ঢোলের বাদ্যে সেহরিতে জাগে কাশ্মীরের গ্রাম
2017.06.22
শ্রীনগর, ভারত

মাঝরাতে যখন বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে কাশ্মিরের রাস্তায় টহল দিয়ে বেড়ায় নিরাপত্তারক্ষীদের গাড়ি, তখন সেহরিতে মানুষকে জাগানোর জন্য রাতের নীরবতা ভেঙে বেজে ওঠে সাইফ উদ্দিন খাতানার ঢোল।
নিজের গ্রাম কুপওয়ারায় ‘সেহর খান’ নামে পরিচিত এই কাজে ৩৮ বছরের খাতানা জড়িত আছেন চার বছর। কাশ্মীরের চলমান অস্থিরতা মধ্যেও থামেনি তাঁর ঢোল।
“এটা আসলেই একটা ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। কারণ, রাতে রাস্তায় বের হলে রক্ষীদের হাতে সন্দেহভাজন হিসেবে ধরা পড়ার ভয় যেমন আছে, তেমনি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বন্দুকের সামনে পড়ার ভয়ও আছে। তবে কাজটা আমাকে আনন্দ দেয়,” বেনারকে বলেন খাতানা।
তিনি বলেন, “রমজান একটি আশীর্বাদ ও ক্ষমার মাস। ঈদের আগের দিন গ্রামবাসীর কাছ থেকে সামান্য সহায়তার আশার চেয়ে বরং আমি কাজটা করি আল্লার সন্তুষ্টির জন্য।”
দুই সন্তানের জনক এই দিন মজুর রাত সাড়ে বারোটার দিকে ঢোলে চাটি মেরে শুরু করেন তাঁর কাজ। তারপর সারা গ্রাম হেঁটে বাদ্যের তালে তালে হাঁক দিয়ে নিশ্চিত করেন যেন প্রতিটি বাড়ির মানুষ সময় মতো উঠে সেহরি শেষ করতে পারেন।
তিনি বলেন “রাতে বন্য জন্তু বা রাস্তার কুকুরের ভয়ও আছে। কিন্তু রমজান মাসের এই পবিত্র দায়িত্বটার প্রতি আমার টান সবকিছুকে ভুলিয়ে দেয়। সবাই আমার জন্য দোয়া করে। আমার আর কী দরকার?”
তবে মুসলিম অধ্যুষিত কাশ্মীরে শত বর্ষের এই সেহর খান ঐতিহ্য গত দুই দশকের সহিংসতায় বেশ হুমকির মুখে আছে।
কুপওয়ারা গ্রামে লাইন অব কন্ট্রোল হিসেবে পরিচিত ভারত-পাকিস্তানের একটি সীমান্ত রয়েছে। হিমালয় উপত্যকার এই অঞ্চলটিকে ভারত ও পাকিস্তান দুই দেশই নিজেদের ভূমি বলে দাবি করে থাকে। এই অঞ্চলটিকে কেন্দ্র করে দুই দেশের মধ্যে দুটি যুদ্ধও সংঘটিত হয়ে গেছে।
আশির দশকের শেষ দিক থেকে ভারত শাসিত কাশ্মীরে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের সহিংসতায় ৭০ হাজারেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন।
এ প্রসঙ্গে বারামুল্লা জেলার অন্য এক ‘সেহার খান’ নিসার আহমদ বেনারকে বলেন, “৯০ দশকের মাঝামাঝি যখন সহিংসতা চরম পর্যায়ে ছিল এবং রমজানের রাতেও কার্ফু জারি থাকত তখন অনেকেই এই কাজ ছেড়ে দিয়েছে।”
তিনি বলেন, “তবে গত কয়েক বছরে পরিস্থিতি শান্ত হওয়ায় অনেকে আবার এই কাজটিতে ফিরেছে। এখনও অসংখ্য গ্রামে এই ঐতিহ্যটা বেশ ভালোভাবে চালু রয়েছে, তবে শহরাঞ্চলে এটি বিলুপ্তই হয়ে গেছে বলা যায়।”
৫০ বছর বয়স্ক আহমদ এই কাজটিতে জড়িত রয়েছেন ২০০১ সাল থেকে।
‘তাঁদের ভয় পাবার কিছু নেই’
মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ কাশ্মীর সম্প্রতি নতুন এক সহিংসতার আবর্তের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। গত জুলাই মাসে নিরাপত্তারক্ষীদের হাতে বিচ্ছিন্নতাবাদী এক শীর্ষ নেতা নিহত হবার পর থেকে সেখানে প্রায় প্রতিদিন বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সাথে নিরাপত্তারক্ষীদের সংঘাত হচ্ছে।
গত কয়েক মাসের লাগাতার সহিংসতায় এখন পর্যন্ত ১০০ নিহত ও কমপক্ষে দশ হাজারের বেশি লোক আহত হয়েছেন।
কাশ্মীরের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সমর্থন ও অর্থায়নের জন্য ভারত বরাবরই পাকিস্তানকে দায়ী করে থাকে। অন্যদিকে সবসময়ই পাকিস্তান এই অভিযোগ অস্বীকার করে বলে আসছে যে, কাশ্মীরে এই সংঘাত ভারতের শোষণ-নিপীড়নের বিরুদ্ধে একটি প্রতিক্রিয়া মাত্র।
বৃহস্পতিবার, ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনী দক্ষিণ কাশ্মীরের পুলওয়ামা জেলায় একটি সংঘর্ষে পাকিস্তান-ভিত্তিক সংগঠন লস্কর-ই-তৈয়বা’র তিন সন্দেহভাজন জঙ্গি নিহত হয়েছে বলে জানিয়েছে। ওই সংঘর্ষে একজন বেসামরিক ব্যক্তি নিহত ও কমপক্ষে ৭০জন আহত হয়েছেন বলে পুলিশ সূত্রে জানা যায়।
কাশ্মীরে ভারতীয় শাসনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভের অংশ হিসেবে বিচ্ছিন্নতাবাদীরা সমগ্র হিমালয় উপত্যকায় সর্বাত্মক ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে শুক্রবার।
তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পুলিশ কর্মকর্তা বেনারকে বলেন, কোনো পরিস্থিতিতেই সেহর খানদের কাজে ব্যাঘাত না ঘটাতে নিরাপত্তারক্ষীদের ওপর নির্দেশ রয়েছে।
“কোনো অবস্থাতেই তাঁদের ভয় পাবার কিছু নেই। তবে রাতে তাঁদের কাজের সময় যদি তাঁরা সন্দেহজনক কিছু লক্ষ করে, তাহলে যেন অবশ্যই তা পুলিশকে জানায়,” বলেন ওই কর্মকর্তা।
ঐতিহ্য বনাম প্রযুক্তি
কাশ্মীরের গ্রামাঞ্চলে অ্যালার্ম ঘড়ি ও মোবাইল ফোনের ব্যবহার বাড়লেও এই ঐতিহ্যটা এখনো টিকে আছে। গ্রামীণ কাশ্মীরিদের কাছে ঢোলের বাদ্যের সাথে সেহর খানদের হাঁকডাক ছাড়া রমজান মাস যেন অপূর্ণ।
“ঢোলের বাদ্যের সাথে একজন মানুষের কণ্ঠে জেগে ওঠার ডাক দারুণ লাগে আমার,” বেনারকে বলেন কুপওয়ারা জেলার বাসিন্দা মোহাম্মদ ইয়াসীন।
তবে কেউ কেউ দ্বিমতও করেন এ বিষয়ে।
এ প্রসঙ্গে শ্রীনগরের অধিবাসী ও ব্যবসায়ী নাজির আহমেদ বেনারকে বলেন, “অ্যালার্ম ঘড়ি আর সেল ফোন আসার পর শহরাঞ্চলে ঢোল বাজিয়ে ডাকার প্রয়োজনীয়তা কমে গেছে।”
তিনি বলেন, “প্রায় প্রত্যেক পরিবারে আজকাল অ্যালার্ম ঘড়ি এবং পরিবারের প্রতিটি সদস্যের একটি করে মোবাইল আছে। রমজানে সেহরির সময় জেগে ওঠার জন্য এই ডিভাইসগুলো খুব সহজেই ব্যবহার করা যায়।”