তিস্তা প্রকল্প বাস্তবায়নে ভারত ও চীনের প্রস্তাব পর্যালোচনা করেই সিদ্ধান্ত: শেখ হাসিনা
2024.06.25
ঢাকা
ভারত সফর শেষে দেশে ফিরে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, সীমান্ত নদী তিস্তা প্রকল্প ঘিরে চীনের দেওয়া মহাপরিকল্পনার বিপরীতে ভারত একটি প্রস্তাব দিয়েছে। চীন ইতিমধ্যে সম্ভাব্যতা যাচাই করেছে জানিয়ে তিনি বলেন, ভারতের একটি কারিগরি দল সম্ভাব্যতা যাচাই করতে বাংলাদেশে আসবে।
যদিও বাংলাদেশের সাবেক কূটনীতিক ও বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, দুই পরাশক্তির দ্বন্দ্ব, ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এবং বাংলাদেশের ‘কৌশলগত’ ভুলের কারণে জনগুরুত্বপূর্ণ তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন ঝুলে যেতে পারে।
প্রধানমন্ত্রীর ২১-২২ জুন ভারত সফরের ওপর মঙ্গলবার গণভবনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিস্তা মহাপরিকল্পনা নিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সাথে কি আলোচনা হয়েছে তা জানতে চান সাংবাদিকেরা। জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, তিস্তা প্রকল্প বাস্তবায়নে সহায়তার জন্য চীন ও ভারত উভয় দেশ প্রস্তাব দিয়েছে।
শেখ হাসিনা বলেন, “সেক্ষেত্রে ভারত যখন বলছে তারা করতে চায় এবং টেকনিক্যাল গ্রুপ পাঠাবে, অবশ্যই তারা আসবে। আমরা সেটা দেখব। চীনও একটা সম্ভাব্যতা যাচাই করেছে। ভারতও একটা করবে। যেটা আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য, লাভজনক সেটাই করব।”
প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আবার যেহেতু ভারতের সঙ্গে আমাদের অনেক দিনের তিস্তার পানি বন্টন… তাই, তারা যদি আমাদের প্রজেক্ট করে দেয় আমাদের সব সমস্যার সমাধানই হয়ে গেল। সেটা আমাদের জন্য সহজ হয়ে গেল না!”
শেখ হাসিনা বলেন, “ভারতের সঙ্গে যদি তিস্তা প্রজেক্টটা করি তাহলে পানি নিয়ে প্রতিদিন প্যাঁ প্যাঁ করতে হবে না। আমরা সেই সুবিধাটা পাব। এখানে কোন সমস্যা দেখি না।”
ঝুলে যেতে পারে তিস্তা মহাপরিকল্পনা
তবে ভিন্ন কথা বলছেন কূটনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা।
বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইন্সটিটিউটের প্রেসিডেন্ট রাষ্ট্রদূত হুমায়ূন কবির মঙ্গলবার বেনারকে বলেন, বাংলাদেশে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন নিয়ে ভারত ও চীনের মধ্যে ‘কৌশলগত প্রতিযোগিতা’ চলছে।
তিনি বলেন, “সাম্প্রতিক সময়ে, ভারত দক্ষিণ চীন সাগর এলাকায় তৎপরতা দেখানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। আবার চীনের কাছে সাংঘাতিক সংবেদনশীল বিষয় তাইওয়ান নিয়ে কথা বলছে ভারত।”
রাষ্ট্রদূত হুমায়ূন কবির বলেন, “এগুলো বড় শক্তিগুলোর মধ্যে খেলা। একে অপরকে উস্কানি দেবে। এমন উস্কানির অংশ হলো তিস্তা প্রকল্পে ভারতের আগ্রহ ও প্রস্তাব। তবে সমস্যা হলো, আমরা দুই দেশের এই খেলার মধ্যে পড়ে গেছি।”
তিনি বলেন, “তিস্তা প্রকল্প নিয়ে আমরা কিছুটা কৌশলগত ভুল করেছি। সেটি হলো, তিস্তা নদীর পানির হিস্যা পেতে নয়াদিল্লির সাথে আলোচনা করেছে বাংলাদেশ। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের সাথে আলোচনা করা উচিত ছিল। সেকারণেই মমতা ব্যানার্জি তিস্তা প্রকল্পের ব্যাপারে আপত্তি জানিয়ে ইতিমধ্যে প্রধানমন্ত্রী মোদিকে চিঠি দিয়েছেন।”
রাষ্ট্রদূত হুমায়ূন কবির বলেন, “ভারতের রাজনীতিতে মমতা ব্যানার্জী এবং কংগ্রেস জোটের যে অবস্থা সেখানে তারা মোদি সরকারকে বিব্রত করতে যা যা করা দরকার সবই করবে। এই অবস্থায় তিস্তা প্রকল্প নিয়ে কথা বলা সঠিক হয়নি।”
চীনকে এই প্রকল্প করতে দেবে না ভারত
নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সাখাওয়াত হোসেন মঙ্গলবার বেনারকে বলেন, তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের ব্যাপারে ভারত এবং চীনের মধ্যে প্রতিযোগিতা রয়েছে।
তিনি বলেন, ভারত মনে করে তার মূল ভূখণ্ডে উত্তরপূর্ব রাজ্যের সাথে যোগাযোগকারি সরু পথের (চিকেন নেক) কাছে অবস্থিত তিস্তা প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পারলে ভারতের ওপর নজরদারি করতে পারবে চীন।
ড. সাখাওয়াত বলেন, “সে কারণে ভারত কোনোভাবেই চায় না এই প্রকল্প চীনারা বাস্তবায়ন করুক। এরই অংশ হিসেবে ভারত বাংলাদেশকে পাল্টা প্রস্তাব দিয়ে বলেছে, তারা প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে চায়।”
তিনি বলেন, “বাংলাদেশ একটি সার্বভৌম দেশ। বাংলাদেশ তার ভূখণ্ডের মধ্যে কোন দেশকে কোন প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে দেবে, সেটি তার নিজস্ব সিদ্ধান্ত। ভারত অথবা চীনের উচিত হবে না বাংলাদেশের ওপর চাপ সৃষ্টি করা।”
সাখাওয়াত হোসেন বলেন, “ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির যে অবস্থা সেখানে এই প্রকল্প বাস্তবায়নের সম্ভাবনা দেখি না। তা ছাড়া ভারতের সংবিধান অনুযায়ী, পানি সম্পদের বিষয়টি রাজ্য সরকারের এখতিয়ার, কেন্দ্রীয় সরকারের নয়। পশ্চিমবঙ্গের মূখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে চিঠি লিখে জানিয়েছেন, তিনি বাংলাদেশকে তিস্তা নদীর পানি দেবেন না।”
“তাঁর এই বিরোধিতার কারণ হলো ২০২৬ সালে পশ্চিমবঙ্গে রাজ্যসভা নির্বাচন। সেখানকার উত্তরাঞ্চলীয় জেলাগুলোতে তাঁর ভোট দরকার। তিস্তার পানি দিলে তাঁর ভোট কমবে-এ কারণে হয় তো তিনি বিরোধিতা করছেন,” যোগ করেন সাবেক এই সেনা কর্মকর্তা।
কি এই তিস্তা মহাপরিকল্পনা?
বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের অন্যতম তিক্ত বিষয় হলো ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করা ৫৪টি অভিন্ন সীমান্ত নদীর পানি ভাগাভাগি। কেবলমাত্র গঙ্গা ছাড়া কোনও নদীর পানি বন্টনের চুক্তি নেই দুই দেশের মধ্যে।
ভারতের সিকিমে উৎপন্ন হয়ে পশ্চিমবঙ্গ দিয়ে দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে সীমান্ত নদী তিস্তা।
পঞ্চাশের দশক থেকে বাংলাদেশ ও ভারত তিস্তা নদীর পানি বন্টনের বিষয়ে আলোচনা চালিয়ে গেলেও দুই দেশ একমত হতে পারেনি।
এই নদী বৃহত্তর রংপুর জেলার লাখ লাখ কৃষক ও মৎসজীবীদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
১৯৯৪ সালে বাংলাদেশ লালমনিরহাট জেলায় তিস্তা ব্যারেজ নির্মাণ করে। সেই ব্যারেজের মাধ্যমে দেড় লাখ হেক্টর জমিতে বাড়তি সেচ সুবিধা দেওয়ার পরিকল্পনা নেওয়া হয়।
তবে পরিকল্পনা অনুযায়ী পুরোপুরি সেচ দেওয়া সম্ভব হয়নি।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্সটিটিউট অব ইনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সের গবেষক সুনীল চন্দ্র রায় তাঁর গবেষণায় বলেছেন, তিস্তা ব্যারেজের ১১০ কিলোমিটার উজানে পশ্চিমবঙ্গের গজলডোবায় ব্যারেজ নির্মাণ করেছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। বর্ষার সময় গজলডোবা ব্যারেজ থেকে অতিরিক্ত পানি ছেড়ে দেওয়া হয়। ফলে বাংলাদেশে বন্যার সৃষ্টি হয়। কিন্তু শুষ্ক মৌসুমে তিস্তা থেকে পানি প্রত্যাহার করে নেয় ভারত। ফলে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে পানি পাওয়া যায় না এবং দিন দিন সেখানকার পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
এশিয়া ফাউন্ডেশনের প্রকাশনা অনুযায়ী, উত্তরের ৩৫টি উপজেলার পাঁচ হাজার ৪২৭টি গ্রামের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে এই নদী। ২০১১ সালের হিসাব অনুযায়ী, তিস্তা নদীর পাড়ে বাস করেন প্রায় ৯২ লাখ মানুষ।
আলোচনায় কোন অগ্রগতি নেই
২০০৯ সালে আওয়ামী সরকার ক্ষমতায় আসার পর তিস্তা চুক্তি নিয়ে পুনরায় আলোচনা শুরু হয়।
দুই দেশের কর্মকর্তারা আলোচনা করে পানি বণ্টন পদ্ধতি নির্ধারণ করেন। সেই অনুসারে ভারতের জন্য ৪২ দশমিক পাঁচ ভাগ এবং বাংলাদেশের জন্য ৩৭ দশমিক পাঁচ ভাগ পানির ব্যবস্থা রাখার প্রস্তাব করা হয়। বাকি পানি নদীর স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য রাখার কথা ছিল।
২০১১ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরে এই চুক্তি স্বাক্ষর হওয়ার কথা ছিল। তবে এই সফরের আগে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি সফর থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নিলে সেই চুক্তি স্বাক্ষর সম্ভব হয়নি।
২০১৯ সালের অক্টোবরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফরের সময় তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষরের ব্যাপারে তাগিদ দেন। ওই সফরের সময় যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়, ভারত সরকার সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে নিয়ে সম্ভাব্য দ্রুততম সময়ে চুক্তিটি সম্পাদনের জন্য কাজ করছে।
এদিকে নদীটির দীর্ঘ মেয়াদি ব্যবস্থাপনার জন্য চীনা অর্থায়নে সমীক্ষা হয় যেখানে প্রকল্পের মোট বাজেট ধরা হয় ৯৮ কোটি ৩০ লাখ মার্কিন ডলার। এর মধ্যে ঋণ ৮৫ কোটি ৩০ লাখ ডলার দিতে সম্মত হয় চীন সরকার।
গত মে মাসে ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বিনয় কোয়াত্রা ঢাকা সফরের সময় বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ সাংবাদিকদের বলেন, ভারত তিস্তা প্রকল্পে অর্থায়নে আগ্রহী। এরপর থেকে বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় আসে, যা স্পষ্ট করলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আগামী ৮ জুলাই চীন সফরে যাচ্ছেন তিনি।