রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের কর্মকাণ্ড যুদ্ধপরাধের শামিল, বিচার চায় ফর্টিফাই রাইটস
2025.03.18
ঢাকা ও কক্সবাজার

বাংলাদেশে রোহিঙ্গা বিদ্রোহী সদস্যরা মিয়ানমার থেকে আসা শরণার্থীদের হত্যা, অপহরণ, নির্যাতন ও হুমকি দিচ্ছে, যা যুদ্ধপরাধের শামিল হতে পারে বলে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা ফর্টিফাই রাইটস।
তবে এসব অপরাধ যুদ্ধপরাধের শামিল কি না--সেটি রায় দেওয়ার এখতিয়ার আছে কিনা, এটা নিয়ে সংশয় জানিয়েছেন শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কার্যালয় এবং রোহিঙ্গা প্রতিনিধিরা। যদিও অপরাধের বিচারের দাবি করেছেন উভয় পক্ষই। মঙ্গলবার ঢাকায় মানবাধিকার সংস্থা ফর্টিফাই রাইটস প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে সংস্থাটি। ঢাকা রিপোটার্স ইউনিটিতে “আমি যে কোন মুহূর্তে খুন হতে পারি: রোহিঙ্গা বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর দ্বারা হত্যা, অপহরণ, নির্যাতন ও অনান্য গুরুতর অপরাধ" শীর্ষক অনুষ্ঠানে কথা বলেন ফর্টিফাই রাইটসের পরিচালক জন কুইনলি।
৭৭ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে ফর্টিফাই রাইটস ১১৬ জন ভুক্তভোগী, প্রত্যক্ষদর্শী, বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সদস্য ও অন্যান্য ব্যক্তিদের সাক্ষাৎকার নিয়েছে। এসব সাক্ষাৎকারের উপর ভিত্তি করে চলমান সহিংসতার জন্য আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) ও রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও) দুই বিদ্রোহী সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে সম্ভাব্য যুদ্ধাপরাধের জন্য দায়ী করেছে।
একইসঙ্গে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বাংলাদেশ সরকার, ইন্ডিপেনডেন্ট ইনভেস্টিগেটিভ মেকানিজম ফর মিয়ানমার ও আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (আইসিসি) রোহিঙ্গা শিবিরে বিদ্রোহী সংগঠনগুলোর তদন্ত পরিচালনা ও যুদ্ধপরাধের জন্য দায়ীদের বিচারের আওয়ায় আনার সুপারিশ করা হয়েছে।
রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে দেখভাল করা শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) মোহাম্মদ মিজানুর রহমান মঙ্গলবার বেনারনিউজকে বলেন, “সশস্ত্র গ্রুপের কারণে ক্যাম্পে বিভিন্ন অপরাধ সংগঠিত হচ্ছে। তবে এসব অপরাধ যুদ্ধপরাধের শামিল কি না--সেটি রায় দেওয়ার এখতিয়ার আমার নেই। অপরাধগুলো বিচার পর্যালোচনা করে আদালত রায়ে দিতে পারেন সেগুলো যুদ্ধপরাধের শামিল কিনা। যারা প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছেন তারা এই উদ্যোগ নিতে পারেন।”
তবে অন্তবর্তী সরকার ফর্টিফাই রাইটসের প্রতিবেদনের বিষয়ে মঙ্গলবার পর্যন্ত কোনও প্রতিক্রিয়া জানায়নি বলে সাংবাদিকদের বলেন সংস্থাটির পরিচালক জন কুইনলি। বেনারের পক্ষ থেকেও অন্তবর্তী সরকারের মন্তব্য জানতে চাইলেও কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।
ফর্টিফাই রাইটসের প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, শরণার্থী ক্যাম্পগুলোতে রোহিঙ্গা পুরুষ, নারী ও শিশুদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহীদের দ্বারা সংঘটিত নির্দিষ্ট কিছু কর্মকাণ্ড যুদ্ধপরাধের আওতায় পড়ার 'যৌক্তিক ভিত্তি' রয়েছে। কারণ হিসেবে সংস্থাটি বলছে, বাংলাদেশে সংঘটিত অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড ও মিয়ানমারে চলমান সশস্ত্র সংঘাতের মধ্যে সুস্পষ্ট 'যোগসূত্র' রয়েছে।
জন কুইনলি বলেন, “রোহিঙ্গা সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের প্রায় সম্পূর্ণ দায়মুক্তির সাথে ধংসযজ্ঞ চালাচ্ছে। যুদ্ধপরাধ সাধারণত সশস্ত্র সংঘাতের প্রত্যক্ষ ক্ষেত্রেই সংঘটিত হয়।”
“তবে এক্ষেত্রে বাংলাদেশে সংঘটিত নির্দিষ্ট অপরাধগুলো মিয়ানমারের যুদ্ধে সরাসরি যুক্ত ও যুদ্ধাপরাধের শামিল। সম্ভাব্য যুদ্ধপরাধীদের বিচারের আওতায় আনতে বাংলাদেশের অন্তবর্তী সরকারকে আন্তর্জাতিক বিচার ব্যবস্থার সাথে সহযোগিতা করা উচিত,” বলেন জন কুইনলি।
ফর্টিফাই রাইটস আরো জানায়, সাম্প্রতিক মার্কিন সরকারি তহবিল কাটছাটের ফলে শরণার্থী শিবিরগুলোতে রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের জন্য আরো বেশি সুযোগ তৈরি হচ্ছে। যা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিরাপত্তা আরও ব্যাপকভাবে খারাপ করবে।
রোহিঙ্গাদের প্রতিক্রিয়া
কক্সবাজারের ক্যাম্পে রোহিঙ্গা নেতা নুর মোহাম্মদ বেনারকে বলেন, “এটা সত্য যে, প্রতিদিন কোনও না কোনও ক্যাম্পে খুন-খারাবিসহ নানা অপরাধ সংঘঠিত হচ্ছে। এসব ঘটনাকে যুদ্ধপরাধ বলা যাবে কিনা সেটি আমার জানা নেই। ”
আরকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস (এআরএসপিএইচ) সংগঠনের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মোহাম্মদ জুবাইর বেনারকে বলেন, “ক্যাম্পে প্রায় সময় হত্যাসহ বিভিন্ন অপরাধ সংগঠিত হচ্ছে। এর সাথে ক্যাম্পে কয়েকটি সশস্ত্র গ্রুপ জড়িত। এখানে ঘটনাগুলো যুদ্ধপরাধের মতো কিনা-এখনই বলা মুশকিল। তবে এখানে বেশিরভাগ হত্যা-অপহরণ মাদক ও মানব পাচারের সাথে জড়িত।"
জুবায়ের বলেন, “সাম্প্রতিক সময়ে ক্যাম্পে যে অপরাধগুলো হচ্ছে সেখানে মিয়ানমারের দুই পক্ষেরই (মিয়ানমার জান্তা সরকার ও বিদ্রোহী গ্রুপগুলোর) অংশগ্রহণ রয়েছে।"
এদিকে প্রকাশিত প্রতিবেদনে ফর্টিফাই রাইটস বলেছে, মিয়ানমারের সশস্ত্র সংঘাতের প্রতি বাংলাদেশের নিরপেক্ষ অবস্থান দেশটির ভেতরে থাকা সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে যুদ্ধপরাধের জন্য জবাবদিহি থেকে রক্ষা করে না। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) বাংলাদেশ ও মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সংঘটিত নৃশংস অপরাধের তদন্ত শুরু করেছে। তদন্তে বিদ্রোহী সশস্ত্র গোষ্ঠী আরসা ও অন্যান্য গোষ্ঠীগুলোর দ্বারা সংঘটিত অপরাধও অন্তর্ভূক্ত করা উচিত বলে মনে করে সংস্থাটি।
মহিব উল্লাহ হত্যায় সহিংস গোষ্ঠীর উত্থান
ফর্টিফাই রাইটস তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে রোহিঙ্গা নেতা ও মানবাধিকার কর্মী মহিবুল্লাহ হত্যার পর থেকে বিদ্রোহী সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর সহিংসতা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার বিদ্রোহী সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর সহিংসতা থেকে রোহিঙ্গাদের থেকে বাঁচাতে ব্যর্থ হয়েছে।

ফর্টিফাই রাইটস বলছে, শরণার্থী শিবিরে ২০২১ সালে ২২জন, ২০২২ সালে ৪২জন, ২০২৩ সালে ৯০জন ও ২০২৪ সালে অন্তত ৬৫জন মিলিয়ে চার বছরে অন্তত ২১৯জন রোহিঙ্গা বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর সহিংসতায় খুন হয়েছেন।
মুহিব উল্লাহ আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের (এআরএসপিএইচ) চেয়ারম্যান ছিলেন। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে নেওয়া নানা উদ্যোগে তার ভূমিকা ছিল প্রধান।
উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আরিফ হোসেন বেনারকে জানান, ২০২১ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে উখিয়ার লম্বাশিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ডি ব্লকে এআরএসপিএইচের কার্যালয়ে বন্দুকধারীদের গুলিতে নিহত হন মুহিব উল্লাহ।
আতাউল্লাহ গ্রেফতার
তবে মামলার প্রধান অভিযুক্ত আরসা প্রধান আতাউল্লাহ ওরফে আবু আম্বার জুনুনী মঙ্গলবার গ্রেফতার হয়েছেন বলে জানান ওসি।
র্যাব জানায়, নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড করতে গোপন বৈঠকের সময় নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ ও ময়মনসিংহে পৃথক অভিযান চালিয়ে রোহিঙ্গাদের সশস্ত্র বিদ্রোহী সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (এআরএসএ বা আরসা) ১০ সদস্যকে গ্রেফতার করেছে র্যাব।
তাঁদের মধ্যে ছয়জনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পৃথক দুই মামলায় পাঁচ দিন করে ১০ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত।
আতাউল্লাহ আলোচিত রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহকে খুনের নির্দেশদাতা ছিলেন বলে আদালতের জবানবন্দিতে জানিয়েছেন এই হত্যা মামলায় গ্রেফতার চার আসামি। বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির তুমব্রু সীমান্তে মাদকবিরোধী যৌথ অভিযানে ডিজিএফআইয়ের কর্মকর্তা (স্কোয়াড্রন লিডার) রিজওয়ান রুশদী হত্যা মামলার অভিযোগপত্রভুক্ত আসামি আরসার প্রধান কমান্ডার আতাউল্লাহ।