আন্দোলনের মুখে কোটা বাতিলের ঘোষণা

শরীফ খিয়াম
2018.04.11
ঢাকা
সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি সংস্কারের দাবিতে ঢাকায় বিক্ষোভ। সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি সংস্কারের দাবিতে ঢাকায় বিক্ষোভ। ১১ এপ্রিল ২০১৮।
বেনারনিউজ

আন্দোলনের মুখে সকল কোটা পদ্ধতি বাতিলের ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আন্দোলনকারীদের ডাকে বুধবার সকাল থেকে সারা দেশে অনির্দিষ্টকালের জন্য ধর্মঘট শুরু হওয়ার পর বিকেলেই সংসদে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, “যেহেতু কোটা নিয়ে এত কিছু, এরাও চায় না, ওরাও চায় না। ঠিক আছে, কোনো কোটাই থাকবে না, সব বাতিল।”

বিসিএস (বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস) থেকে শুরু করে কোনো সরকারি চাকরিতে এখন থেকে শুধু মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া হবে জানিয়ে তিনি বলেন, “যারা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, প্রতিবন্ধী তাঁদের অন্যভাবে চাকরি ব্যবস্থা করে দিতে পারব।”

সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে বিদ্যমান কোটা ব্যবস্থা ৫৬ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশে নামিয়ে আনার দাবিতে সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের ব্যানারে ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে আন্দোলন শুরু হয়।

এদিকে সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য নির্ধারিত কোটা সংস্কার করা হলে আন্দোলনে নামার ঘোষণা দিয়েছে মুক্তিযুদ্ধ সংসদ সন্তান কমান্ড।

জাতীয় জাদুঘরের সামনে এক অবস্থান কর্মসূচিতে সংগঠনের নেতারা বলেছেন, “সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান-নাতিদের জন্য নির্ধারিত কোটার কোনো ধরনের সংস্কার মুক্তিযোদ্ধার সন্তানরা মেনে নেবে না।”

প্রসঙ্গত, বর্তমানে দেশে মুক্তিযোদ্ধার পোষ্যদের জন্য সরকারি চাকরিতে কোটা রয়েছে ৩০ শতাংশ।

গত মাসের তৃতীয় সপ্তাহে চট্টগ্রামে এক জনসভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, “মুক্তিযোদ্ধাদের কারণেই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে বিধায় তাঁদের ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতনি সবার জন্য আমরা চাকরিতে কোটার ব্যবস্থা করেছি।”

কোটা সংস্কার আন্দোলনের যুগ্ম আহ্বায়ক ফারুক হাসান বেনারকে বলেন, “আমরা সংস্কার চাই। কোটা বাতিল আমাদের এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য নয়।”

“আমরা শুধু চাই ১০ শতাংশ কোটা রেখে ৯০ শতাংশ মেধার সুযোগ। এ নিয়ে বিভ্রান্তির কোনো সুযোগ নেই,” যোগ করেন তিনি।

বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে সমবেত বিক্ষোভকারীদের উদ্দেশ্যে আরেক যুগ্ম আহ্বায়ক মুহাম্মদ রাশেদ খান ঘোষণা করেন, “প্রধানমন্ত্রী কোটা সংস্কারের ঘোষণা দিলেই শুধু হবে না, বাস্তবায়নের সময়সীমাও উল্লেখ করতে হবে। সুনির্দিষ্ট আশ্বাস পেলেই আমরা ঘরে ফিরে যাব।”

এর আগে কী পদক্ষেপ নেওয়া হবে সে ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি বক্তব্য প্রত্যাশা করছিলেন আন্দোলনকারীরা।

তবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “কোটা থাকলেই সংস্কার। না থাকলে সংস্কারের দরকারই নেই।”

কোটা বাতিলের ঘোষণা আসায় বিক্ষোভ স্থগিত করে সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ।

“রাতে সবাই মিলে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য বিশ্লেষণ করে বৃহস্পতিবার সকাল ১০টায় আমরা সিদ্ধান্ত জানাব। আজকের মতো আমাদের কর্মসূচি শেষ,” সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় বেনারকে বলেন পরিষদের যুগ্ম আহবায়ক মাহফুজুর রহমান।

আন্দোলন অচল দেশ

মঙ্গলবার দিবাগত রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কবি সুফিয়া কামাল হলসহ বিভিন্ন ছাত্রাবাসে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের নির্যাতনের খবর ছড়িয়ে গেলে বুধবার সকাল থেকেই রাস্তা-ঘাট বন্ধ করে বিক্ষোভ শুরু করে শিক্ষার্থীরা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও ঢাকার প্রায় প্রতিটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যায়ের সামনে দিয়ে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। চরম দুর্ভোগ পোহায় সাধারণ মানুষ।

সরেজমিনে বিভিন্ন এলাকায় সাধারণ মানুষকে গাড়ি ছেড়ে দেওয়ার জন্য আন্দোলনকারীদের অনুরোধ করতে দেখা গেছে। তবে অ্যাম্বুলেন্স ও গণমাধ্যমের গাড়ি ছাড়া কেউ ছাড় পায়নি।

ঘোষণা নিয়ে বিভ্রান্তি

প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা পর বিভ্রান্ত আন্দোলনকারীরা আবারও দুই ভাগ হয়ে গেছে।

একপক্ষ বলছে, “কোটা সম্পূর্ণ বাতিল করলে তা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হবে। ফলে সুপ্রিম কোর্টে কেউ রিট করলে এ ব্যবস্থা আবার ফিরে আসবে। তাই আমরা ১০ শতাংশ কোটা রাখার পক্ষে।”

আরেক পক্ষের মত, “সংবিধানে সরকারকে কোটা সিস্টেম চালুর যে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে সেটা ‘ম্যান্ডেটরি’ কিছু না। সরকার চাইলে কোটা চালু করতেও পারে, বাতিলও করতে পারে। এটা কখনোই অসাংবিধানিক হবে না।”

উল্লেখ্য, এর আগে সোমবারও সরকারের সঙ্গে সমঝোতা প্রশ্নে বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল আন্দোলকারীরা। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় তারা ফের ঐক্যবদ্ধভাবে বিক্ষোভ শুরু করে।

যা বলছেন বিশেষজ্ঞরা
বাংলাদেশি রাষ্ট্র বিজ্ঞানী ড. আতাউর রহমান বেনারকে বলেন, “প্রধানমন্ত্রী একটা রাজনৈতিক বক্তব্য দিয়েছেন, সত্যিকারের কোনো নীতি-নির্ধারণী বক্তব্য দেননি।”

দেশের রাষ্ট্র বিজ্ঞান সমিতির এই সাবেক সভাপতির অভিমত, “সংবিধান অনুযায়ী কিছু কোটা থাকা দরকার। কারণ সাংবিধানিকভাবে অনগ্রসরমান জনগোষ্ঠীর জন্য কোটা রাখার সুযোগ আছে। আর দেশে এমন মানুষ রয়েছে।”
ড. আতাউর বলেন, “বললেই তো সবকিছু আইনত বাতিল হয়ে যাবে না। এবার বিষয়টা কাগজ-কলমে আসতে হবে।”

“এরপর অবশ্যই এই সিদ্ধান্ত আইন মন্ত্রণালয়ে আমলাদের হাতে যাবে। তারা আইনগত দিকগুলো খতিয়ে দেখবে।”

“সুতরাং অনিশ্চয়তা কিছু আছে। জটিলতা সহসাই কাটবে বলে মনে হয় না। আন্দোলনকারীরা যদি বলে এটা এখনই বাতিল করতে হবে। তাহলে হবে, নয়ত সময় লাগবে।”

তবে সচিবালয়ে এক অনুষ্ঠানে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, “কোটা সংস্কারের বিষয়ে যদি আইন মন্ত্রণালয়ের কিছু করার থাকে তবে তা অবশ্যই দ্রুততার সঙ্গে করা হবে।”

মন্ত্রী আরো বলেন, “সরকার এই বিষয়টি নিয়ে খুবই যত্নশীল।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।