নিখোঁজ: এক দশকে ঘরে ফেরা ৫১ জনের সবাই চুপ
2017.11.20
ঢাকা

৮১ দিন রহস্যজনক নিখোঁজ থাকার পর গত শুক্রবার ভোরে বাড়ি ফিরেছেন ধনাঢ্য ব্যবসায়ী ও বেলারুশের অনারারি কনসাল অনিরুদ্ধ রায়। তাঁর আগে একই কায়দায় নিখোঁজ হয়ে ফিরে আসা ব্যক্তিদের মতো অনিরুদ্ধ রায়ও মুখ খোলেননি। ফলে এই নিখোঁজ রহস্যেরও কোনো সুরাহা হলো না।
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসেবে, ২০০৭ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৭ সালের অক্টোবর পর্যন্ত গুম হয়েছেন ৫৪৫ ব্যক্তি। লাশ উদ্ধার হয়েছে ৭৮ জনের এবং অপহরণের পর ফিরে এসেছেন ৫১ জন। যাঁরাই রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হয়েছেন এবং ফিরে এসেছেন তাঁরা গণমাধ্যম এড়িয়ে চলছেন। ফিরে আসা অনিরুদ্ধ রায় পুলিশের সঙ্গেও কথা বলতে রাজি হচ্ছেন না।
“অনিরুদ্ধ রায় রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হওয়ার পর তাঁর ভাগনে গুলশান থানায় একটা সাধারণ ডায়েরি করেছিলেন। বিষয়টি আমি তদন্ত করছিলাম। আমাকে তাঁর পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হলো তিনি ফিরেছেন। দেখা করার প্রস্তাব দিলে তাঁরা আর রাজি হননি,” বেনারকে বলেন গুলশান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবু বকর সিদ্দিক।
অনিরুদ্ধ রায়ের স্ত্রী শাশ্বতী রায় বেনারকে বলেন, “অনিরুদ্ধ রায় ভালো আছেন। শুক্রবার ভোরের দিকে বাসায় ফিরেছেন। যে কাপড়ে তিনি নিখোঁজ হয়েছিলেন, ফিরেছেনও একই কাপড়ে।”
অনিরুদ্ধ রায়ের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তিনি বলেন, “যা বলার তিনি নিজেই বলবেন।”
তবে শেষ পর্যন্ত অনিরুদ্ধ গণমাধ্যমের মুখোমুখি হননি। তাঁর ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে সাংবাদিকদের একটি চিঠি দেওয়া হয়। এতে বলা হয়, ব্যবসায় অংশীদারের সঙ্গে বিরোধকে কেন্দ্র করে তিনি অপহৃত হয়ে থাকতে পারেন বলে আশঙ্কা রয়েছে।
ফিরে এসেই চুপ
গত তিন মাসে রাজধানী ঢাকা থেকে ১২ জন নিখোঁজ হন। অনিরুদ্ধ রায়সহ তাঁদের তিনজন ফিরে এসেছেন। তিনজনকে পুলিশ গ্রেপ্তার দেখিয়েছে। ফিরে আসা তিনজনের কেউ সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেননি।
গত ২৩ আগস্ট বেসরকারি আইএফআইসি ব্যাংকের অ্যাসিস্ট্যান্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট দুপুরের খাবার খেতে অফিস থেকে বেরিয়ে মতিঝিল এলাকা থেকে অপহৃত হন। ওই ঘটনায় তাঁর স্ত্রী শিল্পী আহমেদ মতিঝিল থানায় নিখোঁজ ডায়েরি করেন। পাঁচ দিন পর শামীম আহমেদ বাড়ি ফিরে আসেন। এরপর টানা কয়েক দিন তিনি বাসায় ছিলেন না।
তাঁর স্ত্রী শিল্পী আহমেদ বেনারকে বলেন, “শামীম সুস্থ আছে। তিনি ফিরে এসেছেন। এতেই আমরা খুশি। আর কিছু বলতে চাই না।”
গত ২৬ সেপ্টেম্বর ঢাকার উত্তরা থেকে রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হন জামালপুরের সরিষাবাড়ী পৌরসভার মেয়র রুকনুজ্জামান রুকন। দুদিন পর মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল থেকে তাঁকে উদ্ধার করা হয়।
মুঠোফোনে রুকনুজ্জামান বেনারকে বলেন, “অনেকেই পারিবারিক দ্বন্দ্বের কারণে আমার নিখোঁজ হওয়ার কথা প্রচার করার চেষ্টা করেন। এটা সত্য নয়।”
সত্যটা তাহলে কি—এমন প্রশ্নের জবাব মেয়র এড়িয়ে যান।
“আমি আসলে কিছু মনে করতে পারছি না। আমি যখন পার্কে হাঁটছিলাম তখন কাছেই একটা দামি গাড়ি দাঁড়িয়েছিল। একদল আমাকে ওই গাড়িতে তোলে। এরপর কিছু মনে নেই। সুস্থ হলে আমি নিজেই সংবাদ সম্মেলন করে কথা বলব,” রুকনুজ্জামান বলেন।
এ বছর রহস্যজনকভাবে যাঁরা নিখোঁজ হয়েছেন তাঁদের মধ্যে আলোচনার শীর্ষে ছিলেন কবি ও রাজনৈতিক ভাষ্যকার ফরহাদ মজহার। তিনি ক্ষমতাসীন সরকারের কড়া সমালোচক। ‘অপহরণের’ আগের দিনও জাতীয় প্রেসক্লাবে আলোচনা সভায় কথা বলেছেন।
গত ৩ জুলাই ফরহাদ মজহার অপহৃত হয়েছেন বলে তাঁর স্ত্রী আদাবর থানায় বাদী হয়ে অপহরণ মামলা দায়ের করেন। সে সময় তাঁর স্ত্রী ফরিদা আখতার সংবাদমাধ্যমকে বলেন, “ফরহাদ মজহার ভোর সাড়ে ৫টার দিকে ফোনে ভয়ার্ত গলায় তাঁকে বলেন, “ওরা আমাকে নিয়ে যাচ্ছে, ওরা আমাকে মেরে ফেলবে।”
এর মধ্যে গত ১৩ নভেম্বর পুলিশ ফরহাদ ও তাঁর স্ত্রী ফরিদা আখতারের বিরুদ্ধে মিথ্যা তথ্য দিয়ে মামলা করার অভিযোগ দায়ের করেছে আদালতে। ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের যুগ্ম কমিশনার আবদুল বাতেন সাংবাদিকদের বলেছেন, “তদন্তে দেখা গেছে তিনি অপহৃত হননি।”
ফরহাদ মজহারও ভোর সাড়ে ৫টা থেকে বিকেল ৪টায় খুলনা নিউমার্কেটে পৌঁছানোর আগে তিনি কোথায় ছিলেন, সত্যিই কেউ তাঁকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল কি না এমন প্রশ্নের কোনো জবাব দেননি। তিনি আইনজীবীর মাধ্যমে কথা বলবেন বলে জানান তাঁর স্ত্রী ফরিদা।
এর আগে প্রায় সাত মাস অজ্ঞাতস্থানে থাকার পর বাড়ি ফেরেন চিকিৎসক ইকবাল মাহমুদ। ঢাকার সায়েন্স ল্যাবরেটরি থেকে তাঁকে অপহরণ করা হয়। তাঁর বাবা একেএম নুরুল আলম দু দফা সংবাদ সম্মেলন করে বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাঁর ছেলেকে উঠিয়ে নিয়ে গেছে।
গত ৩০ এপ্রিল চোখ ও হাতবাঁধা অবস্থায় তাঁকে কে বা কারা লক্ষ্মীপুরে তাঁর বাড়ির কাছে ফেলে রেখে যায়। বাবা নুরুল আলম বা ছেলে ইকবাল মাহমুদ অপহরণের পর কোথায় ছিলেন সে সম্পর্কে কথা বলেননি।
নুরুল আলম সাংবাদিকদের বলেন, “ছেলেকে ফিরে পেয়েই খুশি। কারও বিরুদ্ধে তাঁর কোনো রাগ নেই। আমি বিচারও চাই না।”
কেন কথা বলেন না?
২০১৪ সালের ১৬ এপ্রিল বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের স্বামী ব্যবসায়ী আবু বকর সিদ্দিক অপহৃত হন। ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোড থেকে অপহরণের ৩৪ ঘণ্টা পর তাঁকে চোখ বাঁধা অবস্থায় কে বা কারা মিরপুরে নামিয়ে দিয়ে যায়। তাঁর পকেটে যাতায়াত খরচ বাবদ তিন শ টাকাও গুঁজে দেয় অপহরণকারীরা।
আবু বকর সিদ্দিক ও সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান কেউই এরপর এই ঘটনা নিয়ে বিস্তারিত কিছু বলেননি। গত রোববার সৈয়দা রিজওয়ানা কথা বলেন বেনারের সঙ্গে।
“একটা অপহরণের ঘটনাই যদি প্রথম ও শেষ অপহরণের ঘটনা ঘটতো তাহলে মানুষ মুখ খুলত। একটা অপহরণের ঘটনার রেশ না কাটতেই যখন সাতটা মানুষ গুম হয়ে যান, তখন আপনি কি করে কথা বলবেন। মানুষের মধ্যে সারাক্ষণ কোনো না কোনো বিপদের আশঙ্কা, এ জন্য কেউ কেউ মুখ খোলে না,” বলেন সৈয়দা রিজওয়ানা।
রাষ্ট্রকে উদ্যোগ নিতে হবে
অজ্ঞাতস্থান থেকে ফিরে এসেছেন এমন কমপক্ষে পাঁচজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, তাঁরা কারও কাছে কখনো রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হওয়া প্রসঙ্গে কিছু বলবেন না এমন শর্তে ছাড়া পেয়েছেন। ব্যক্তিগত ও পারিবারিক নিরাপত্তার স্বার্থে তাঁরা এই শর্ত মেনে নিয়েছেন।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক শিপা হাফিজা বেনারকে বলেন, “যাঁরা রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হয়ে যাচ্ছেন, তাঁদের কারা তুলে নিয়ে গেল, কোথায়-কীভাবে রাখল সে বিষয়ে রাষ্ট্রকে তদন্ত করে দেখতে হবে।”
তিনি বলেন, “রক্ষাকর্তারা যখন বলেন, ব্যক্তিগত কারণে মানুষ নিজে নিজে হারিয়ে যাচ্ছেন, আত্মগোপনে চলে যাচ্ছেন এবং ফিরে আসছেন তখন তাঁদের ব্যাপারে পূর্ণাঙ্গ তথ্য দেওয়ার দায়িত্ব রাষ্ট্রের ওপরই বর্তায়। সরকার এ বিষয়ে একটা স্বাধীন কমিশন করতে পারে।”
এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বেনারকে বলেছেন, “স্বাধীন কমিশন করা যেতে পারে। এ ধরনের প্রস্তাব পেলে তা বিবেচনা করে দেখা হবে।”