চাকরি-কোটা সংস্কারের দাবি: সমোঝতার পর মধ্যরাতে আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা

শরীফ খিয়াম
2018.04.09
ঢাকা
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে ঢাকায় চাকরি প্রত্যাশীদের বিক্ষোভ। সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে ঢাকায় চাকরি প্রত্যাশীদের বিক্ষোভ। ৯ এপ্রিল ২০১৮।
মনিরুল আলম/বেনারনিউজ

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারীদের সাথে বিকেলে সচিবালয়ে মন্ত্রীর সমঝোতা বৈঠকের পর সোমবার মধ্যরাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে তাঁদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে বলে জানিয়েছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা।

সোমবার মধ্যরাতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া বিভিন্ন ভিডিওচিত্রে দেখা যায়, অজ্ঞাত তরুণরা আন্দোলনকারীদের মারধোর করে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে তাড়িয়ে দিচ্ছেন।

রাত বারোটার কিছু পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার এমন একটি ঘটনা বর্ণনা দিতে গিয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক প্রত্যক্ষদর্শী বেনারকে বলেন, “একদল লোক দুইজন আন্দোলনকারীকে নির্দয়ভাবে মারতে দেখেছি আমি। রাস্তার সাথে ঠুকে তাঁদের মাথা থেৎঁলে দেওয়া হয়েছে।”

এদিকে রাত সাড়ে দশটার দিকে ক্যাম্পাস ছেড়ে এসেছেন এমন এক শিক্ষার্থী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেনারকে বলেন, “আমি একদল লোককে হেলমেট পরে হাতে ধারালো অস্ত্র নিয়ে ফুলার রোডের দিক থেকে ক্যাম্পাসে ঢুকতে দেখেছি।”

বাংলাদেশে সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের ব্যানারে ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে শুরু হওয়া চাকরি প্রত্যাশীদের আন্দোলনের মুখে সোমবার বিকেলে তাঁদের সাথে আলোচনায় বসেন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।

সচিবালয়ে আয়োজিত সমঝোতা বৈঠক শেষে ওবায়দুল কাদের বলেন, “আন্দোলনকারীদের দাবি পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য ৭ মে পর্যন্ত সময় নিয়েছে সরকার।”

“সে পর্যন্ত আন্দোলন স্থগিত রাখার আশ্বাস দিয়েছে তারা,” বলেন তিনি।

তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় অবস্থান নেওয়া সাধারণ আন্দোলনকারীরা বিক্ষোভ স্থগিতের সিদ্ধান্ত মানতে নারাজ বলে রাত আটটা নাগাদ বেনারকে জানান সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের আহ্বায়ক হাসান আল মামুন।

সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে বিদ্যমান কোটা ব্যবস্থা ৫৬ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশে নামিয়ে আনার দাবিতে রোববার বিকেলে রাজধানী ঢাকার শাহবাগ থেকে শুরু হওয়া বিক্ষোভ সোমবার দুপুরের আগেই সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। এরই প্রেক্ষিতে সমঝোতা বৈঠক আহবান করে সরকারি দল।

আন্দোলনকারী সংগঠনের আহবায়ক মামুনের নেতৃত্বে ২০ সদস্যদের একটি প্রতিনিধি দল বৈঠকে অংশ নেন। তাঁদের পাঁচজন সরকারের প্রতিনিধিদের সামনে বক্তব্য রাখেন বলে উল্লেখ করেন ওবায়দুল কাদের।

আন্দোলনকারীদের বক্তব্য ‘মনোযোগ দিয়ে’ শোনার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, “আমরা (সরকার) ‘রিজিট’ অবস্থায় নেই। তাঁদের দাবির যৌক্তিকতা ইতিবাচকভাবে দেখা হবে।”

এদিকে ক্ষমতাসীনদের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপি’র মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দুপুরে এক সংবাদ সম্মেলনে কোটা সংস্কারের আন্দোলনের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করেন।

কোটা সংস্কারের বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে সুনির্দিষ্ট আলোচনা শুরু না হওয়া পর্যন্ত তাঁরা আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া এবং শাহবাগ মোড়ে অবস্থান অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়ে রোববার সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার যান চলাচল বন্ধ করে বিক্ষোভ শুরু করেন আন্দোলনকারীরা।

একপর্যায়ে পুলিশ লাঠিপেটা শুরু করলে সংঘাতের সূত্রপাত হয় বলে বেনারকে জানান সংশ্লিষ্টরা।

আহত ২১৭, আটক ২৭

সমঝোতা বৈঠকে ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার (ডিএমপি) আছাদুজ্জামান মিয়ার দেওয়া তথ্যের বরাত দিয়ে মামুন বেনারকে বলেন, “বর্তমানে আমাদের ২৭ জন পুলিশের হাতে আটক আছে।”

তবে আটকৃতদের ছেড়ে দেওয়া হবে বলে বেনারকে জানান পুলিশের রমনা জোনের ডিসি মারুফ হোসেন সরদার।

এদিকে সংঘর্ষের ঘটনায় সকাল অবধি দুই শতাধিক আন্দোলনকারী আহত হয়েছেন বলে জানিয়েছেন ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের আহ্বায়ক।

এই আন্দোলনে পুলিশের হামলায় বা অন্য যেকোনোভাবে আহতদের সুচিকিৎসার ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান ওবায়দুল কাদের।

ঢাকার রাস্তায় আগুন জ্বালিয়ে অবরোধ তৈরি করে বিক্ষোভকারীরা। ৯ এপ্রিল ২০১৮।
ঢাকার রাস্তায় আগুন জ্বালিয়ে অবরোধ তৈরি করে বিক্ষোভকারীরা। ৯ এপ্রিল ২০১৮।
মনিরুল আলম/বেনারনিউজ

 

যেভাবে ছড়িয়েছে বিক্ষোভ

“আটক ব্যক্তিদের মুক্তি দেওয়া না হলে আন্দোলনের দাবানল সারা দেশে ছড়িয়ে পড়বে,” সোমবার সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনে এক সংবাদ সম্মেলনে এমন হুঁশিয়ারি দিয়ে ফের বিক্ষোভ শুরু করেন আন্দোলনকারীরা।

পুলিশ আবারও টিয়ারগ্যাস ও রাবার বুলেট ছোঁড়ে। শুরু হয় ধাওয়া, পাল্টা-ধাওয়া।

রোববার রাতের ঘোষণা অনুযায়ী সকাল থেকেই দেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট শুরু হয়। এরই অংশ হিসেবে পুরোনো ঢাকার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও ক্লাস বর্জন করে বিক্ষোভ শুরু করে করে।

তাদের সঙ্গে যোগ দেয় কবি নজরুল কলেজ ও শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজের শিক্ষার্থীরা।

দেশের প্রভাবশালী গণমাধ্যমগুলো জানায়, দুপুরের আগেই চট্টগ্রাম, রাজশাহী, সিলেট, বরিশাল, রংপুর, কুষ্টিয়া ও ময়মনসিংহসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে।

আন্দোলনকারীরা সড়ক, মহাসড়ক ও রেলপথ অবরোধ করায় তৈরি হয় অরাজক পরিস্থিতি। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে শিক্ষার্থী ও শিক্ষক আহত হওয়ার ঘটনাও ঘটে।

উপাচার্যের বাসভবনে হামলা

রোববার রাত দেড়টার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামানের বাসভবনে হামলা চালিয়ে ব্যাপক ভাঙচুর করা হয়। খবর পেয়ে প্রধানমন্ত্রী ফোন করে উপাচার্যের খোঁজ নেন।

তবে ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের যুগ্ম-আহ্বায়ক মো. রাশেদ খান সাংবাদিকদের বলেন, “উপাচার্যের বাসভবনে হামলাকারীরা আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত নন।”

এর আগে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে উপাচার্য আখতারুজ্জামান বলেন, “আমার বাসায় যারা এসেছিল, তারা মুখোশ পরে এসেছিল।”

তবে এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে বিকেল পর্যন্ত কোনো অভিযোগ করা হয়নি।

কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইমের প্রধান মনিরুল ইসলাম বিকেলে শাহবাগ থানার সামনে সাংবাদিকদের বলেন, “তদন্ত না করে এ ব্যাপারে কোনো কিছু বলা যাবে না।”

মন্ত্রিসভার বৈঠকে ও সংসদে আলোচনা

ওবায়েদুল কাদের জানান, সকালে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠকেও কোটার বিষয়টি আলোচনায় আসে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।

মন্ত্রী পরিষদ সচিব মো. শফিউল আলম সাংবাদিকদের বলেন, “জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় বিষয়টি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে প্রধানমন্ত্রীকে জানাবেন।”

গতকাল জাতীয় সংসদেও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়।

৩৯ শতাংশই শিক্ষিত বেকার

বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির ২০১২ সালের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে প্রতি বছর নতুন ২২ লাখ কর্মক্ষম মানুষ শ্রমবাজারে প্রবেশ করে। কিন্তু কাজ পায় মাত্র ৭ লাখ। বাকি ১৫ লাখ বেকার থেকে যায়।

এই হিসেবে গত পাঁচ বছরে দেশের শ্রম বাজারে কমপক্ষে ৭৫ লাখ বেকার যুক্ত হয়েছেন।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী, ২০১৬-১৭ অর্থবছর শেষে সারা দেশে ২৬ লাখ ৭৭ হাজার বেকার লোক আছেন।

এই বেকারদের মধ্যে ১০ লাখ ৪৩ হাজার তরুণ-তরুণী উচ্চমাধ্যমিক কিংবা স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পাস করেও চাকরি পাচ্ছেন না। বেকারদের মধ্যে ৩৯ শতাংশই এমন শিক্ষিত বেকার।

স্নাতক ডিগ্রিধারীদের মধ্যে বেকারত্বের হার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ, ১১ দশমিক ২ শতাংশ।

উল্লেখ্য, বর্তমানে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে ৫৬ শতাংশ নিয়োগ হয় বিভিন্ন ধরনের অগ্রাধিকার কোটায়। বাকি ৪৪ শতাংশ নিয়োগ হয় মেধায়।

এ ছাড়া তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির চাকরিতেও রয়েছে বিভিন্ন ধরনের কোটা। বিদ্যমান এই কোটা ব্যবস্থাকে বৈষম্যমূলক উল্লেখ করে তা সংস্কারের দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে আসছেন শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রার্থীরা। তাঁরা বলছেন, এই কোটা ১০ শতাংশে নামিয়ে আনতে হবে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।