পাকিস্তানপ্রীতির কারণে বাংলাদেশে একটি স্কুল বন্ধ করেছে সরকার

ঢাকা থেকে প্রাপ্তি রহমান
2017.01.27
ময়মনসিংহের ‘অন্বেষা ইন্টারন্যাশনাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ’ ময়মনসিংহের ‘অন্বেষা ইন্টারন্যাশনাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ’ বন্ধ করার পর একদল শিক্ষার্থী ফটকের সামনে। জানুয়ারি ২২, ২০১৭।
স্টার মেইল

মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর আব্দুল মোনেম খানকে ‘শহীদ’ আখ্যা দেওয়া, বিভিন্ন জাতীয় দিবস যথাযথভাবে পালন না করাসহ পাঁচটি অভিযোগে অন্বেষা ইন্টারন্যাশনাল স্কুল অ্যান্ড কলেজের ময়মনসিংহ ক্যাম্পাস বন্ধ করে দিয়েছে সরকার। স্কুলটিতে পড়ুয়া আড়াই শতাধিক শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকেরা ভোগান্তিতে পড়েছেন।

তবে স্কুলের অধ্যক্ষ ও আব্দুল মোনেম খানের কন্যা নাসরীন মোনেম খান দাবি করেন, রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত হয়ে সরকার এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

“পলিটিক্যালি মোটিভেটেড হয়ে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আমি ভিকটিমাইজড হচ্ছি। কিন্তু আমরা পলিটিকস আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে এক করতে চাচ্ছি না। শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎই আমাদের কাছে মুখ্য বিষয়,” বেনারকে জানান নাসরীন মোনেম।

গত ২২ জানুয়ারি স্কুল বন্ধের আদেশ ফটকে ঝুলিয়ে দিয়ে এর সব কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করে জেলা প্রশাসন। স্কুলের কার্যক্রম বন্ধের আদেশ প্রত্যাহারের জন্য গত বুধবার জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে শিক্ষাসচিব বরাবার লিখিত আবেদন করেছে স্কুল কর্তৃপক্ষ। আর গতকাল বৃহস্পতিবার স্কুলের অভিভাবকেরা জেলা প্রশাসককে স্কুল খুলে দিতে লিখিত আবেদন জানিয়েছেন।

স্কুল কর্তৃপক্ষ বলছে, তাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের সবটুকু সত্য নয়। তা ছাড়া অভিযোগ তোলার পর এরই মধ্যে অনেকগুলো বিষয় সংশোধন করা হয়েছে। তারপরও হঠাৎ স্কুলটি বন্ধ করে দেওয়ায় তারা বিস্ময় প্রকাশ করেছেন।

১৯৯৬ সালে ময়মনসিংহ শহরের নতুনবাজারের সাহেব আলী সড়কে ‘অন্বেষা ইন্টারন্যাশনাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ’ নামে ইংরেজি মাধ্যমের এই প্রতিষ্ঠান চালু করেন নাসরীন মোনেম খান। প্রতিষ্ঠানটির অধ্যক্ষও তিনি। প্লে গ্রুপ থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত ক্যামব্রিজ কারিকুলামে পাঠদান দেওয়া হয় সেখানে।

একই কারিকুলামে চলা ঢাকার বনানীতে এর আরেকটি ক্যাম্পাস রয়েছে। দুটি ক্যাম্পাস মোনেম খানের দুটি বাড়িতেই প্রতিষ্ঠা করা হয়। ময়মনসিংহের ক্যাম্পাস বন্ধ করে দেওয়া হলেও একই কারিকুলামে চলা ঢাকার ক্যাম্পাস চালু আছে।

সম্প্রতি বাংলাদেশের গণমাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটিতে পাকিস্তানি আদর্শ লালন, বাংলাদেশের পরিবর্তে পাকিস্তানের ইতিহাস পড়ানো, মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে নিহত মোনেম খানের নামে প্রতিষ্ঠানটি উৎসর্গ করা, দাপ্তরিক কাগজপত্রে তাঁর নামের আগে ‘শহীদ’ শব্দটি লেখা, প্রতিষ্ঠানের মনোগ্রামে চাঁদ-তারা খচিত পাকিস্তানের পতাকার চিহ্ন এবং রাষ্ট্রীয় কোনো বিধি-বিধান অনুসরণ না করার অভিযোগ এনে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এরপর অভিযোগ তদন্তে কমিটি গঠন করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

গত ২২ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠানটির মূল ফটকে ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসক মো. খলিলুর রহমানের সই করা একটি ব্যানার আকৃতির নোটিশে বলা হয়—প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ১. বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন, স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মহান মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর আব্দুল মোনেম খানকে শহীদ আখ্যা দেওয়া, ২. প্রতিষ্ঠানের দাপ্তরিক কাগজপত্রে ‘ডেডিকেটেড টু দা মেমোরি অফ শহীদ গভর্নর আব্দুল মোনেম খান এইচপিকে’ লেখা ও মনোগ্রামে চাঁদ-তারা খচিত প্রতীক ব্যবহার করা, ৩. প্রতিষ্ঠানটিতে বিভিন্ন জাতীয় দিবস যথাযথভাবে পালন না করা, ৪. প্রতিষ্ঠানটিতে রাষ্ট্রীয় বিধিবিধান অনুসরণ না করা এবং ৫. প্রতিষ্ঠানের শিক্ষা কারিকুলামে বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী কোনো ইতিহাস অন্তর্ভুক্ত না থাকা সংক্রান্ত অভিযোগগুলো তদন্তে প্রমাণ হয়েছে। তাই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ করে দেওয়া হলো।

ওই দিন দুপুরে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ আব্দুল লতিফ ও জেলা শিক্ষা অফিসার রফিকুল ইসলাম একদল পুলিশ নিয়ে অন্বেষা স্কুলের ক্যাম্পাসে যান। তাঁরা স্কুলের হিসাবরক্ষক শাজাহানের কাছে বন্ধের সরকারি চিঠি পৌঁছে দেন এবং প্রতিষ্ঠানটি কী কারণে বন্ধ করা হলো, তা উল্লেখ করে স্কুলের গেটে একটি ব্যানার টানিয়ে দেন।

অন্বেষা স্কুলের প্রশাসনিক কর্মকর্তা তৌফিকুর রহমান বেনারকে বলেন, “স্কুলে শীতকালীন ছুটি চলছিল। ২২ তারিখ খোলার কথা ছিল। এ রকম কোনো একটি ঘোষণা আসতে পারে, জানতে পেরে ছুটি আরও এক সপ্তাহ বাড়ানো হয়।”

স্কুলের অধ্যক্ষ নাসরীন মোনেম খান বলেন, “এটি এখন প্রশাসনিক বিষয়, তাই প্রশাসনিকভাবেই আগাচ্ছি আমরা। স্কুলের কার্যক্রম শুরু করার বিষয়ে সচিবকে একটি লিখিত আবেদন দেওয়া হয়েছে। আর অভিভাবকরাও একটি স্মারকলিপি দিয়েছেন জেলা প্রশাসককে।”

জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে স্কুল বন্ধের নোটিশ টানিয়ে দেওয়া হয়।
জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে স্কুল বন্ধের নোটিশ টানিয়ে দেওয়া হয়।
স্টার মেইল।
নাসরীন বলেন, “স্কুলের বিরুদ্ধে যে পাঁচটি অভিযোগ আনা হয়েছে তার মধ্যে দাপ্তরিক কাগজপত্রে আমার বাবা মোনেম খানকে শহীদ হিসেবে উল্লেখ করা এবং ‘ডেডিকেটেড টু দা মেমোরি অফ শহীদ গভর্নর আব্দুল মোনেম খান এইচপিকে’ লেখা এরই মধ্যে মুছে ফেলা হয়েছে। নতুন বছরের কাগজপত্রে এর কিছুই নেই। স্কুলের মনোগ্রামেও চাঁদ-তারার ব্যবহার বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। স্কুলের যেসব স্থানে মনোগ্রামটি খচিত ছিল সেগুলোও মুছে ফেলা হয়েছে।

তিনি বলেন, জাতীয় দিবসগুলো স্কুলে সঠিকভাবে পালন করা হতো এবং এ বিষয়ক ছবি তদন্ত কমিটির কাছেও জমা দেওয়া হয়েছে।

স্বাধীনতা পরবর্তী ইতিহাস না পড়ানোর বিষয়ে তিনি বলেন, “স্কুলে ক্যামব্রিজ কারিকুলাম অনুসরণ করায় তাদের অনুমোদিত ‘বাংলাদেশ স্টাডিজ’ বই পড়ানো হয়। বইটিতে স্বাধীনতা পরবর্তী ইতিহাস নেই।”

এটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বিষয় নয় দাবি করে তিনি বলেন, মন্ত্রণালয় বা জেলা প্রশাসন থেকে যদি এ বিষয়ে আগে নির্দেশ বা পরামর্শ দেওয়া হতো, তাহলে তারা সেটি অনুসরণ করতেন।

অধ্যক্ষ বলেন, সাবেক গভর্নর মোনেম খানকে ‘শহীদ’ বলা হয়েছে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে। এখানে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করা হয়নি। স্কুলে মোনেম খানের ইতিহাস কখনই পড়ানো হয়নি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক অভিভাবক বেনারকে বলেন, সন্তানদের লেখাপড়া নিয়ে তাঁরা বিপাকে পড়েছেন। আগামী মে-জুন মাসে ‘ও’ লেভেলের শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা। এই পরিস্থিতিতে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন তাঁরা । তাঁরা আরও বলেন, ঢাকা শহরে বিকল্প অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। কিন্তু ময়মনসিংহের মতো শহরে ভালো মানের প্রতিষ্ঠান নেই।

জেলা প্রশাসক মো. খলিলুর রহমান বেনারকে বলেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয় বরাবর প্রতিষ্ঠানের দেওয়া চিঠিটি তিনি পেয়েছেন। স্কুল কর্তৃপক্ষের দাবি, তারা এরই মধ্যে বেশ কিছু ত্রুটি সংশোধন করেছে। এসব বিষয় বিবেচনা করার কথা উল্লেখ করেছে।

তবে সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের সম্ভাবনা আছে কিনা এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক বলেন, “সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ীই বন্ধ করা হয়েছে এবং এটি এখনো বলবৎ আছে। পরবর্তী সিদ্ধান্ত না জানানো পর্যন্ত স্কুলটি বন্ধই থাকবে।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।