুন্ধরা এলাকায় সুপ্রভাত পরিবহনের একটি বাসের চাপায় বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের (বিইউপি) শিক্ষার্থী আবরার আহমেদ চৌধুরী মারা যান। তাকে চাপা দেওয়া বাসটির ঢাকায় চলাচলের অনুমতি ছিল না। বাসটির বিরুদ্ধে ১৭টি মামলাও ছিল। ওই ঘটনার পর গত দুই দিন বাসের বিরুদ্ধে অভিযান জোরালো করেছে পুলিশ।
ডিএমপি নিউজ জানায়, ট্রাফিক শৃঙ্খলা সপ্তাহ উপলক্ষে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে বৃহস্পতিবার সকাল হতে বিকাল পর্যন্ত ট্রাফিক আইন অমান্য করায় ৩৪৪টি বাসের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
রাস্তায় শৃঙ্খলা ফেরাতে ব্যর্থ পুলিশ
চলমান ট্রাফিক সপ্তাহের মধ্যেই ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া বলেছেন, “ডিএমপি মেধাবী ছাত্র আবরারের মৃত্যু আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে আমরা রাস্তায় শৃঙ্খলা রক্ষা করতে পারিনি। এই ব্যর্থতা আমাদের সবার। এর দায়ভার কেউ এড়াতে পারেন না। আমরা কেউ চাই না এ রকম দুর্ঘটনা হোক।”
বৃহস্পতিবার ট্রাফিক সচেতনতামূলক এক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি বলেন, ড্রাইভারকে কোনো অবস্থায় চুক্তিভিত্তিক গাড়ি দেওয়া যাবে না। প্রত্যেক বাস স্টপেজে টিকিট কাউন্টার বসিয়ে যাত্রী ওঠান। রংচটা, ফিটনেসবিহীন ও মডেল আউট কোনো গাড়ি ঢাকা শহরে চলতে দেওয়া হবে না।”
পথচারীদের উদ্দেশ্যে ডিএমপি কমিশনার বলেন, “জেব্রা ক্রসিং, ফুটওভারব্রিজ ও আন্ডারপাস ব্যবহার না করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যত্রতত্র রাস্তা পারাপার হলে ওই পথচারীকে জরিমানাসহ আটক করা হবে।”
“এক স্টপেজ থেকে অন্য স্টপেজ পর্যন্ত গাড়ির দরজা বন্ধ রাখতে হবে। রুট পারমিট অনুযায়ী গাড়ি চালাতে হবে। ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি চালালে গ্রেপ্তার করে তাঁর বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করা হবে,” বলেন তিনি।
তৃতীয় দিনের মতো বিক্ষোভ
এদিকে এক সপ্তাহ স্থগিত ঘোষণা করার পরেও বৃহস্পতিবার ঢাকাসহ দেশের কয়েকটি স্থানে নিরাপদ সড়কের দাবিতে বিক্ষোভ সমাবেশ ও মানববন্ধন করেছে শিক্ষার্থীরা।
বাসের ধাক্কায় বিইউপি’র ছাত্র আবরার আহমেদ চৌধুরীর মৃত্যুর প্রতিবাদে ও নিরাপদ সড়কের দাবিতে রাজধানীর প্রগতি সরণির যমুনা ফিউচার পার্কের সামনে মানববন্ধন করেছেন কিছু শিক্ষার্থী।
বৃহস্পতিবার দুপুর পৌনে ১২টার দিকে শতাধিক শিক্ষার্থীর এই মানববন্ধনে অংশ নেয়। এর আগে বিইউপি ও আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের (এআইইউবি) এই শিক্ষার্থীরা বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার প্রবেশ পথে জড়ো হয়।
পুলিশের অনুরোধে সড়কে অবস্থান না নিয়ে মানববন্ধন করে তারা।
বিউপির শিক্ষার্থী ফাহমিন চৌধুরী বেনারকে বলেন, “নিরাপদ সড়কের দাবিতে আজও শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন করেছি আমরা। তবে অন্যদিনের মতো আজ সড়ক অবরোধ করেনি। আমরা সাধারণ মানুষের দুর্ভোগের কারণ হতে চাই না।”
রোববার থেকে আবারও সড়কে থাকার কথা জানান তিনি।
নিরাপদ সড়কের দাবিতে সমর্থন জানিয়ে বৃহস্পতিবার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও বিক্ষোভ মিছিল করে।