কোটা উঠিয়ে দেওয়ার পক্ষে সরকার গঠিত কমিটি
2018.08.13
ঢাকা

কোটা সংস্কারের প্রজ্ঞাপন জারি করতে রোববার সরকারকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়েছিল আন্দোলনকারীরা। তার এক দিনের মাথায় সরকারি চাকরিতে বিদ্যমান কোটার প্রায় পুরোটাই উঠিয়ে দেওয়ার পক্ষে মত দিয়েছে সরকার গঠিত কমিটি।
সোমবার কোটার পরিবর্তে মেধাকে প্রাধান্য দেওয়া ও উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়ার বিষয়ে প্রাথমিকভাবে সুপারিশ করেছে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার, বাতিল ও পর্যালোচনায় গঠিত সরকারি সাত সদস্য বিশিষ্ট এই কমিটি।
তবে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটার বিষয়ে উচ্চ আদালতের রায় থাকায় সে বিষয়ে আদালতের মতামত চাইতে বলা হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধা কোটার বিষয়ে আদালতের মতামত বা নির্দেশনা অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তাঁরা।
এদিকে সরকারি কমিটির এই সুপারিশের সঙ্গে একমত পোষণ করেনি আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। তাঁরা বলছেন, কোটা ব্যবস্থার যৌক্তিক সংস্কার প্রয়োজন, বাতিল নয়।
কোটা আন্দোলনকারীদের সংগঠন বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের আহ্বায়ক হাসান আল মামুন বেনারকে বলেন, “সরকারের করা কমিটির সুপারিশগুলোকে আমরা স্বাগত জানাতে পারছি না।”
তিনি বলেন, “তাই কোটা সংস্কারের পাঁচ দফার আলোকে আমাদের যে অবস্থান, আমরা সেখানেই আছি। আমরা চাই দেশের সার্বিক কল্যাণে কোটা ব্যবস্থা থাকুক কিন্তু সেটা একটা যৌক্তিক ও সহনীয় সংস্কার করা হোক।”
“মন্ত্রিপরিষদ সচিব যে কমিটির সুপারিশগুলো আজ করেছেন তা আমাদের কাছে এখনো স্পষ্ট নয়। কারণ, মুক্তিযোদ্ধা কোটার বিষয়ে সরকার আদালতের দোহাই দিচ্ছে। কিন্তু যে বিষয়টি বলা হচ্ছে, সেটা আদালতের কোনো রায় নয়, পর্যবেক্ষণ মাত্র। আর এটি মানা বাধ্যতামূলক নয়,” বলেন হাসান আল মামুন।
তবে সরকারের কমিটির সুপারিশগুলোকে স্বাগত জানিয়েছেন বিশ্লেষকেরা।
সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বেনারকে বলেন, “এটা তো কমিটির পর্যবেক্ষণ। সেটা সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা সরকারের। সেভাবে আসলে পরিপূর্ণ হতো। তবে যা হয়েছে তা ওয়েলকাম করছি।”
“আজ যেটুকু হয়েছে তাতে বলা যায়, কিছুটা এগিয়েছে। আশা করছি এবার একটা কিছু হবে। আর মুক্তিযোদ্ধা কোটার বিষয়ে কোর্ট যেভাবে বলছে সেখানেও রিফর্ম করা যেতে পারে। কারণ কোর্ট ক্লিয়ারলি বলেননি ৩০ শতাংশ রাখতে হবে। এ বিষয়ে কোর্টকে সিদ্ধান্ত নিতে দিন.” বেনারকে বলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আতাউর রহমান।
রোববার জাতীয় জাদুঘরের সামনে আয়োজিত প্রতিবাদ সমাবেশ থেকে বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ কোটা সংস্কারের প্রজ্ঞাপন জারি করতে সরকারকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়েছিল।
এই সময়ের মধ্যে দাবি না মানলে কঠোর কর্মসূচি দেওয়ার হুঁশিয়ারিও দেয় তারা। পাশাপাশি ঈদের আগে কোটা সংস্কার আন্দোলন ও নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে গ্রেপ্তার হওয়া শিক্ষার্থীদের মুক্তির দাবি জানান আন্দোলনকারীরা।
যা আছে সুপারিশে
সোমবার দুপুরে বাংলাদেশ সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম সাংবাদিকদের বলেন, “যতটুকু সম্ভব কোটা পদ্ধতি বাদ দিয়ে আমরা মেধার ভিত্তিতে যেতে চাই। এখন আমাদের সময় এসেছে মুক্ত প্রতিযোগিতায় যাওয়ার।”
মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, মেধাকে অগ্রাধিকার দিয়ে কমিটি তাঁদের সুপারিশ প্রায় চূড়ান্ত করে ফেলেছে।
“কমিটি কোটা প্রক্রিয়া প্রায় বাতিল এবং মেধাকে অগ্রাধিকার দিয়ে সরকারি চাকরিতে নিয়োগ দেওয়ার সুপারিশ করেছে,” বলেন তিনি।
তবে মুক্তিযোদ্ধা কোটা সংরক্ষণ নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের রায় বা পর্যবেক্ষণ রয়েছে, যাতে প্রার্থী পাওয়া না গেলে মুক্তিযোদ্ধা কোটা খালি রাখার কথা বলা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, “কমিটি নিজেরাও এই রায় বিশ্লেষণ করেছিল। তবে পুরোপুরি বুঝতে পারছে না। এ জন্য এ ব্যাপারে সরকারের পক্ষ থেকে উচ্চ আদালতের মতামত নেওয়া হবে। কোর্ট যদি মুক্তিযোদ্ধা কোটা সংরক্ষণের পক্ষে রায় দেয় তাহলে এই অংশ রাখা হবে এবং অন্য কোটাগুলো উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে।”
তিনি বলেন, “আদালতের যে কোনো নির্দেশনা বা পর্যবেক্ষণ আমাদের জন্য বাধ্যতামূলক। আমরা কখনো তা অবজ্ঞা করতে পারি না।”
কোটা ছাড়া পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী কীভাবে সামনে আসবে- এমন প্রশ্নে জবাবে শফিউল আলম বলেন, “কমিটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখেছে, তারাও (পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী) অনেক অগ্রসর হয়েছেন।”
প্রসঙ্গত, বিদ্যমান ব্যবস্থায় প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে ৫৫ শতাংশ অগ্রাধিকার কোটায় (৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা, ১০ শতাংশ নারী, ১০ শতাংশ জেলা কোটা ও ৫ শতাংশ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কোটা) নিয়োগের বিধান আছে। মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ হয় বাকি ৪৫ শতাংশ।
এ ছাড়া তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির চাকরির ক্ষেত্রে পোষ্য, আনসার-ভিডিপিসহ আরও কিছু কোটা রয়েছে। বিদ্যমান এই কোটা সংস্কার করার দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে আসছেন শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রার্থীরা।
গত ৮ এপ্রিল শাহবাগ এলাকায় আন্দোলনকারীদের ওপর পুলিশ হামলা চালানোর পরে এই আন্দোলন সারা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছড়িয়ে পড়ে। আন্দোলন চলাকালে গত ১১ এপ্রিল জাতীয় সংসদে কোটা বাতিলের ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি না হওয়ায় আবারও আন্দোলন শুরু করে শিক্ষার্থীরা।
এই পর্যায়ে আন্দোলনকারীদের ওপর লাগাতারভাবে হামলা চালায় ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। অনেকেই পুলিশের হাতে আটক হন।
পত্রিকার তথ্যানুযায়ী, গত ৩০ জুন থেকে পরের এক সপ্তাহ ধরে চলা এসব হামলায় ১২ জন আন্দোলনকারী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। ১ জন পুলিশের হাতে আটক হন। একাধিক মামলায় সাতজন শিক্ষার্থী এখনো কারাগারে রয়েছেন।