আন্তর্জাতিক আদালতে মিয়ানমারের আপত্তি খারিজ, গণহত্যার বিচার চলবে
2022.07.22
বেনারনিউজ স্পেশাল

রোহিঙ্গা গণহত্যার বিচারে আপত্তি জানিয়ে মিয়ানমার সরকার যে আবেদন জানিয়েছিল, তা শুক্রবার খারিজ করে দিয়েছে আন্তর্জাতিক বিচারিক আদালত (আইসিজে)। ফলে বিচারের জন্য গাম্বিয়ার আবেদনের শুনানী চলবে।
রোহিঙ্গাদের গণহত্যা এবং জোরপূর্বক বিতাড়নের বিচার করার এখতিয়ার নেদারল্যান্ডসের হেগে অবস্থিত ঐ আদালতের নেই- দাবি করে চারটি আপত্তি আবেদন জমা দিয়েছিল মিয়ানমারের সামরিক সরকার। চারটি আবেদনই খারিজ হয়েছে।
এই রায় মিয়ানমারের দায়ী কর্তৃপক্ষকে স্বাক্ষি প্রমাণের ভিত্তিতে বিচারের আওতায় আনার পথ পরিষ্কার করল।
তবে এই বিচার প্রক্রিয়া শেষ হতে বেশ কয়েক বছর লাগতে পারে।
“এই মামলাটি চূড়ান্ত রায়ে পৌঁছতে কত সময় লাগতে পারে তা অনুমান করা কঠিন। সম্ভবত এতে কয়েক বছর, এমনকি এক দশকও লাগতে পারে,” বলেছেন মিয়ানমারের মানবাধিকার আইনজীবী এবং দেশটির ফেডারেল লিগ্যাল একাডেমির প্রিন্সিপাল অং হতু।
আইসিজে ট্রাইবুনালের সভাপতি বিচারক জোয়ান ই. ডনোগুয়ের আদেশে বলেছেন, আদালতের কাছে প্রতীয়মান হয়েছে যে জাতিসংঘের ১৯৪৮ সালের গণহত্যা কনভেনশনের সকল সদস্যের গণহত্যা প্রতিরোধে দায়দায়িত্ব অছে এবং তারা এটা করতে পারে।
তিনি বলেন, জাতিসংঘের ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং মিশনের প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে ২০১৮ এবং ২০১৯ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে দেওয়া বিবৃতির মাধ্যমে গাম্বিয়া মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগে মামলা দায়েরের অভিপ্রায় স্পষ্ট করেছিল।
"রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে অপরাধের জন্য জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থাকে সমুন্নত করতে গ্যাম্বিয়া অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে, এ বিষয়টি মিয়ানমারের অজানা থাকতে পারে না," বলেন বিচারক।
আন্তর্জাতিক আদালতের সামনে সাংবাদিকদের সাথে কথা বলছেন গাম্বিয়ার এটর্নি জেনারেল এবং মিয়ানমারের প্রতিনিধি (এপি)
২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে মিয়ানমারের নির্বাচিত সরকারকে উৎখাতকারী সামরিক জান্তা এখন দেশটির বিস্তীর্ণ অংশ জুড়ে গণতন্ত্রকামী আধাসামরিক বাহিনীর সাথে লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়েছে। মিয়ানমার সৈন্যরা বেসামরিক নাগরিকদের নির্যাতন, ধর্ষণ এবং হত্যা করার একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে।
২০১৯ সালে দায়েরকৃত মামলার প্রাথমিক শুনানিতে, গাম্বিয়া বলেছিল "মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী এবং অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনী ২০১৬’র অক্টোবর থেকে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ব্যাপক এবং পদ্ধতিগত 'নির্মূল অভিযান' শুরু করে।“
“এই অভিযানের উদ্দেশ্য ছিল গণহত্যা, ধর্ষণ এবং অন্যান্য ধরণের যৌন সহিংসতার মাধ্যমে রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীকে সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে নির্মূল করা। তারা রোহিঙ্গাদের ঘরের ভেতর আটকে রেখে তাদের গ্রামগুলি আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। ২০১৭ সালের আগস্ট মাসের পর থেকে এই ধরনের গণহত্যামূলক কর্মকাণ্ড আরও ব্যাপক এবং বিস্তৃত হয়,” অভিযোগে বলেছে গাম্বিয়া।
মিয়ানমার বাহিনীর ভয়ংকর দমন অভিজান থেকে আত্মরক্ষার জন্য ২০১৭’র আগস্ট মাসে ৭,৪০,০০০এর বেশি রোহিঙ্গা পালিয়ে গিয়ে প্রতিবেশী বাংলাদেশের শরণার্থী শিবিরগুলোতে আশ্রয় নেয়। এর আগে ২০১৬ সালেও গণবিতারণের ফলে ৯০ হাজার রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছিল।
রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন বন্ধ করতে, গণহত্যার জন্য দায়ীদের শাস্তি দিতে, ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দিতে এবং রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে অপরাধের পুনরাবৃত্তি না হওয়ার নিশ্চয়তা দেওয়ার জন্য মিয়ানমারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে গাম্বিয়া।
আইসিজে জাতিসংঘের প্রধান বিচার বিভাগীয় অঙ্গ, যা ১৯৪৫ সালে আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এই আদালতের রায় রাষ্ট্রসমূহের জন্য বাধ্যতামূলক এবং এর বিরুদ্ধে আপিল করার অধিকার নেই।
যুক্তরাষ্ট্রও মিয়ানমারের বিরুদ্ধে রোহিঙ্গাদের উপর গণহত্যা চালানোর অভিযোগ করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন এই বছরের মার্চে বলেছিলেন, “২০১৭ সালে প্রধানত মুসলিম রোহিঙ্গাদের ধ্বংস করার অভিপ্রায়ে বার্মার সামরিক বাহিনী গণহত্যা এবং মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করেছে।”
যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ক্ষমতা দখল করা সামরিক জান্তা এখনো রোহিঙ্গাদের উপর নিপীড়ন চালিয়ে যাচ্ছে। গত বছরের শেষ নাগাদ ১ লাখ ৪৪ হাজার রোহিঙ্গাকে উৎখাত করে রাখাইনের অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুত শিবিরে রাখা হয়েছে।
গত মাসে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, রোহিঙ্গারা দেশের অভ্যন্তরে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার সম্মুখীন হন এবং সামরিক জান্তা বাংলাদেশ থেকে শরণার্থীদের ফিরিয়ে নেওয়ার কোনো চেষ্টা করেনি।
মিয়ানমার দেশটি আয়োতনে প্রায় ফ্রান্সের সমান। প্রায় ৫.৪০ কোটি জনসংখ্যার এই দেশে ১৩৫টি জাতিগোষ্ঠী সরকারিভাবে স্বীকৃতি প্রাপ্ত। তবে জনসংখ্যার প্রায় ৬৮ শতাংশই বার্মান।
রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের জাতিগোষ্ঠী হিসেবে স্বীকৃতি পায়নি। দেশটি রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব হরণ করে তাদেরকে রাষ্ট্রহীন করে দিয়েছে। কয়েক দশক ধরে সেখানে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে এই মুসলিম জনগোষ্ঠী।
রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে নৃশংসতা অং সান সু চির বেসামরিক সরকারের আমলে সংঘটিত হয়েছিল। সু চি ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে আইসিজেতে গণহত্যার অভিযোগের শুনানীতে সেনাবাহিনীর পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন। গত বছরের অভ্যুত্থানে একই সামরিক বাহিনীর দ্বারা তাঁর পতন ঘটে। এক সময়ের গণতন্ত্রের আইকন হিসেবে খ্যাত নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী এই নেত্রী এখন কারাগারে বন্দী।
মিয়ানমারের সাবেক আইনপ্রণেতাদের দ্বারা গঠিত জাতীয় ঐক্য সরকার, যারা সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে ছায়া সরকার হিসেবে কাজ করছে তারা রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতের এই বিচার কার্যক্রমকে সমর্থন করেছে।
মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ঢল। পালংখালি, বাংলাদেশ, অক্টোবর ১৯, ২০১৭। (এপি)
রায়ের খবরে রোহিঙ্গাদের সন্তোষ
রায়ের খবর শোনার কথা জানিয়ে রোহিঙ্গা ইয়ুথ এসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা খিন মং বেনারকে বলেন, "শুধু রোহিঙ্গা নয়, মিয়ানমারের সব নির্যাতিত জাতিগোষ্ঠীর জন্য আজ সফলতার দিন।”
"ইনশাআল্লাহ, রোহিঙ্গারা একদিন সুবিচার পাবে। আমার বিশ্বাস, আন্তর্জাতিক আদালত শেষ পর্যন্ত যে রায় দেবে, সেটাও আমাদের পক্ষেই থাকবে," বলেন টেকনাফের উনচিপ্রাং শিবিরের এই বাসিন্দা।
জাদিমুড়া শিবিরের মাঝি আবুল কালাম বেনারকে বলে, "প্রত্যেক রোহিঙ্গা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এই গণহত্যার বিচার চাইবে।"
"গাম্বিয়া আমাদের ন্যায্য বিচার পাওয়ার পথ সুগম করেছে। এ ব্যাপারে আমরা এখন আশাবাদী," বলেন তিনি।
রায়ের প্রতিক্রিয়ায় যুক্তরাজ্য ভিত্তিক সংগঠন বার্মা রোহিঙ্গা অর্গানাইজেশনের প্রেসিডেন্ট তুন খিন বলেছেন, ''এই রায় সকল মিয়ানমার নাগরিকদের জন্য সুসংবাদ।''
শুক্রবারের এই আদালত কার্যক্রমে তিনি উপস্থিত ছিলেন।
তিনি আরও আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, '' এই আইসিজে আদালতের কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে এবং গণহত্যার শিকার সকল রোহিঙ্গারা ন্যায়বিচার পাবেন । ''
প্রতিক্রিয়া জানার জন্য মিয়ানমার সরকারের ডেপুটি তথ্য মন্ত্রীর সাথে যোগাযাগের চেষ্টা করেছিলেন রেডিও ফ্রি এশিয়ার বার্মিজ প্রতিনিধি। কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায় নি।
আদালতের রায়েক স্বাগত জানিয়েছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাসমূহ।
ফোর্টিফাই রাইটস গ্রুপের প্রধান নির্বাহী ম্যাথিউ স্মিথ এই রায়কে বলেছেন, ''গুরুত্বপূর্ণ।''