শ্রমিকেরা বিক্ষুব্ধ, মালিকেরা অনড়, ৫৯টি গার্মেন্টস কারখানা বন্ধ
2016.12.21

টানা নয় দিনের শ্রমিক অসন্তোষের ঘটনায় ঢাকার অদূরে সাভারের আশুলিয়ার পোশাক তৈরির ৫৯টি বড় কারখানা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দিয়েছেন মালিকেরা। গত মঙ্গল ও বুধবার এই ঘোষণা দেয় তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ।
শ্রমিকেরা যাতে বিশৃঙ্খলা না করতে পারেন, সে জন্য গতকাল বুধবার সকাল থেকেই আশুলিয়ার শিল্পাঞ্চলে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়। কারখানা এলাকায় মোতায়েন করা হয় বিপুলসংখ্যক পুলিশ। বিজিবি ও র্যাবের সদস্যরাও টহল দেন। বন্ধ করে দেওয়া হয় আবদুল্লাহপুর-বাইপাইল সড়কে ভারী যান চলাচল।
কড়া নিরাপত্তায় থমথমে পরিস্থিতির মধ্যেই শ্রমিকদের মিছিল-মিটিং থেকে বিরত রাখার জন্য মাইকে ঘোষণা দেওয়া হয়। বলা হয়, মিছিল-মিটিংয়ের চেষ্টা করলে ‘আইনানুগ ব্যবস্থা’ নেওয়া হবে।
অবশ্য এসবের মধ্যেই সকালে নরসিংহপুর এলাকায় পুলিশের সঙ্গে শ্রমিকেরা সংঘর্ষে জড়ান। উভয় পক্ষের মধ্যে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া ও ইটপাটকেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটলেও কেউ হতাহত হয়নি।
পোশাক শ্রমিকের অনেকেই দাবি না মানা পর্যন্ত কাজে যোগ দিতে চান না। তবে আন্দোলনে সায় নেই শ্রমিকদের একটি বড় অংশের। বরং কারখানা খুলে দিলেই তারা খুশি।
পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান মঙ্গলবার বিকালে এক সংবাদ সম্মেলনে অনির্দিষ্টকালের জন্য কারখানা বন্ধ রাখার ঘোষণা দিয়ে বলেন, শ্রমিকেরা কাজে যোগ না দিলে অনুপস্থিত দিনের বেতন পাবে না।
বিজিএমইএর ওই সিদ্ধান্ত বুধবার থেকেই কার্যকর করা হয়। বুধবার সকালে কারখানায় এসে নোটিশ দেখে ফিরে যান বন্ধ কারখানাগুলোর অনেক কর্মী।
শ্রম প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নু বেনারকে বলেন, “মালিক ও শ্রমিকদের সঙ্গে আলোচনা করে সুষ্ঠু সমাধানের সব ধরনের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। খুব শিগগির সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে বলে আশা করছি।”
যেসব দাবিতে আন্দোলন
আন্দোলনরত শ্রমিকদের দাবিগুলো হলো; সর্বনিম্ন বেতন ৫ হাজার ৩০০ টাকা থেকে বৃদ্ধি করে ১৬ হাজার টাকা করা; কারখানার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা; দুপুরে খাবার ও যাতায়াত ভাতা বৃদ্ধি; ছুটির দিনে ওভার টাইম বিল দ্বিগুণ করা; যখন-তখন শ্রমিক ছাঁটাই বন্ধ করা ইত্যাদি।
একাধিক শ্রমিক বললেন, জিনিসপত্রের দাম বেড়ে গেছে। সরকারকে বুঝতে হবে, মজুরি বাড়ানো ছাড়া আর কোনো গতি নাই।
জানা যায়, প্রায় দুই সপ্তাহ আগে একটি শ্রমিক সংগঠনের সম্মেলন হয় জামগড়া এলাকায়। সেখানে সংগঠনের নেতারা ন্যূনতম মজুরি ১৫ হাজার টাকা করার দাবি জানান।
অন্যদিকে ১২টি শ্রমিক সংগঠনের জোট গার্মেন্টস শ্রমিক অধিকার আন্দোলনের নেতা-কর্মীরা কয়েক মাস ধরে ন্যূনতম মজুরি ১৬ হাজার (মূল বেতন ১০ হাজার) টাকা করার বিষয়ে দাবি তুলতে শ্রমিকদের সঙ্গে ঘরোয়াভাবে আলাপ-আলোচনা করেন।
এরই ধারাবাহিকতায় বিভিন্ন দাবিতে গত সপ্তাহে আশুলিয়ার কয়েকটি কারখানায় আন্দোলনে নামেন শ্রমিকেরা। সেই দাবি পূরণ না হওয়ায় তা অন্য কারখানায় ছড়িয়ে পড়ে।
দেড় হাজার শ্রমিকের বিরুদ্ধে মামলা
আশুলিয়ায় শ্রম অসন্তোষের ঘটনায় তিনটি কারখানা কর্তৃপক্ষ অন্তত দেড় হাজার শ্রমিকের বিরুদ্ধে কারখানা ভাঙচুর ও লুটপাটের অভিযোগে পৃথক মামলা করেছে। দুই শ্রমিককে গ্রেপ্তার করেছে আশুলিয়া থানার পুলিশ। তারা হলেন; উইন্ডি অ্যাপারেলসের মাসুদ ও সায়েম।
ফাউন্টেন গার্মেন্টস ও উইন্ডি অ্যাপারেলস কর্তৃপক্ষ আশুলিয়া থানায় ৩৯ জন শ্রমিকের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাতনামা আরও প্রায় ২০০ জনকে আসামি করে মামলা করেছে। হা-মীম গ্রুপের পক্ষ থেকেও এক হাজারের বেশি শ্রমিকের বিরুদ্ধে গতকাল একই ধরনের মামলা করা হয়েছে। পুলিশ জানায়, ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরার ফুটেজ দেখে আসামিদের শনাক্ত করার কথা বলা হয়েছে এজাহারে।
মজুরি বৃদ্ধি নিয়ে বিভ্রান্তি
শ্রমিক নেতাদের বক্তব্য হচ্ছে, সরকার আগেই বলেছে তিন বছর পর মজুরি বাড়বে। মজুরি বৃদ্ধির আন্দোলনটিকে যৌক্তিক মনে করেন তাঁরা। মালিকপক্ষ বলছেন, পাঁচ বছর পর মজুরি বোর্ড হওয়ার কথা।
শ্রম আইন-২০০৬ অনুযায়ী পাঁচ বছর পর মজুরি বোর্ড গঠিত হওয়ার কথা। তবে তিন বছরের মধ্যে মজুরি কাঠামো সংশোধনের সুযোগ আছে। সর্বশেষ ২০১৩ সালে পোশাকশিল্পের মজুরি বৃদ্ধি পায়।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ বেনারকে বলেন, মজুরি বোর্ড গঠনের এক থেকে তিন বছরের মধ্যে পুনর্বিবেচনার সুযোগ আছে। ফলে বাড়তি মজুরি চাওয়া যাবে না, বিষয়টি তেমন নয়। তবে যে প্রক্রিয়ায় তারা চাচ্ছে, সেটি সঠিক কিনা তা ভেবে দেখা উচিত।
শ্রমিকেরা বিক্ষুব্ধ, মালিকেরা অনড়
শ্রমিকদের সঙ্গে আলোচনার পর গত সোমবার রাতে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ ঘোষণা দেন, আশুলিয়া এলাকায় তিন বছর বাসা ভাড়া বাড়বে না। তবে শ্রমিকদের অনেকেই এই আশ্বাস বিশ্বাস করতে পারছেন না। তাঁরা মনে করছেন, আন্দোলন থামাতেই এমন ঘোষণা।
নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খানের বাসায় শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে বৈঠক হলেও তা ফলপ্রসূ হয়নি। শ্রম প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নু মঙ্গলবার সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে শ্রমিকদের এই আন্দোলনকে ‘অবৈধ’ আখ্যায়িত করে তারা কাজে না ফিরলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেন।
“আমরা আশুলিয়াসহ গার্মেন্টস শিল্প শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির লক্ষ্যে বোর্ডের কার্যক্রম শুরু করে উৎপাদন ও স্থিতিশীলতা রক্ষার আহ্বান জানাই,” বেনারকে জানান গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সভাপতি অ্যাড. মন্টু ঘোষ।
তিনি বলেন, বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতা করে দ্বিতীয় স্থান দখলকারী এ শিল্প কর্মসংস্থান, বর্তমান প্রাপ্ত মজুরিতে শ্রমিকদের পক্ষে জীবনধারণ করে উৎপাদনশীলতা রক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না। পরিবার পরিজন নিয়ে শ্রমিকদের দুঃখ কষ্ট দিন দিন বাড়ছে।
বিজিএমইএর সহসভাপতি মোহাম্মদ নাছির সাফ বলে দিয়েছেন, শ্রমিকদের মজুরি বাড়ানোর প্রশ্নই ওঠে না। বেনারকে তিনি বলেন, “এমনিতেই গার্মেন্টসে কর্মপরিবেশ উন্নয়ন করতে গিয়ে বিপুল অর্থ খরচ হচ্ছে। বেশ কিছু কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। তাই অনেক মালিকের বেতন দেওয়ার সক্ষমতা নেই।”