ছাত্রলীগের হামলায় ছত্রভঙ্গ কোটা সংস্কার আন্দোলন
2018.07.02
ঢাকা

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের টানা তিন দিনের হামলায় ছত্রভঙ্গ হয়েছে কোটা সংস্কার আন্দোলনের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। পিটুনি ও গ্রেপ্তার এড়াতে গা ঢাকা গিয়েছেন আন্দোলনকারী সংগঠন সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের নেতারা।
“ছাত্রলীগ আমাদের পিটিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দিচ্ছে,” জানিয়ে পরিষদের আহ্বায়ক হাসান আল মামুন সোমবার দুপুরে বেনারকে বলেন, “আপাতত নতুন কোনো কর্মসূচি ঘোষণা করতে পারছি না। প্রধানমন্ত্রীর প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ কামনা করছি।”
সোমবার সকালেও কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর চড়াও হয় ছাত্রলীগ। এ সময় লাঞ্ছিত হন আন্দোলনরত ছাত্রীরাও।
এর আগে গত শনি ও ররিবারও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আন্দোলনকারীদের ওপর হামলার অভিযোগ ওঠে সরকারি ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে। যদিও ছাত্রলীগ হামলার অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) প্রক্টর অধ্যাপক একেএম গোলাম রব্বানি সাংবাদিকদের বলেন, “প্রক্টরিয়াল বডি বা শিক্ষার্থীদের কেউ লিখিত বা মৌখিকভাবে হামলার বিষয়টি আমাকে অবহিত করেননি। তাই এ নিয়ে কিছু বলতে পারছি না।”
“অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে,” যোগ করেন তিনি।
আন্দোলনের যুগ্ম আহ্বায়ক লুৎফর নাহার মিলা সাংবাদিকদের বলেন, “শনিবারের হামলার প্রতিবাদে আমাদের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি ছিল আজ (সোমবার)। শহীদ মিনারে আসতেই ছাত্রলীগের নেতা কর্মীরা আমাদের ওপর হামলা করে।”
“মেয়েদেরও তারা লাথি-ঘুষি মেরেছে। একজন মেয়ের মাথাও ফেটে গেছে,” দাবি করেন তিনি।
হামলায় নেতৃত্বদানকারী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মহসীন হল ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদি হাসান বলেন, “আমরা জানতে পেরেছি কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীরা পতাকা মিছিলের নামে লাঠিসোঁটা নিয়ে ক্যাম্পাসে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবে। তাই শৃঙ্খলা যেন নষ্ট না হয় সে জন্য সাধারণ শিক্ষার্থী হিসেবে আমরা অবস্থান নিয়েছি; তাদের মারধর করি নাই।”
প্রত্যক্ষদর্শীরা বেনারকে জানান, সকাল থেকেই ক্যাম্পাসে মহড়া দিয়েছে ছাত্রলীগ। আন্দোলনকারী হিসেবে কাউকে সন্দেহ হলেই তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে তারা।
গ্রেপ্তার হতে পারি
আন্দোলনের আহ্বায়ক মামুন বেনারকে বলেন, “এখন পর্যন্ত যুগ্ম আহ্বায়ক রাশেদ খান, জসিম উদ্দিন, ফারুক হাসানসহ আমাদের পাঁচ-ছয় জন নেতা গ্রেপ্তার হয়েছে। আমিও যে কোনো মুহূর্তে গ্রেপ্তার হতে পারি।”
“আমাদের ওপর ছাত্রলীগের হামলা এবং হুমকি অব্যাহত রয়েছে,” জানান ঢাবির ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের এই শিক্ষার্থী। তিনি আরও বলেন, “গত (রবিবার) রাত থেকে নূরের কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না।”
ঢাবির ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী নুরুল হক নূর এই আন্দোলনের আরেক যুগ্ম আহবায়ক। পূর্বঘোষিত সংবাদ সম্মেলন করতে গিয়ে শনিবার সকালে তিনি বেধড়ক পিটুনির শিকার হন। তাকে বাঁচাতে এসে আহত হন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান গ্রন্থাগারিক অধ্যাপক এস এম জাভেদ আহমেদ।
ড. জাভেদ গণমাধ্যমকে বলেন, “নিজেকে শিক্ষক হিসেবে পরিচয় দেয়ার পরও তারা আমার ওপর চড়াও হয়েছে। আমার হাতের তালু কেটে গেছে।” যদিও এই হামলার দায়ও অস্বীকার করেছে ছাত্রলীগ।
গত তিন দিনের ছাত্রলীগের হামলায় ঢাকা ইউনিভার্সিটি মাইম অ্যাকশন-এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি তরুণ মূকাভিনয় শিল্পী মীর লোকমান ছাড়াও বেশ কয়েকজন সাধারণ শিক্ষার্থী-পথচারী আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
প্রজ্ঞাপনই থামাতে পারে আন্দোলন
বেনারকে মামুন বলেন, “এটা দেশের ২৬ লাখ বেকারের আন্দোলন। প্রধানমন্ত্রী তাঁর ঘোষণা অনুযায়ী প্রজ্ঞাপন জারি করলে আমরা এই আন্দোলন থেকে সরে দাঁড়াব।”
তবে সোমবার মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম বলেছেন, “কোটা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষিত চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত সহসাই বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না।”
এর আগে গত এপ্রিলে আন্দোলনের মুখে সংসদে দাঁড়িয়ে কোটা বাতিলের ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সর্বশেষ গত ২৬ জুন তিনি জানান, কোটা সংস্কারের জন্য মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে প্রধান করে গঠিত একটি কমিটি কাজ করছে।
যদিও মন্ত্রিপরিষদ সচিব জানালেন, “কমিটি এখনো কাজ শুরু করেনি। এটি অত্যন্ত জটিল ও কঠিন কাজ, সময়সাপেক্ষ বিষয়।”
চিকিৎসা পাচ্ছে না আন্দোলনকারীরা
ধানমন্ডির আনোয়ার খান মডার্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন নূরকে রবিবার দিবাগত রাত আড়াইটার দিকে বের করে দেওয়া হয়। হাসপাতালের ফটকে পরিবারের সদস্যদের সাথে থাকা নূর সাংবাদিকদের বলেন, “হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, পুলিশ আপনাকে গ্রেপ্তার করবে। আমরা এখানে আপনাকে রাখতে পারব না।”
এর আগে শনিবার ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালও তাঁকে চিকিৎসা করতে অস্বীকৃতি জানায় বলেও তিনি অভিযোগ করেন। একই অভিযোগ করেছেন আরও একাধিক আহত আন্দোলনকারী।
তবে হাসপাতালটির ক্যাজুয়ালটি বিভাগের আবাসিক চিকিৎসক আলাউদ্দিনের দাবি, “নূর ভর্তি হতে আসলে তাঁকে কয়েকটি ডাক্তারি পরীক্ষা করতে দেওয়া হয়। কিন্তু পরে তিনি আর আসেননি।”
“কাউকে চিকিৎসা না দিয়ে ছেড়ে দেওয়ার অভিযোগ ঠিক না,” সাংবাদিকদের বলেন তিনি।
পাঁচ দিনের রিমান্ডে রাশেদ
কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক রাশেদ খানকে পাঁচ দিন রিমান্ডে নেওয়ার আদেশ দিয়েছেন আদালত। গতকাল সোমবার ঢাকার মহানগর হাকিম রায়হানুল ইসলাম এ আদেশ দেন।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক লাইভে প্রধানমন্ত্রীকে কটূক্তি করার অভিযোগে রাশেদ খানকে গ্রেপ্তার করা হয়। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের উপ-পুলিশ পরিদর্শক সজীবুজ্জামান গতকাল রাশেদ খানকে আদালতে হাজির করে ১০দিন রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন জানান।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগ নেতা আল নাহিয়ান খান তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় শাহবাগ থানায় এ মামলা করেন।
রাশেদ গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে রবিবার বিকেলে শাহবাগে জড়ো হতে থাকা কয়েকজন আন্দোলনকারীকে পিটিয়ে থানায় সোপর্দ করে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।
থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল হাসান বলেন, “দুজনকে থানায় দেওয়া হয়েছিল। এর মধ্যে একজনকে আমরা ছেড়ে দিয়েছি।”
কর্মসূচি পালনে সর্বত্রই বাধা
দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদ জানাতে জড়ো হওয়ার চেষ্টা করলেও কোথাও ছাত্রলীগ, কোথাও বা পুলিশ তাঁদের বাধা দিয়েছে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে (রাবি) আন্দোলনকারীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলায় গতকাল ছয়জন আহত হয়। রাবি প্রক্টর অধ্যাপক ড. লুৎফর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, “আন্দোলনকারী ও ছাত্রলীগ নেতৃত্ব, উভয় পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করেছি। ক্যাম্পাসে অতিরিক্ত পুলিশও মোতায়েন করা হয়েছে।”
চলমান এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ গতকাল এক বিবৃতিতে ছাত্রদের দাবি সংবলিত আন্দোলন শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে দমন না করে শান্তিপূর্ণ আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করতে সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।
বিবৃতিতে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর সরকারি দলের ছাত্র সংগঠনের কর্মীদের হামলা ও আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাধ্যমে আন্দোলনকারীদের গ্রেপ্তারের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়।