ভর্তি পরীক্ষায় সাম্প্রদায়িক প্রশ্নপত্র করায় দুই শিক্ষকের শাস্তি
2017.12.07
ঢাকা
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ভর্তি পরীক্ষায় সাম্প্রদায়িক প্রশ্নপত্র প্রণয়নের দায়ে দুই শিক্ষককে আগামী ১০ বছরের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের যেকোনো ধরনের পরীক্ষা কার্যক্রমে নিষিদ্ধ করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
বুধবার রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৭৪তম সিন্ডিকেট সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় বলে বেনারকে নিশ্চিত করেছেন সিন্ডিকেট সদস্য মো. মামুন আব্দুল কাইউম।
এই দুই শিক্ষক হলেন; চারুকলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান এবং চিত্রকলা, প্রাচ্যকলা ও ছাপচিত্র বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. জিল্লুর রহমান।
মামুন আবদুল কাইউম বলেন, “পরীক্ষা সংক্রান্ত কাজে ১০ বছরের জন্য নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। ১০ বছর তাঁরা দু’জন পরীক্ষা সংক্রান্ত কোনো কাজে জড়িত থাকতে পারবেন না।”
“নির্বাচনের মাধ্যমে ডিন নির্বাচিত হয়। বিশ্ববিদ্যালয় আইনে যদি কোনো বাধা না থাকে, তাহলে অধ্যাপক মুস্তাফিজকে এই পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হবে বলেও সিন্ডিকেটে সিদ্ধান্ত হয়,” বলেন তিনি।
“আর জিল্লুর রহমান, যিনি মূলত প্রশ্ন করেছেন তার প্রমোশন বিশ্ববিদ্যালয় বিধি অনুযায়ী যেদিন হওয়ার কথা, সেদিন থেকে পাঁচ বছর পরে হবে।”
প্রসঙ্গত, গত ২৫ অক্টোবর অনুষ্ঠিত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের ‘আই’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের দুটি প্রশ্ন সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষপূর্ণ বলে অভিযোগ ওঠে।
ওই প্রশ্ন দুটির একটি হলো; “পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থের নাম কি?” উত্তরের জন্য চারটি অপশন দেওয়া ছিল। এগুলো হলো; “(ক) পবিত্র কোরআন শরিফ (খ) পবিত্র বাইবেল (গ) পবিত্র ইঞ্জিল (ঘ) গীতা।”
উত্তরের অপশনে দেওয়া প্রতিটি ধর্মগ্রন্থই বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের কাছে শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ বলে বিবেচিত। ফলে এখান থেকে কোনো একটিকে শ্রেষ্ঠ হিসেবে বাছাই করতে বলা সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গীর প্রতিফলন বলে সমালোচনা শুরু হয়।
এছাড়া প্রশ্নপত্রে বাকিসব ধর্মগ্রন্থের আগে ‘পবিত্র’ কথাটা যোগ করা হলেও হিন্দু ধর্মগ্রন্থ গীতার আগে ‘পবিত্র’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়নি।
অপর প্রশ্নটি ছিল; “মুসলমান রোহিঙ্গাদের উপর মায়েনমারের (মিয়ানমার) সেনাবাহিনী ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা সশস্ত্র হামলা চালায় কত তারিখে?”
পরীক্ষা পরপরই এ প্রশ্ন দুটি নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়। এরপর গত ২৮ অক্টোবর এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক আনন্দ কুমার সাহাকে প্রধান করে চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে কর্তৃপক্ষ। এই তদন্ত কমিটির অন্যান্য সদস্যরা হলেন ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক মো. শহীদুল্লাহ, ফলিত পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আবু বকর মো. ইসমাইল এবং রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক নজরুল ইসলাম।
ওই তদন্ত কমিটির দেওয়া প্রতিবেদনের প্রেক্ষিতেই দুজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থার সিদ্ধান্ত নিল সিন্ডিকেট।
সিন্ডিকেট সদস্য মামুন আব্দুল কাইউম বেনারকে বলেন, “তদন্তে উঠে এসেছে প্রশ্নপত্র তৈরিতে সংশ্লিষ্টদের মধ্যে কোনো কো-অর্ডিনেশন ছিল না। তারা এক ধরনের বিশৃঙ্খল অবস্থার মধ্যে ছিলেন। এ জন্য সঙ্গে অন্য যারা জড়িত ছিলেন, বিশেষ করে মডারেশনে, তাদের সতর্ক করা হবে।”
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা ও সংগীত বিভাগের অধ্যাপক মলয় কুমার ভৌমিক বেনারকে বলেন, “এই ঘটনায় দ্রুততার সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিয়েছে। তবে বিষয়টি শুধু প্রশ্নপত্র প্রণয়ন সংক্রান্ত নয়, এটি একটি সাম্প্রদায়িক কানেকশন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় যা করতে পারত, তা করেছে।”
“তবে এ বিষয়ে হাইকোর্টে একটি রিট হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে আদালত জানতে চেয়েছে তারা কী ব্যবস্থা নিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয় হয়ত এবার ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়টি কথা আদালতকে জানাবে। তবে বিষয়টি এখানেই শেষ হবে না। কারণ, এটি এখন একটি বিচারাধীন বিষয়। উচ্চ আদালতের এখতিয়ার,” বলেন তিনি।
মলয় ভৌমিক বলেন, “এখন কোর্টের কাছ থেকেই প্রত্যাশা করব, সংবিধান পরিপন্থী কোনো কাজ ঘটেছে কিনা আদালত নির্ধারণ করবেন। সংবিধান অমান্য করে তারা যদি শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেন তাহলে কোর্টই শাস্তি দেবে।”
প্রসঙ্গত, ঘটনার কয়েক দিনের মাথায় গত ৩১ অক্টোবর সাম্প্রদায়িক বিভেদ সৃষ্টিকারী প্রশ্ন প্রণয়নে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে কেন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করে উচ্চ আদালত। জড়িতের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে, তার প্রতিবেদন দাখিল করতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে ৩০ দিন সময় নির্ধারণ করে দেওয়া হয়।