পশ্চিমবঙ্গে মুসলিমদের ধর্মান্তরকরণ কর্মসূচি নিয়েছে হিন্দু সংগঠন!
2018.02.15
কলকাতা
ভারতের পশ্চিমবঙ্গে মুসলিমদের ধর্মান্তরিত করার যে কর্মসূচি দক্ষিণপন্থী হিন্দু সংগঠন হিন্দু সংহতি প্রকাশ্যে ঘোষণা করেছে তা নিয়ে তোলপাড় চলছে। সমালোচনায় সরব রাজনৈতিক নেতা ও বিজ্ঞজনদের আশঙ্কা, এ ধরনের কর্মসূচি দেশে ধর্মীয় উত্তেজনা বাড়াবে।
তবে ইতিমধ্যে সংগঠনের প্রধানকে আটক করে রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। আর এই ঘটনার তদন্ত হবে বলে জানিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
হিন্দুবাদী সংগঠনের ধর্মান্তরকরণের প্রকাশ্য ঘোষণা প্রসঙ্গে বিশিষ্ট কবি শঙ্খ ঘোষ বেনারকে বলেন, “ধর্মীয় উত্তেজনা ছড়ানোর চেষ্টা দেশের নানা প্রান্তে নানা রকম চেহারায় চলছে। সকলের সমবেত চেতনায় এদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে না তুলতে পারলে দেশ সর্বনাশে তলিয়ে যাবে।”
তবে ধর্মান্তরিত হওয়ার মধ্যে কোনো অন্যায় নেই বলে মনে করেন হিন্দু সংহতির সভাপতি দেবতনু ভট্টাচার্য্য।
তিনি বেনারকে বলেন, “এঁরা (মুসলমানরা) একসময় হিন্দুই ছিল। এখন তারা ফিরে আসছেন।”
প্রসঙ্গত, এতদিন গোপনে মুসলমানদের ধর্মান্তরিত করার চেষ্টার কথা শোনা যাচ্ছিল। তবে বুধবার কলকাতার প্রাণকেন্দ্র ধর্মতলায় হিন্দু সংহতির প্রতিষ্ঠা দিবসে একটি মুসলিম পরিবারকে মঞ্চে হাজির করে ঘোষণা করা হয় যে, তাঁরা ঘর ওয়াপসি (ঘরে ফিরে এসেছেন) করেছেন। পরিবারটিও সেই দাবিতে সমর্থন জানায়।
কিন্তু অনুষ্ঠানস্থলে উপস্থিত সাংবাদিকেরা সেই পরিবারটির কাছে চাপের মুখে ধর্মান্তরিত হয়েছেন কিনা জানতে গেলে হিন্দু সংহতির কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবক তাঁদের মারধর করে বের করে দেয়। ধর্মান্তরিত মুসলিম পরিবারটিকেও হিন্দু সংহতির কয়েকজন নেতা গোপনে সরিয়ে নিয়ে যান।
কলকাতা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (অপরাধ) প্রবীণ ত্রিপাঠি বলেন, “সাংবাদিকদের মারধর এবং হেট স্পিচ দেওয়ার জন্য সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা ও মুখ্য উপদেষ্টা তপন ঘোষসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার অভিযুক্ত চারজনকে কলকাতার ব্যাঙ্কশাল আদালতে তোলা হলে বিচারক এদের ১৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত পুলিশ রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন।”
তপন ঘোষকে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ ধর্মান্তরিত পরিবারটির খোঁজ পাওয়ার চেষ্টা করছে বলেও জানান তিনি।
তপন ঘোষ বুধবার ধর্মতলার অনুষ্ঠান মঞ্চে দাঁড়িয়ে জানান, এত দিন তাঁরা গোপনে সংখ্যালঘুদের ধর্মান্তরকরণের কাজ চালিয়ে গেলেও এবার তা প্রকাশ্যে আনার সময় এসেছে।
পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় বেনারকে বলেন, “বাংলার সংস্কৃতিকে ধ্বংস করার চক্রান্ত চালাচ্ছে এই সব হিন্দু সংগঠন। এরা রাজ্যে অরাজকতা সৃষ্টি করতে চাইছে।”
এ পর্যন্ত কতজনকে তারা ধর্মান্তর করেছে সে হিসেব পাওয়া যায়নি। তবে ২০১৫ সালে ২৮ জানুয়ারিও পশ্চিমবঙ্গের বীরভূমে জেলার রামপুরহাটে বিশ্বহিন্দু পরিষদের এক সভায় ১৭ জন খ্রিস্টান এবং ২ জন মুসলিম পুনরায় ধর্মান্তরিত হয়েছেন বলে দাবি করা হয়েছিল।
সেই সভায় বিশ্ব হিন্দু পরিষদের নেতা প্রবীণ তোগাড়িয়াসহ শীর্ষ নেতারা হাজির ছিলেন। ওই ঘটনায় সেসব নেতাদের বিরুদ্ধে এফআইআর করে মামলা রুজু করেছিল পুলিশ।
হিন্দু সংহতির কর্মকাণ্ড
বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের মতো উগ্র হিন্দুবাদী সংগঠনের অনুপ্রেরণাতেই হিন্দু জাগরণের লক্ষ্যে এক দশক আগে একসময়ের আরএসএস প্রচারক তপন ঘোষ পশ্চিমবঙ্গে হিন্দু সংঘ সংগঠনটি তৈরি করেন। এরপর থেকে এই সংগঠনটি পশ্চিমবঙ্গের সংখ্যালঘু ও সীমান্ত এলাকায় হিন্দুত্ব প্রচার করে আসছেন বলে বেনারকে জানান হিন্দু সংহতির সঙ্গে যুক্ত এক কর্মী। তিনি অবশ্য পরিচয় প্রকাশ করতে চাননি।
গত বুধবারের সভাতেও তপন ঘোষ হিন্দুত্বের প্রচারের নামে নানা উসকানিমূলক বক্তব্য রাখেন। তিনি বলেন, “আমি আমার কর্মীদের বলছি আপনারা গ্রামে গিয়ে হুমকির মুখে একসময় যারা ধর্ম ও বিশ্বাস ত্যাগ করে ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন সেই সব মুসলমানদের মূল ধর্মে ফিরিয়ে আনুন।”
আবার অনুষ্ঠানের অন্যতম বক্তা স্বামী প্রদীপ্তানন্দ হিন্দু রাষ্ট্র স্থাপন এবং মুসলমান জনসংখ্যাকে ছাপিয়ে যেতে হিন্দু মায়েদের কাছে একটি অতিরিক্ত সন্তান উৎপাদনের আরজি জানান।
পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের এক কর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেনারকে বলেন, “তপন ঘোষের বিরুদ্ধে জাত-ধর্ম নিয়ে উসকানিমূলক বক্তব্য রাখার অনেক অভিযোগ রয়েছে। রাজ্যের কয়েক জায়গায় দাঙ্গা বাঁধানো এবং ফেসবুকে নিয়মিত উগ্র হিন্দুত্ববাদী বক্তব্য পোস্ট করার অভিযোগে তাঁকে বেশ কয়েকবার পুলিশ গ্রেপ্তারও করেছে।”
ধর্মান্তরকরণের নিন্দা
মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টির পলিটব্যুরোর সদস্য মহম্মদ সেলিম বেনারকে বলেন, “বেশ কিছুদিন ধরে ঘর ওয়াপসির নাম করে উগ্র হিন্দুবাদী সংগঠনগুলি ভারতের নানা জায়গায় সংখ্যালঘুদের জোর করে বা প্রলোভন দেখিয়ে ধর্মান্তরিত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আসলে এরা সাম্প্রদায়িক ঘৃণা ছড়িয়ে সামাজিক সম্প্রীতি নষ্ট করতে সক্রিয়।”
“পশ্চিমবঙ্গে সাম্প্রদায়িক সংগঠনগুলি তৃণমূল কংগ্রেস সরকারের আমলেই বেড়ে উঠেছে। সংঘ পরিবার ও তৃণমূল কংগ্রেসের গুন্ডাদের নিয়ে গড়া এই যৌথ বাহিনী পশ্চিমবঙ্গে সাম্প্রদায়িক হিংসা ছড়িয়ে বিভাজনের রাজনীতি করছে,” অভিযোগ করেন সেলিম।
“ভারতীয় জনতা পার্টির সরকার আসার পর থেকেই ঘর ওয়াপসির কথা শোনা যাচ্ছে। যোগী আদিত্য নাথের মতো উগ্র হিন্দু নেতারা সংখ্যালঘু, দলিত এবং উপজাতি যে সব মানুষ একসময় ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন তাঁদের হিন্দুত্বে ফিরিয়ে আনার জন্য উত্তর প্রদেশ, তেলেঙ্গানা, গোয়া প্রভৃতি রাজ্যে পুনরায় ধমান্তরকরণের কাজে সক্রিয় রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গেও যে এই কাজটি গোপনে চলছিল সেটা এবার প্রকাশ্যে জানা গেলো,” বেনারকে বলেন কলকাতার একটি কলেজের অধ্যাপক শমীন্দ্র সরকার।
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ পবিত্র সরকার বেনারকে বলেন, “উগ্র হিন্দু সংগঠনগুলি বিভেদের রাজনীতি করছে। এটা খুবই কুৎসিত ব্যাপার। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রত্যকের নিজের ধর্ম নিয়ে চলার অধিকার রয়েছে।”
“ধর্ম, ভাষা হলো পরস্পরের মধ্যে বন্ধন। সেই বন্ধনকে বিনষ্ট করার চেষ্টাকে কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না,” বলেন তিনি।