প্রবাসী আয় পাঠাতে মাশুল নেবে না সরকার
2017.05.15
ঢাকা

গত ১০ মাসে রেমিট্যান্স (প্রবাসী আয়) প্রবাহ কমে যাওয়ায় শঙ্কিত হয়ে পড়েছে সরকার। এই প্রেক্ষাপটে প্রবাসী আয় পাঠানোর খরচ মওকুফ করে দেওয়াসহ বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে সরকার। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত গত শনিবার সাংবাদিকদের এ কথা জানান।
অর্থমন্ত্রী জানান, ২০১৭-১৮ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে এ-সংক্রান্ত একগুচ্ছ ঘোষণা আসছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা অনুযায়ী এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ৩০ মে সংসদের বাজেট অধিবেশন শুরু হবে।
সরকারি হিসেবে, বাংলাদেশের দেশজ জাতীয় আয়ে (জিডিপি) প্রায় ১২ শতাংশ অবদান রাখে রেমিট্যান্স। অথচ চলতি অর্থবছরের ১০ মাসের হিসাবে প্রবাসীদের আয় কমেছে ১৬ শতাংশ। রেমিট্যান্সের এই প্রবাহ কমে যাওয়াকে সামগ্রিক অর্থনীতির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছে বিশ্বব্যাংক।
তবে রেমিট্যান্স পাঠাতে মাশুল না নেওয়ার উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা। এতে করে প্রবাসীরা বৈধ পথে টাকা পাঠাতে আগ্রহী হবেন বলে মনে করছেন তাঁরা। তবে এই সুবিধা যাতে সরাসরি প্রবাসী শ্রমিকরাই নিতে পারেন সে বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়ার পক্ষে তাঁরা মত দিয়েছেন।
এ প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদ মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “রেমিট্যান্স কমে যাওয়ার জন্য হুন্ডি এবং মধ্যপ্রাচ্যের তেলের দাম কমে যাওয়াকে দায়ী করা হয়। তবে বিনা খরচে রেমিট্যান্স পাঠানো হলে বৈধ পথে অর্থ আসার প্রবাহ বাড়বে।”
তাঁর মতে, এ ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোকে প্রণোদনা দেওয়া অর্থহীন হবে। প্রণোদনা দিলেও তারা বেশি রেমিট্যান্স আনবে এমন নিশ্চয়তা নেই। আর যদি মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর অর্থনৈতিক মন্দাই রেমিট্যান্স কমার কারণ হয়, তাহলে প্রণোদনা দিয়েও কোনো লাভ নেই।”
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিটের চেয়ারপারসন অধ্যাপক ড. তাসনিম সিদ্দিকী বেনারকে বলেন, “সরকার যদি প্রণোদনা দিয়ে রেমিট্যান্স আনতে পারে, তাহলে সেটি ভালো উদ্যোগ। তবে এই প্রণোদনা ব্যাংকগুলোকে না দিয়ে সরাসরি অভিবাসী শ্রমিকদের দেওয়া উচিত। অর্থাৎ বৈধভাবে নির্দিষ্ট পরিমাণ রেমিট্যান্স পাঠালে শ্রমিকদের নির্দিষ্ট প্রণোদনার ব্যবস্থা রাখা উচিত।”
প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ব্যবস্থা
গত শনিবার সচিবালয়ে অর্থনীতি বিষয়ক সাংবাদিকদের সংগঠন ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের (ইআরএফ) সঙ্গে অনুষ্ঠিত প্রাক-বাজেট আলোচনায় এ বিষয়ে কথা বলেন অর্থমন্ত্রী। মন্ত্রী জানান, বর্তমানে ১০০ টাকার সমপরিমাণ রেমিট্যান্স দেশে পাঠাতে এক টাকা খরচ হয়।
আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, “রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়াতে প্রধানমন্ত্রী কিছু নির্দেশনা দিয়েছেন। তিনি রেমিট্যান্সের ওপর চার্জ না করার পরামর্শ দিয়েছেন। তাঁর নির্দেশনায় আগামী বাজেটে আমরা কিছু করব যাতে খরচটা না লাগে।”
রেমিট্যান্স কমে যাওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করে অর্থমন্ত্রী বলেন, “আগে প্রবাসীরা আয়ের সবটুকু অর্থ দেশে পাঠিয়ে দিতেন, এখন কিছু কিছু নিজেদের জন্যও রেখে দেন।”
দেশের সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে নির্দিষ্ট পরিমাণ মাশুলের বিনিময়ে রেমিট্যান্স পাঠান প্রবাসীরা। এই মাশুল কীভাবে সমন্বয় করা হবে, সে বিষয়ে সুস্পষ্ট ধারণা দেননি অর্থমন্ত্রী।
১০ মাসে ১৬ শতাংশ কমেছে
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব বলছে, গত মাসে (এপ্রিল) রেমিট্যান্স আসে ১০৯ কোটি ২৬ লাখ ডলার। মার্চের তুলনায় এই পরিমাণ বেশি। মার্চে এই পরিমাণ ছিল ১০৭ কোটি ৭৫ লাখ ডলার। একক মাসের হিসাবে গত পাঁচ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম রেমিট্যান্স আসে গত ফেব্রুয়ারিতে, মাত্র ৯৪ কোটি ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, গত ২০১৫-১৬ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) দেশে প্রবাসী আয় ছিল ১ হাজার ২২৫ কোটি ডলার। চলতি ২০১৬-১৭ অর্থবছরের একই সময়ে তা কমে হয়েছে এক হাজার ২৮ কোটি ৭২ লাখ (১০.২৮ বিলিয়ন) ডলারে। সে হিসাবে এই ১০ মাসে প্রবাসী আয় কমেছে ১৬ শতাংশ।
রেমিট্যান্স কমার পেছনে মধ্যপ্রাচ্যের বৈশ্বিক বাজারে তেলের মূল্য কমে যাওয়ায় এ অঞ্চলের দেশগুলোর অর্থনীতির দুর্বল হওয়া, টাকার দরপতন ও অবৈধ উপায়ে টাকা পাঠানোর মাধ্যম হুন্ডিকে দায়ী করছেন অর্থনীতিবিদরা।
প্রসঙ্গত, মধ্যপ্রাচ্যের ছয়টি দেশ সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, ওমান, কুয়েত ও বাহরাইন থেকে বাংলাদেশের মোট রেমিট্যান্সের অর্ধেকের বেশি আসে। কিন্তু সৌদি, আমিরাত, বাহরাইনসহ কয়েকটি দেশে অবস্থান করা বাংলাদেশিরা ভালো নেই বলে মনে করছে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়।
অর্থনীতির জন্য চ্যালেঞ্জ: বিশ্বব্যাংক
প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যাওয়াকে সামগ্রিক অর্থনীতির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছে বিশ্বব্যাংক। গতকাল রোববার বিশ্বব্যাংক ঢাকা কার্যালয়ের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের অর্থনীতির হালনাগাদ তথ্য তুলে ধরতে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা জানান সংস্থাটির মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অভিবাসন ও অ্যান্টি মানি লন্ডারিংয়ের বিষয়ে কড়াকড়ি আরোপের কারণে রেমিট্যান্স কমে গেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমে যাওয়াকে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমার অন্যতম কারণ মনে করা হলেও এর সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করে বিশ্বব্যাংক।
প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব জাবেদ আহমেদ বেনারকে বলেন, “অর্থমন্ত্রীর সিদ্ধান্তকে আমরা ইতিবাচকভাবে দেখছি। এখন ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে টাকা পাঠাতে যে খরচ হচ্ছে ভবিষ্যতে এটা আর লাগবে না। সরকার সেখানে ভর্তুকি দেবে। এতে করে প্রবাসীরা বৈধ চ্যানেলে টাকা পাঠাতে আগ্রহী হবে।”