আন্দোলনকারী কয়েকজন ছাত্রী গভীর রাতে হল থেকে বিতাড়িত
2018.04.20
ঢাকা

আপডেট: ২০ এপ্রিল, ইস্টার্ন টাইম বিকেল ০৩.১৫
কোটা সংস্কার আন্দোলনে জড়িত ছাত্রীদের গভীর রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হল থেকে বের করে দেওয়ার অভিযোগ তুলেছে আন্দোলনকারী সংগঠন বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ।
পরিষদের আহবায়ক হাসান আল মামুন শুক্রবার বেনারকে বলেন, “বৃহস্পতিবার রাতে কবি সুফিয়া কামাল হল থেকে কমপক্ষে ২০ জন ছাত্রীকে বের করে দেওয়া হয়েছে।”
তবে হল ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দাবি করেছে, কাউকে বের করে দেওয়া হয়নি। তিন ছাত্রীকে তাদের অভিভাবকেরা নিয়ে গেছেন।
সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে বিদ্যমান কোটা ব্যবস্থা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন চলাকালে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে স্ট্যাটাস দেওয়া চার ছাত্রীর অভিভাবককে ডেকেছিল হল কর্তৃপক্ষ।
“এর মধ্যে তিন জন নিজেদের মেয়েকে ‘কাউন্সিলিংয়ের জন্য’ চেয়ে নিয়ে গেছেন,” জানান হলের প্রাধ্যক্ষ সাবিতা রিজওয়ানা রহমান। শুক্রবার বেনারকে তিনি আরো বলেন, “ছাত্রীদের হল থেকে বের করে দেওয়ার খবরটি গুজব।”
“অভিভাবকদের সাথে পাঠানো দুটি মেয়ে আবার আমাদের ফুটবলার। ইতোমধ্যেই তারা হলে ফিরেছে,” বলেন প্রভোস্ট। তাঁর কথার সত্যতা নিশ্চিত করেন একাধিক ছাত্রী। এমনকি কারণ দর্শানোর নোটিশ পাওয়া অনেকেও হলে আছেন বলে তারা বেনারকে জানান।
“পরিস্থিতি নিয়ে গুজব ছড়ানো ঠেকাতে হাউস টিউটরেরা ছাত্রীদের সাথে কথা বলেছেন,” জানান তারা।
যদিও এ খবর ছড়িয়ে পড়ায় রাতেই সুফিয়া কামাল হলের গেটে জমায়েত হয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ছাত্রাবাসে বসবাসকারী শিক্ষার্থীরা।
ওই সময় কেন্দ্রীয় নেতাদের ঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী শুক্রবার বিকেলে ঢাবিসহ দেশের কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মিছিল-সমাবেশ হয়েছে। এসব কর্মসূচি থেকে বিতাড়িতদের হলে ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি জানানো হয়েছে।
তবে প্রাধ্যক্ষ বলেছেন, “কারো সিট বাতিল বা সাময়িক বাতিল এবং কাউকে বহিস্কার করা হয়নি।”
হাসান আল মামুন বেনারকে বলেন, “তাৎক্ষণিকভাবে ওই কর্মসূচি দেওয়া হয়েছিল। পরবর্তী করণীয় এখনো ঠিক করা হয়নি।”
তাঁর দাবি, “পরিষদের হিসাব অনুযায়ী কমপক্ষে ২০ জনকে হল থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। তবে তাদের সবার পরিচয় আমরা জানতে পারিনি। কারণ সবার সাথে তাৎক্ষণিকভাবে যোগাযোগ করা যায়নি। তাদের মোবাইল ফোনও জব্দ করা হয়েছে।”
হলের প্রভোস্ট সাবিতা রিজওয়ানা বলেন, “ফেসবুকে ফেইক একাউন্ট খুলে ওই ছাত্রীরা যে ধরনের অপপ্রচার চালিয়ে পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করেছে, তা দেখে তাদের অভিভাবকরাও লজ্জা পেয়েছেন। কয়েক দিনের জন্য ফোনগুলো হাউস টিউটরদের কাছে রাখার পরামর্শ তাঁরাই দিয়েছেন।”
সাবিতা আরো বলেন, “এই মেয়েদের আমরা সেভাবে আইনের আওতায় আনতে চাই না।”
রাতের আঁধারে কেন ডেকেছে?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামান শুক্রবার সাংবাদিকদের বলেন, “বিভিন্নভাবে গুজব, উসকানি ও মিথ্যা কথা ছড়ানো হচ্ছে। সাধারণ ছাত্রীদের কোনো ধরনের হয়রানি করা হয়নি,”
তবে ছাত্রীদের হল থেকে বের করে দেওয়ার খবর ‘গুজব’ নয় দাবি করে হাসান আল মামুন বলেন, “সেখানে অনেক প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন। অনেক মিডিয়া কর্মীও ভিডিও করেছেন। গণমাধ্যমে সচিত্র খবর প্রকাশ হয়েছে।”
“সবার সাথে আলাপ করে আমরা মোট কত জনকে বের করে দেওয়া হয়েছে সে সম্পর্কে ধারণা পেয়েছি,” যোগ করেন ঢাবির ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের এই শিক্ষার্থী।
অন্যদিকে মাত্র তিন ছাত্রীকে অভিভাবকের হাতে তুলে দেওয়ার কথা জানিয়ে ঢাবির ভিসি দাবি করেন, “হল প্রশাসন এমন অভিভাবকসুলভ আচরণ না করলে বরং তাঁদের দোষারোপ করতাম।”
“মেয়েগুলোকে এত রাতে কেন বের করে দেওয়া হয়েছে? অভিভাবকদের তাঁরা রাতের আঁধারে কেন ডেকেছে?” প্রশ্ন তোলেন বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের আহবায়ক।
ভিসি মো. আখতারুজ্জামান বলেন, “হল কর্তৃপক্ষ সন্ধ্যা থেকেই ছাত্রীদের নিয়ে বসেছিল। কিন্তু অভিভাবকরা প্রত্যেকেই কর্মজীবী। তাঁদের আসতে দেরি হয়েছে। কাউকে বের করে দেওয়ার কথা সত্য নয়।”
“ঘটনার অপব্যাখ্যা করে একটি অস্থির পরিবেশ তৈরির অপপ্রয়াস চালানো হচ্ছে,” যোগ করেন তিনি।
অভিভাবকের হাতে তুলে দেওয়া তিন ছাত্রী হলেন; গণিত বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী শারমীন শুভ, থিয়েটার অ্যান্ড পারফরম্যান্স স্টাডিজ বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী কামরুন্নাহার লিজা ও গণিত বিভাগের পারভীন।
রাত ১০টার দিকে পারভীন ও লিজা এবং রাত ১২টার দিকে শুভ হল ছাড়েন।
এ ছাড়া পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী রিমির বাবা ধামরাই থেকে রাত সাড়ে ১২টার দিকে এসে পৌঁছান। বেশি রাত হওয়ায় তাকে অভিভাবকের সাথে পাঠানো হয়নি বলে হলের কর্মকর্তারা বেনারকে জানান।
রিমির বাবা হল গেটে সাংবাদিকদের বলেন, তাঁর মেয়ে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন। ভবিষ্যতে যেন এমন আর না হয়, সে জন্য হল কর্তৃপক্ষ তাঁকে ডেকে সতর্ক করেছে।
চার অভিভাবকের মুচলেকা
প্রভোস্টের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, গত ১০ এপ্রিল রাতে ছাত্রলীগের হল শাখার সভানেত্রী ইফফাত জাহান ইশা এক শিক্ষার্থীর পায়ের রগ কেটে দিয়েছে বলে ফেসবুকে যে গুজব ছড়ানো হয়েছিল, ওই চার জন সে ঘটনায় জড়িত।
“শনাক্তের পরই মনে হয়েছে, এ বিষয়টি তাদের অভিভাবকদের জানাতে হবে। কারণ এদের বোঝাতে হবে, বুঝতে না চাইলে বকতে হবে,” বলেন তিনি।
“আমি দায়িত্ব নিয়ে বলছি আমার মেয়ে আগামীতে এমন কিছু আর করবে না,” অভিভাবকেরা এমন লিখিত মুচলেকা দিয়ে গেছেন জানিয়ে প্রভোস্ট বলেন, “এ ঘটনা জানতে পেরে তারা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন।”
সেই রাতে ইশাকে লাঞ্ছিত ও জুতার মালা পরানোর ঘটনায় জড়িত থাকার দায়ে হল শাখার ২৪ নেত্রীকে স্থায়ী বহিষ্কার করেছে ছাত্রলীগ এবং হলের ২৬ শিক্ষার্থীকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
সাধারণ শিক্ষার্থীদের কয়েকজন বেনারকে জানান, ছাত্রলীগ থেকে বহিস্কৃত বা ঢাবি থেকে নোটিশ পাওয়া অনেকে ওই রাতে হলে ছিলেন না। ইশার ঘনিষ্ট যে মেয়েরা তার আচরণে ক্ষিপ্ত ছিল, তারাই তাকে মারধর করেছে। এদের কেউই এখন আর হলে নেই।
ইশাও হলে ফেরেনি জানিয়ে ড. সাবিতা রিজওয়ানা রহমান বেনারকে বলেন, “যারা ঘটনা ঘটিয়ে হল থেকে পালিয়েছে, তারাই এখন সাংবাদিকদের বলে বেড়াচ্ছে যে আমাদের বের করে দেওয়া হয়েছে।”
তবে হাসান আল মামুন বেনারকে বলেন, “ম্যাম-ই (প্রভোস্ট সাবিতা) তাদের বলে দিয়েছেন, তোমরা আর হলে ফিরতে পারবে না।” তিনি প্রয়োজনে দুই হাজার শিক্ষার্থীকে বহিস্কার করার হুমকি দিয়েছেন।