দুই বছরে রোহিঙ্গা শিবিরে ২২২টি অগ্নিকাণ্ডের ৬০টি ছিল নাশকতা

কামরান রেজা চৌধুরী ও সুনীল বড়ুয়া
2023.03.06
ঢাকা ও কক্সবাজার
দুই বছরে রোহিঙ্গা শিবিরে ২২২টি অগ্নিকাণ্ডের ৬০টি ছিল নাশকতা কক্সবাজারের উখিয়ার বালুখালী রোহিঙ্গা শিবিরে অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে যাওয়া বসতভিটা পরীক্ষা করছেন ক্ষতিগ্রস্ত রোহিঙ্গারা। ৬ মার্চ ২০২৩।
[সুনীল বড়ুয়া/বেনারনিউজ]

কক্সবাজারের উখিয়ার বালুখালী ১১ নম্বর রোহিঙ্গা শিবিরে রোববার লাগা অগ্নিকাণ্ড নাশকতা কি না তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল।

বারবার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটায় একই প্রশ্ন তুলেছেন রোহিঙ্গা নেতারা।

২০২১ ও ২০২২ সালে রোহিঙ্গা আশ্রয় শিবিরে মোট ২২২টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে।

প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় গত ১৫ ফেব্রুয়ারি সংশ্লিষ্ট সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভায় একটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, ২২২টি অগ্নিকাণ্ডের মধ্যে ৬০টি ছিল নাশকতার ঘটনা।

এছাড়া, ৬৩টি ঘটনার কোনো কারণ জানা যায়নি এবং ৯৯টি প্রকৃতই দুর্ঘটনা বলে ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।

ওই প্রতিবেদনে রোহিঙ্গা শিবিরের বিভিন্ন এলাকায় মোট ১১টি “সক্রিয় দুর্বৃত্ত দলের” উপস্থিতি রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়।

উল্লেখ্য, সশস্ত্র সংগঠন আরাকান স্যালভেশন আর্মি (আরসা) ও রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশনের (আরএসও) মধ্যে প্রত্যক্ষ বিরোধ রয়েছে। উখিয়া, বালুখালী, পালংখালী ও হোয়াইক্যং এলাকায় আরসা এবং উখিয়া ও পালংখালীতে আরএসও’র কর্মকাণ্ড রয়েছে।

কক্সবাজার ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স এর সহকারী উপ পরিচালক অতীশ চাকমা বেনারকে বলেন,ফায়ার সার্ভিসের দশটি ইউনিট প্রায় তিনঘণ্টা তৎপরতা চালিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে এনেছে।

তবে কী কারণে অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে বা আগুনের সূত্রপাত কোথা থেকে এসব বিষয়ে মন্তব্য করতে অপারগতা জানিয়ে তিনি বলেন, “ঘটনার বিষয়ে তদন্ত শুরু হয়েছে। আমিও ওই কমিটির সদস্য। সুতরাং তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশের আগে এ বিষয়ে মন্তব্য করা যাবে না।”

Coxs Pic-03.jpg
কক্সবাজারের উখিয়ার বালুখালী রোহিঙ্গা শিবিরে অগ্নিকাণ্ডে বসতঘর পুড়ে যাওয়ায় ত্রিপলের নীচে আশ্রয় নিয়েছে একটি রোহিঙ্গা পরিবার। ৬ মার্চ ২০২৩। [সুনীল বড়ুয়া/বেনারনিউজ]

গৃহহীন ১২ হাজারের বেশি

অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনে ইতোমধ্যে কাজ শুরু হয়েছে। কক্সবাজারের শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বেনারকে বলেন, “রোববারের অগ্নিকাণ্ডে প্রায় দুই হাজার ঘর ভস্মীভূত হয়েছে। গৃহহীন হয়েছেন ১২ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা।”

“আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইএমও) আশ্রয়হীন রোহিঙ্গাদের অস্থায়ী ঘর তৈরি করছে এবং জাতিসংঘ বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) জরুরি খাদ্য সহায়তা দিচ্ছে। এ ছাড়া, অতি প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সরবরাহ করা হচ্ছে। সোমবার দুপুর থেকে রান্না করা খাবার দেওয়া হচ্ছে,” বলেন মিজানুর।

তিনি বলেন, “ক্ষয়ক্ষতির সঠিক পরিসংখ্যান বের করতে আরও কয়েকদিন সময় লাগবে।”

জাতিসংঘ শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর-এর তথ্য মতে, ১১ নম্বর ক্যাম্পে ৩২ হাজার ২০০ রোহিঙ্গার বাস ছিল। এই অগ্নিকাণ্ডে ৯০টির বেশি বেসরকারি হাসপাতাল, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, লার্নিং সেন্টার ও ত্রাণকেন্দ্রসহ বিভিন্ন অবকাঠামো ধ্বংস হয়েছে।

এর আগে ২০২১ সালের ২২ মার্চ উখিয়ার বালুখালীর তিনটি আশ্রয় শিবিরে অগ্নিকাণ্ডে ১০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা বসতি পুড়ে যায়। সে সময় গৃহহীন হয়ে পড়েন ৪৫ হাজার রোহিঙ্গা। অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে ৬ শিশুসহ ১৫ রোহিঙ্গা শরণার্থীর মৃত্যু হয়।

আরসা-আরএসও দ্বন্দ্বের জের

মিয়ানমারের সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান স্যালভেশন আর্মি (আরসা) ও রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশনের (আরএসও) পারস্পরিক বিরোধের জের ধরে পরিকল্পিতভাবে এই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটানো হয়েছে বলে মনে করছেন ক্যাম্পের বাসিন্দারা।

তারা জানান, আগুন ছড়িয়ে পড়ায় প্রায় দুই হাজার ঘর পুড়ে গেছে, যেখানে বেশিরভাগেই আরএসও সদস্য ও তাদের স্বজনরা থাকতেন।

আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তথ্য মতে, রোববার বিকেল পৌনে ৩টার দিকে ১১ নম্বর শিবিরের ডি, বি ও এ ব্লকের তিনটি পৃথক জায়গায় একসঙ্গে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।

গত দুই মাস ধরে বালুখালী আশ্রয় শিবিরে আরসা ও আরএসও-এর মধ্যে একাধিকবার সংঘর্ষ ও বন্দুকযুদ্ধ হয়েছে। আগুনে পুড়ে গেছে ১১ নম্বর ক্যাম্পের এ ও বি ব্লকের আরও এক হাজার ৪০০টির বেশি রোহিঙ্গা বসতি।

রোহিঙ্গা শিবিরে ঘন ঘন অগ্নিকাণ্ডের মূল কারণ মিয়ানমারের সশস্ত্র গোষ্ঠীর (আরসা ও আরএসও) আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা বলে মনে করেন নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আব্দুর রশীদ।

তিনি বেনারকে বলেন, “প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দেওয়া হিসাবে গত দুই বছরে শরণার্থী শিবিরে ৬০টি নাশকতার ঘটনা ঘটেছে এবং ৬৩টির কারণ জানা যায়নি। হয়তো এই ৬৩টি ঘটনার মধ্যে বেশির ভাগই নাশকতা। অর্থাৎ রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে যেসব অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে, সেগুলোর বিরাট অংশ নাশকতা।”

আব্দুর রশীদ বলেন, “ক্যাম্পের যেখানে আরএসও-এর আধিপত্য রয়েছে সেখানে আগুন লাগিয়ে দেয় আরসা। আবার আরসার আধিপত্য রয়েছে এমন এলাকায় আগুন লাগিয়ে দেয় আরএসও।”

“এই যে নাশকতার ঘটনা ঘটেছে এগুলোর সঙ্গে জড়িতদের সব সময় বের করা যায় না। অথবা বের করা গেলেও তাদের ধরে আইনের আওতায় এনে শাস্তি দেওয়া যায় না। সেই কারণে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা বন্ধ হয় না এবং আমরা ভবিষ্যতে আরও নাশকতার ঘটনা দেখব,” আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।

আব্দুর রশীদ বলেন, “বাংলাদেশ শরণার্থী ব্যবস্থাপনায় একটি ভালো মডেল দাঁড় করিয়েছে। আরসা অথবা অন্য যেসব গ্রুপ মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর কাছ থেকে অর্থ ও অস্ত্র পেয়ে থাকে, তারা চায় এই ব্যবস্থাপনা নষ্ট হোক, শিবিরগুলো বিপজ্জনক হয়ে উঠুক। এর ফলে বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের নিয়ে আরেক দফা বিপদে পড়বে।”

“এছাড়া, মিয়ানমার থেকে মাদক চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ করতে দুই পক্ষই তৎপর। সেই কারণেও তারা নাশকতা পরিচালনা করে থাকে,” যোগ করেন তিনি।

সাত সদস্যর তদন্ত কমিটি

অগ্নিকাণ্ডের কারণ জানতে ৭ সদস্যের তদন্ত কমিটি সোমবার থেকে কাজ শুরু করেছে। কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) মো. আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে এই কমিটির আগামী তিন দিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া কথা রয়েছে।

আবু সুফিয়ান বেনারকে বলেন, “শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার কার্যালয়, ফায়ার সার্ভিস, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন) ও পুলিশের সংশ্লিষ্ট সংস্থার প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত কমিটি কাজ শুরু করেছে। আগামী ৩ দিনের মধ্যে কারণ বের করে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে।”

উল্লেখ্য, বর্তমানে উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি আশ্রয় শিবির এবং নোয়াখালীর ভাসানচরে নিবন্ধিত রোহিঙ্গা শরণার্থীর সংখ্যা সাড়ে ১২ লাখ। এর মধ্যে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে আশ্রয় নেন প্রায় সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।