কক্সবাজারের ক্যাম্প ছেড়ে রোহিঙ্গারা পালাচ্ছে, এক মাসে আটক ৪৩৪
2021.08.05
কক্সবাজার

সাগরপথে মালয়েশিয়া যাওয়া, পাসপোর্ট বা জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরী করা এবং ক্যাম্পের বাইরে শ্রম বিক্রি করাসহ নানা কারণে কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের শরণার্থী শিবিরগুলো থেকে পালিয়ে যাচ্ছে রোহিঙ্গারা। গত প্রায় এক মাসে (৭ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট) পালিয়ে যাওয়ার সময় ৪৩৪ জন রোহিঙ্গাকে আটক করা হয়েছে বলে বেনারকে জানান রামু উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) প্রণয় চাকমা।
কক্সবাজার জেলা পুলিশ জানায়, ক্যাম্প থেকে পালাতে গিয়ে বৃহস্পতিবার রামু থেকে ৬৪ জন এবং তার আগে বুধবার বিকালে রামুর রশিদ নগর এলাকা থেকে আরও ৩৩ জন রোহিঙ্গাকে আটক করে ক্যাম্পে ফেরত পাঠানো হয়েছে।
রোহিঙ্গারা ক্যাম্প ছেড়ে বাইরে চলে আসার বিষয়টি স্থানীয়দের জন্য উদ্বেগজনক উল্লেখ করে প্রণয় চাকমা বেনারকে বলেন, কঠোর লকডাউন বাস্তবায়নে রামু উপজেলার বেশ কিছু পয়েন্টে বিশেষ চেকপোস্ট বসানো হয়েছে। সেখানে প্রায় প্রতিদিনই রোহিঙ্গারা ধরা পড়ছে, যাদের প্রায় সবাই উখিয়া-টেকনাফের বিভিন্ন ক্যাম্প বসবাস করে।
“দলবেঁধে নয়, বিচ্ছিন্নভাবে তারা রাস্তা এবং চেকপোস্ট পাড়ি দেয়। পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে, রোহিঙ্গাদের পালিয়ে যাওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। আগেও তারা পালাতো, এখন বিশেষ চেকপোস্ট থাকায় ধরা পড়ার সংখ্যা বেড়েছে,” যোগ করেন প্রণয় চাকমা।
পালিয়ে যাওয়া একাধিক রোহিঙ্গা বেনারকে জানান, কাজের সন্ধানে রোহিঙ্গারা ক্যাম্প ছেড়ে যাচ্ছেন।
পালাতে গিয়ে ধরা পড়েন মাহমুদুর রহমান (৩৫), যিনি উখিয়ার কুতুপালং দুই নম্বর শিবিরের নূর কাসেমের ছেলে। মাহমুদ বেনারকে বলেন, “ক্যাম্পে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি আমাদের চাল, ডাল, তেল, নুনসহ বিভিন্ন খাবার দেয়। কিন্তু সব সময় তো একই জিনিস খেতে ইচ্ছে করে না।”
“আমাদের ছেলেমেয়েরা মাঝেমধ্যে মাছ-মাংস খেতে চায়। কিন্তু আমাদের হাতে টাকা থাকে না। যে কারণে বাইরে কাজ করতে যাই,” জানান মাহমুদ।
পালানোর সময় ধরা পড়া নুর মোহাম্মদ (৩০) বেনারকে বলেন, “ক্যাম্প থেকে অনেক রোহিঙ্গাই বাইরে কাজ করতে যায়। কৃষি ও ইট ভাটায় শ্রমিক হিসেবে কাজ করা এবং দিনমজুরীর করে থাকে তারা।” তিনি নিজেও এসব কাজের উদ্দেশ্যে লোহাগাড়া-সাতকানিয়ার দিকে যাওয়ার লক্ষ্যে ক্যাম্প থেকে বের হয়েছেন।
স্থানীয় জনগোষ্ঠীর উদ্বেগ
ক্যাম্প ছেড়ে রোহিঙ্গারা নানা অজুহাতে পালানোর বিষয়টি উদ্বেগজনক বলে মনে করছেন স্থানীয়রা। এভাবে চলতে থাকলে আইন-শৃংখলা পরিস্থিতির অবনতি ছাড়াও স্থানীয় শ্রম বাজারে বিরূপ প্রভাব পড়বে বলে মনে করেন তারা।
উখিয়ার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ও প্রতিরোধ কমিটির প্রতিষ্ঠাতা ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা মাহমুদুল হক চৌধুরী বেনারকে বলেন, মানবিক কারণে রোহিঙ্গাদের এখানে আশ্রয় দেওয়া হলেও মাত্র কয়েক বছরে তারা স্থানীয়দের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। রোহিঙ্গাদের হাতে এখন স্থানীয় জনগোষ্ঠীদের কেউ কেউ হত্যার শিকার হচ্ছে ।
“রোহিঙ্গাদের ক্যাম্প থেকে পালানো এবং বাইরে আসা বন্ধ করার জন্য সম্প্রতি চারপাশে কাটা তারের বেড়া দেওয়া হয়েছে। এরপরও তারা বাইরে চলে যাচ্ছে। এটা স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জন্য বিরাট হুমকী,” যোগ করেন মাহমুদুল হক।
“শুধু কাজের উদ্দেশ্যে নয়, এভাবে ক্যাম্প থেকে পালিয়ে মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমানোর চেষ্টা করছে তারা। কিছু কিছু রোহিঙ্গা এ দেশের কিছুসংখ্যক জনপ্রতিনিধি ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ম্যানেজ করে পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট সংগ্রহ করছে। এরপর মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমাচ্ছে,” বেনারকে জানান কক্সবাজার বাঁচাও আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক আয়াছুর রহমান।
তিনি বলেন, বর্তমানে করোনা মহামারী চলছে। ক্যাম্পেও করোনাভাইরাসের সংক্রমণ দিন দিন বাড়ছে। এ অবস্থায় রোহিঙ্গারা অবাধে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সঙ্গে মিশে গেলে সংক্রমনের হারও ক্যাম্পের ভেতর ও বাইরে বেড়ে যাবে।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) রামু শাখার সভাপতি মাস্টার মো. আলম বেনারকে বলেন, এক কথায় এখন রোহিঙ্গারা স্থানীয়দের জন্য বিষফোঁড়া। তারা আমাদের শ্রম বাজারও দখলে নিয়েছে।
“সবচেয়ে আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে, রোহিঙ্গারা নানা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে। তারা ভাড়াটে সন্ত্রাসী হিসাবে কাজ করছে। এমন পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গাদের কাঁটাতারের বাইরে আসা ঠেকানো খুবই জরুরী,” জানান মো. আলম।
মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর নির্যাতনের মুখে ২০১৭ সালে রোহিঙ্গারা নতুন করে কক্সবাজারে চলে আসে। নতুন ও পুরানো মিলিয়ে প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে বসবাস করছে, এদের মধ্যে প্রায় ১৮ হাজার রোহিঙ্গাকে নেওয়া হয়েছে ভাসানচরে।
উখিয়ার ১১ টি রোহিঙ্গা শিবিরে দায়িত্ব পালন করা এপিবিএন-এর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার খন্দকার আশফাকুজ্জামান বেনারকে বলেন, চিকিৎসা সেবা ও কেনাকাটাসহ বিভিন্ন অজুহাতে রোহিঙ্গারা বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু চোখে পড়লেই তাদের আটকে দেওয়া হয়।
“বেশিরভাগ রোহিঙ্গা শিবির পাহাড়ী এলাকায় অবস্থিত। আবার ভেতরে অনেক ছড়াও আছে। ক্যাম্পের অবস্থাগত কারণে তাদের বাইরে আসা শতভাগ নিয়ন্ত্রণ করা আসলেই কঠিন। তা ছাড়া রোহিঙ্গাদের কেউ কেউ কাঁটা তারের বেড়া কেটে ফেলে। গোপন রাস্তা তৈরীর চেষ্টা করে। চোখে পড়লেই সেগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়,” জানান আশফাকুজ্জামান।
তবে রোহিঙ্গাদের বাইরে কাজের সুযোগ না দিলে বাইরে যাওয়ার প্রবণতা অনেকাংশে কমে আসবে জানিয়ে তিনি বলেন, এ বিষয়ে স্থানীয় জনগোষ্ঠী বিশেষ করে জনপ্রতিনিধিদের আরও স্বোচ্ছার হতে হবে।
কক্সবাজার জেলা পুলিশের ২০২০ সালের হিসাব মতে, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর থেকে পাসপোর্ট, সাগরপথে অবৈধভাবে মালয়েশিয়া যাত্রা এবং বিভিন্ন কাজের উদ্দেশ্যে বের হওয়াসহ বিভিন্ন কারণে ক্যাম্প থেকে পালানোর সময় প্রায় ৫৯ হাজার রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ পুলিশের হাতে আটক হয়েছে।
কক্সবাজার পুলিশ সুপার মো. হাসানুজ্জামান বেনারকে বলেন, বর্তমানে মেরিন ড্রাইভ সড়কে জেলা পুলিশের পাঁচটি স্থায়ী চেকপোস্ট আছে। সেসব চেকপোস্টে বিশেষ নজরদারিতে থাকে পুলিশ। মাঝে মধ্যে সেখানে কিছু রোহিঙ্গা ধরা পড়ে, তাদের ক্যাম্পে ফেরত পাঠানো হয়।
কক্সাবজার শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার শাহ্ রেজওয়ান হায়াত বেনারকে বলেন,
ক্যাম্পগুলোতে এপিবিএন নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত
আছে। শিবিরগুলোতে একাধিক নিরাপত্তা বেষ্টনী থাকার পরও কীভাবে তারা বের হচ্ছে, তা বুঝতে পারছি না।
১০ আগস্ট থেকে রোহিঙ্গাদের টিকাদান
কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের মধ্যে প্রথম দফায় ৫৫ বছরের ঊর্ধ্বে ৪৮ লাখ রোহিঙ্গাকে ১০ আগস্ট থেকে করোনা ভ্যাকসিন দেওয়া হবে। একই সময়ে মাঝি, মসজিদের ইমাম এবং টিকাদান কাজে নিয়োজিত স্বেচ্ছাসেবকদেরও টিকাদান শুরু করা হবে বলে জানিয়েছেন জেলার সিভিল সার্জন ডা. মাহবুবুর রহমান।
কক্সবাজার শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) কার্যালয়ের স্বাস্থ্য সমন্বয়কারী ডা. আবু তোহা বেনারকে বলেন, রোহিঙ্গা শিবিরে টিকাদানের জন্য কর্মীদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণসহ আনুসাঙ্গিক সব ধরনের কাজও সম্পন্ন করা হয়েছে।
২৮ রোহিঙ্গার মৃত্যু
কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের মধ্যে এ পর্যন্ত ২ হাজার ৫১৮ জন আক্রান্ত এবং ২৮ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছেন ডা. তোহা।
তিনি বলেন, সারা দেশের মতো রোহিঙ্গা শিবিরেও করোনার সংক্রমণ বাড়ছে। তবে টিকাদান শুরু হলে ঝুঁকি কিছুটা কমে আসবে।