অশান্ত মিয়ানমার থেকে ঢুকছে রোহিঙ্গারা, সতর্ক বাংলাদেশ

সুনীল বড়ুয়া ও আবদুর রহমান
2022.09.13
কক্সবাজার
অশান্ত মিয়ানমার থেকে ঢুকছে রোহিঙ্গারা, সতর্ক বাংলাদেশ কক্সবাজারে শরণার্থী শিবির পরিদর্শনের সময় রোহিঙ্গাদের সাথে কথা বলছেন যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর ইন্দো প্যাসিফিক অঞ্চলের কমান্ডিং জেনারেল চার্লস এ ফ্লিন। তাঁর ডান পাশে বাংলাদেশের সেনাপ্রধান জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ। ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২২।
[আবদুর রহমান/বেনারনিউজ]

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে দেশটির সেনাবাহিনী ও আরাকান আর্মির (এএ) মধ্যে সহিংসতার জেরে আবারও কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ শুরু হয়েছে। অন্তত দুটি পরিবার ইতোমধ্যে প্রবেশ করেছে এবং তাদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী সীমান্তে অপেক্ষা করছে কয়েকশ পরিবার।

বাংলাদেশের পক্ষ থেকে নতুন করে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়নি। তবে টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে দুই পরিবারের দুই শিশুসহ পাঁচজন রোহিঙ্গা উখিয়ার লম্বাশিয়া রোহিঙ্গা শিবিরে আশ্রয় নিয়েছে বলে বেনারকে নিশ্চিত করেছেন আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস এন্ড হিউম্যান রাইটস এর সেক্রেটারি মোহাম্মদ জুবায়ের।

নির্যাতনের মুখে নতুন করে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা বেনারকে জানিয়েছেন, তাঁরা পালিয়ে আসার সময় দেখেছেন বাংলাদেশে প্রবেশের জন্য নাফ নদীর পারে সীমান্তের ওপারে অপেক্ষা করছে কয়েকশ রোহিঙ্গা পরিবার যেখানে বিপুল সংখ্যক নারী ও শিশু রয়েছে।

তবে নতুন করে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের বিষয়টি অবগত না থাকার কথা জানিয়েছেন কক্সবাজার অতিরিক্ত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ সামছু-দ্দৌজা।

তিনি বেনারকে বলেন, “মিয়ানমারের অভ্যন্তরে সে দেশের সেনাবাহিনীর সাথে আরেক গ্রুপের সহিংসতা চলছে। এর কিছুটা প্রভাব আমাদের সীমান্তেও পড়েছে। আমাদের সিদ্ধান্ত হচ্ছে, আর একজন রোহিঙ্গাকেও বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করতে দেওয়া হবে না।”

রোহিঙ্গা নেতা জুবায়ের বেনারকে বলেন, চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে দুটি পরিবারের দুটি শিশুসহ পাঁচজন রোহিঙ্গা লম্বাশিয়া এক নম্বর শিবিরের এফ-০১ ব্লকের মো. আলমের ঘরে আশ্রয় নেন। পরে তারা অন্য ক্যাম্পে চলে যান। এই দলে আবুল ওয়াফা নামের এক পুরুষ, দুই নারী ও দুই শিশু আছে বলে জানান জুবায়ের।

image0(1).jpeg
চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে মিয়ানমারে নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হয়ে সীমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশ করে কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গারা। ১০ সেপ্টেম্বর ২০২২। [আবদুর রহমান/বেনারনিউজ]

অনুপ্রবেশের অপেক্ষায় সীমান্তে অনেক

গত ৬ সেপ্টেম্বর টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশের কথা জানিয়ে নতুন করে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা আবুল ওয়াফা মুঠোফোনে বেনারকে বলেন, “মিয়ানমারের বুথিডং এর চেরাকোনি পাড়ায় আমাদের বাড়ি। সেখানে মগ আর সেনাবাহিনীর মধ্যে লড়াই চলছে। আগে মংডুতে চললেও এখন বুথিডং এ রোহিঙ্গাদের নির্যাতন শুরু করেছে মগেরা। এ অবস্থায় প্রাণ বাঁচাতে এখানে পালিয়ে এসেছি।”

ওয়াফা জানান, তাদের দলে দুই শিশু, তাঁর স্ত্রী এবং এক নারীসহ মোট পাঁচজন আছেন।

“এসে উখিয়ার লম্বাশিয়ায় এক আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলাম। কিন্তু সেখান থেকে সিআইসি (ক্যাম্প ইনচার্জ) আমাদের চলে যেতে বললে আরেক ক্যাম্পে চলে এসেছি,” বলেন ওয়াফা।

সাথে কোনো টাকা না থাকায় স্ত্রী মিনারাসহ দুই নারীর চার আনা ওজনের দুই জোড়া কানের দুল নৌকা চালককে দিয়ে খাল (নদী) পার হয়েছেন বলে জানান তিনি।

“প্রায় একমাস আগে মগেরা আমার স্বামী ছায়েদুল্লাহকে মেরে ফেলেছে। আমাকেও নির্যাতন করেছে। কোনো উপায় না দেখে তিন মাসের কন্যা শিশু নিয়ে এই পরিবারের সাথে চলে এসেছি। এখন এখানে এসেও বিপদে পড়েছি,“ বেনারকে বলেন পালিয়ে আসা নতুন রোহিঙ্গা দিলদার বেগম (২২)।

নতুন করে আসা এই রোহিঙ্গাদের ভাষ্য, শাহপরীর দ্বীপ হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশের জন্য বর্তমানে নাফ নদীর ওপারে ধংখালীর চরে কয়েকশ রোহিঙ্গা অবস্থান নিয়েছেন। কিন্তু তারা ঢুকতে পেরেছেন কিনা তা তাঁরা জানেন না।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে শরণার্থী শিবির এলাকায় নিয়োজিত ৮ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. রবিউল ইসলাম বেনারকে বলেন, “নতুন রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের বিষয়ে আমরা অবগত নই।”

বিজিবির ওয়েবসাইটের তথ্যানুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত অনুপ্রবেশের চেষ্টাকালে ৪৭৮ রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠিয়েছে বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী। এছাড়া চার রোহিঙ্গাকে থানায় সোপর্দ করা হয়েছে। এর মধ্য নারী ১৩১ জন, শিশু ৮১ ও ২৬৬ জন পুরুষ।

এই বিষয়ে টেকনাফ ২ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেনেন্ট কর্নেল শেখ খালিদ মোহাম্মদ ইফতেখার বেনারকে বলেন, “কোনো অবস্থাতেই নতুন করে কোনো রোহিঙ্গা ঢুকতে দেওয়া হবে না। রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ রোধসহ সীমান্ত সুরক্ষিত রাখতে বিজিবির তৎপরতা বাড়ানো হয়েছে।”

প্রসঙ্গত, মিয়ানমারে নির্যাতনের শিকার হয়ে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পরে প্রায় সাত লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেন। বর্তমানে নতুন ও পুরনো মিলে কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের ৩৩ টি রোহিঙ্গা শিবির ও নোয়াখালীর সাগরদ্বীপ ভাসানচরে সাড়ে ১১ লাখ রোহিঙ্গা বসবাস করছেন। পাঁচ বছর পার হলেও একজন রোহিঙ্গাকে ফেরত নেয়নি মিয়ানমার।

শরণার্থী শিবিরে ২৪ দেশের সেনা কর্মকর্তা

যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর ইন্দো প্যাসিফিক অঞ্চলের কমান্ডিং জেনারেল চার্লস এ ফ্লিনসহ ২৪ দেশের সামরিক কর্মকর্তারা কক্সবাজারের শরণার্থী শিবির ঘুরে দেখেছেন মঙ্গলবার। এসময় নারী-শিশুসহ ২২জনের একটি রোহিঙ্গা দলের সঙ্গে কথা বলেন তাঁরা।

মঙ্গলবার দুপুরে ২৪ দেশের সিনিয়র সেনা কর্মকর্তাদের নিয়ে উখিয়ার কুতুপালংয়ের এক্সটেনশন ক্যাম্প-৪ এ পরিদর্শনে যান বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল এসএম শফিউদ্দিন আহমেদ। যার মধ্যে কয়েকটি দেশের সেনাপ্রধানও ছিলেন।

পরিদর্শনে আসা সেনা কর্মকর্তাদের সাথে আলোচনা প্রসঙ্গে রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যানিটির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ জুবায়ের বেনারকে বলেন, “আমরা তৃতীয় কোনো দেশ নয়, আমাদের দেশে ফিরতে চাই। সেনা কর্মকর্তাদের আমরা জানিয়েছি আন্তর্জাতিক মহলের হস্তক্ষেপের মাধ্যমে আমাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসনের পরিবেশ তৈরি করা হোক।”

এছাড়া কর্মকর্তাদেরকে মিয়ানমারে নিজেদের উপর চলা বর্বরোচিত অত্যাচার নিপীড়নের কথা জানিয়েছেন বলে বেনারকে জানান এ ছাড়া আরেক রোহিঙ্গা মে. সেলিম।

তিনি বলেন, “তৃতীয় কোনো দেশে নয়, নিজ দেশ মিয়ানমারে ফেরত যেতে সহযোগিতা চেয়েছি।”

অতিরিক্ত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ সামছু-দ্দৌজা বলেন, ২৪টি দেশের সেনা কর্মকর্তাদের সামনে বর্তমান রোহিঙ্গা পরিস্থিতি তুলে ধরেছেন। আশ্রয়শিবিরে রোহিঙ্গারা কী ধরনের সুযোগ–সুবিধা পাচ্ছেন, তা নিয়ে কথা হয়েছে। এসময় সেনা কর্মকর্তাদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন তিনি।

সেনা কর্মকর্তাদের রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির পরিদর্শন সম্পর্কে নিরাপত্তা বিশ্লেষক বিগ্রেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বেনারকে বলেন, "সেনা কর্মকর্তাদের রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শন খুব বেশি গুরুত্ব বহন করবে বলে আমার কাছে মনে হয় না। তবে নিরাপত্তার বিষয়টি ভালোভাবে দেখে হয়তো আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে তুলে ধরার সুযোগ পাবে।”

নতুন করে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ সম্পর্কে তিনি বলেন, "বাংলাদেশকে অবশ্যই সীমান্তে নজরদারি জোরদার করতে হবে, যাতে করে রোহিঙ্গারা আবারো বাংলাদেশে ঢুকে পড়তে না পারে।”

সোমবার ঢাকায় চারদিনব্যাপী ইন্দো প্যাসিফিক আর্মিস ম্যানেজমেন্ট সেমিনারের উদ্বোধন করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, প্রায় দশ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশ নিজেই গুরুতর নিরাপত্তা এবং স্থিতিশীলতা সংক্রান্ত উদ্বেগের মধ্যে পড়েছে।

প্রতিবেদন তৈরিতে ঢাকা থেকে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন আহম্মদ ফয়েজ।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।