মানবাধিকার সমুন্নত রেখে দায়িত্ব পালনে র্যাব প্রধানের নির্দেশ ‘কথার কথা’
2024.06.24
ঢাকা

র্যাবের নতুন মহাপরিচালক হারুন অর রশীদ এই বাহিনীর সদস্যদের মানবাধিকার ও জেন্ডার সংবেদনশীলতা সমুন্নত রেখে দায়িত্ব পালন করার কথা বলছেন। তাঁর এই নির্দেশনাকে ''কথার কথা'' হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন মানবাধিকার কর্মীরা।
মানবাধিকার কর্মীদের মতে, গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় থাকা র্যাবের ভাবমুর্তি পুনরুদ্ধার এবং আন্তর্জাতিকভাবে এই বাহিনীকে গ্রহণযোগ্য করার প্রয়াসের অংশ হিসাবে রোববার দায়িত্ব গ্রহনকালে নতুন মহাপরিচালক এমন মন্তব্য করেছেন।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক মিজানুর রহমান সোমবার বেনারকে বলেন, “র্যাবের সাবেক মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ এই বাহিনীকে যেভাবে গুম-খুনসহ বিভিন্ন অপরাধের জন্য ব্যবহার করেছেন, সেই প্রেক্ষাপটে নতুন ডিজির মানবাধিকার রক্ষা, আইনের শাসন ও জেন্ডার সংবেদনশীলতার বিষয়টি উল্লেখ ছাড়া আর কিছুই বলার উপায় নেই।”
তিনি বলেন, “মার্কিন অবরোধের পর র্যাবের বিরুদ্ধে অভিযোগ কমেনি, তবে দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যা কমেছে।”
“আন্তর্জাতিকভাবে র্যাব এখন একটি বিতর্কিত বাহিনী এবং বাহিনী প্রধান হিসাবে উনি চান এসব বিতর্কের অবসান হোক। হয়তো সে কারণেই কথাগুলো বলা,” যোগ করেন তিনি।
ড. মিজান বলেন, “মানবাধিকার ও জেন্ডার সংবেদনশীলতা রক্ষা, আইনের মধ্যে থেকে দায়িত্ব পালন করার মতো বিষয়গুলো নিশ্চিত করতে দরকার আইনের শাসন, যা দেশে নেই বললেই চলে। এই অবস্থায় কথাগুলো বাস্তবায়ন হবে বলে আমার মনে হয় না।”
২০১৩ সালে র্যাবের হাতে সাজেদুল ইসলাম সুমনসহ আট বিএনপি নেতা-কর্মী নিখোঁজ হন বলে বেনারকে জানান সুমনের বোন সানজিদা ইসলাম।
তিনি র্যাব-পুলিশের হাতে গুম, খুনের শিকার পরিবারের সদস্যদের প্ল্যাটফরম ‘মায়ের ডাক’ এর সমন্বয়ক।
সানজিদা সোমবার বেনারকে বলেন, “র্যাব মহাপরিচালক মানবাধিকার রক্ষার যে নির্দেশনা দিয়েছেন সেটি বিশ্বাস করার কারণ নেই।”
তিনি বলেন, “র্যাবের সাবেক ডিজি হিসাবে বেনজীর সাহেবের বক্তব্য শুনে দেখবেন উনি মানবাধিকার রক্ষা, দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সের কথা বলেছেন। কিন্তু সেগুলোর বাস্তবায়ন দেশের মানুষ দেখেছে? বরং যাদের বিরুদ্ধে গুম-খুনের সুস্পষ্ট অভিযোগ আছে তাদের পুরস্কৃত করা হয়েছে। ”
সানজিদা বলেন, “তবে র্যাব-পুলিশকে জবাব দিতে হবে, ৭১০ জন মানুষকে যে গুম করা হয়েছে তারা কোথায়? তাদের ভাগ্যে কি ঘটেছে। ”
মানবাধিকার কর্মীদের অভিযোগ প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান সোমবার বেনারকে বলেন, “ঢালাওভাবে বলা হয় যে, র্যাব-পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে আইন লঙ্ঘনের জন্য কোন তদন্ত হয় না, ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। আসলে বিষয়টি সঠিক নয়।”
তিনি বলেন, “আমরা কেউই আইনের উর্ধে নয়। র্যাব-পুলিশ সদস্যরাও নয়। যেসব অভিযোগ উত্থাপিত হয়, সেগুলোর প্রত্যেকটি আলাদা আলাদাভাবে তদন্ত করে দেখা হয়।”
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “যেসব অভিযোগ তদন্ত করে সত্যতা পাওয়া গেছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। আমি এখন প্রকৃত সংখ্যা জানাতে পারবো না। তবে একথা নিশ্চিত করে বলতে পারি, বেশ কয়েকজন পুলিশ-র্যাব সদস্য আইন লঙ্ঘনের দায়ে কারাগারে রয়েছেন।”
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মতে, র্যাব দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, জঙ্গিবাদ প্রতিরোধসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজ ঠেকিয়ে দেশকে নিরাপদ রাখতে নিরলস কাজ করে যাচ্ছে।
অপরাধীদের তৎপরতা ঠেকাতে ২০০৪ সালে প্রতিষ্ঠা হয় র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। বিএনপি সরকারের সময়ে র্যাব গঠনের তীব্র বিরোধীতা করে সেই সময়ের বিরোধীদল এবং বর্তমান ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ।
তবে প্রথমদিকে সাধারণ মানুষ র্যাবের কার্যক্রমে খুশি ছিল। র্যাব সদস্যদের বিতর্কিত অস্ত্র উদ্ধার অভিযানে একের পর এক প্রাণ হারাতে থাকে খুনী, চাঁদাবাজ, ধর্ষকসহ বিভিন্ন অপরাধী। পরে র্যাবের বিরুদ্ধেই বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ ওঠে।
২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল ঢাকা-নারায়ণগঞ্জের লিংক রোড এলাকা থেকে তখনকার নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামসহ পাঁচজনকে অপহরণ করে র্যাব সদস্যরা। অপহরণের বিষয়টি দেখে ফেলায় আইনজীবী চন্দন সরকার এবং তাঁর গাড়িচালক ইব্রাহিমকে অপহৃত হন। পরবর্তীতে তাদের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়, যা সারা দেশে তুমুল সমালোচনার জন্ম দেয়।
ওই ঘটনায় দায়ের করা দুই মামলায় ২০১৬ সালে র্যাব কমাণ্ডারসহ ২৬ জনকে মৃত্যুদণ্ড এবং নয়জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেয় আদালত। মামলাটির কার্যক্রম এখনও চলমান।
২০১৮ সালের ২৬ মে কক্সবাজার জেলার টেকনাফে মাদক বিরোধী অভিযানের অংশ হিসাবে সেখানকার কাউন্সিলর ইকরামুল হককে ডেকে নিয়ে কাছ থেকে গুলি চালিয়ে হত্যা করে র্যাব সদস্যরা।
এমন চাঞ্চল্যকর বেশ কয়েকটি ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিল র্যাব।
২০২১ সালের ১০ ডিসেম্বর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র র্যাব এবং বাহিনীর সাত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অবরোধ আরোপ করে। এই অবরোধের পর দেশে বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড রাতারাতি ব্যাপকভাবে কমে আসে।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুসারে ২০২১ সালে র্যাব-পুলিশের হাতে মোট ৮০ ব্যক্তি প্রাণ হারায় যার মধ্যে র্যাবের “আত্নরক্ষার্থে ছোঁড়া গুলিতে” নিহত হন ৩০ জন।
র্যাব-পুলিশের হাতে ২০২২ সালে মোট বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে ১৯টি যার মধ্যে র্যাবের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে ছয়জনের ক্ষেত্রে।
২০২৩ সালে মোট বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে ২০টি যার মধ্যে মাত্র তিনটিতে র্যাবের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে।
মানবাধিকার কর্মী ও আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া সোমবার বেনারকে বলেন, “র্যাবের গঠনই বিতর্কিত ও বেআইনি। র্যাব গঠন কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না-উচ্চ আদালতে এমন একটি রিট মামলা চলমান। ড. কামাল হোসেন এই রিট করেছেন। আমিও মনে করি র্যাব বাহিনী গঠন সঠিক হয়নি।”
জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, “যে বাহিনীর গঠনই বেআইনি সেই বাহিনীর কাছে মানবাধিকার রক্ষা, জেন্ডার সংবেদনশীলতা আশা করা যায় না।”