নারায়ণগঞ্জে সাত খুন মামলায় নূর হোসেন ও তারেক সাঈদসহ ২৬ জনের ফাঁসি
2017.01.16

নানামুখি চাপ ও প্রভাব উপেক্ষা করে শেষ পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জে আলোচিত সাত খুন মামলায় সাবেক কাউন্সিলর নূর হোসেন, এলিট ফোর্স র্যাবের সাবেক কর্মকর্তা লে. কর্নেল তারেক সাঈদ মোহাম্মদসহ ২৬ আসামিকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়েছে আদালত। বাকি নয় আসামির সবাইকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
তারেক সাঈদ সরকারের ত্রাণ ও দূর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার জামাতা এবং হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী নূর হোসেন সরকারদলীয় নেতা এবং ওয়ার্ড কাউন্সিলর হওয়ায় শুরু থেকেই মামলার বিচার নিয়ে সংশয় ছিল। তবে শুরু থেকে উচ্চ আদালতের দফায় দফায় নির্দেশ ও পরামর্শে প্রভাবশালীরা বিচারে হস্তক্ষেপ করতে পারেনি।
গতকাল সোমবার সকালে নারায়ণগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ সৈয়দ এনায়েত হোসেন এই রায় ঘোষণা করেন। রায় ঘোষণার সময় মামলার ৩৫ আসামির মধ্যে গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে থাকা ২৩ জন আদালতে উপস্থিত ছিলেন। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের মধ্যে ১৭ জনই র্যাবের সাবেক সদস্য।
এর বাইরে বিভিন্ন অপরাধে একই মামলায় র্যাবের আট সদস্যকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয়। ফৌজদারি অপরাধে একসঙ্গে এত র্যাব সদস্যের সাজার ঘটনা এটাই প্রথম।
আদালতের রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো। নজরুল ইসলামের শ্বশুর শহীদুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, তিনি মৃত্যুর আগে রায় কার্যকরের বিষয়টি দেখে যেতে চান।
“এরা (মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত) মানুষ না। এরা পশু, এরা বহু সংসার ধ্বংস করেছে। আদালত রায় দিয়েছে। আদালত উপযুক্ত বিচার করেছে,” বলেন শহীদুল ইসলাম।
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি নূর হোসেন ও র্যাবের বাকি তিন কর্মকর্তা রায় শুনে নিরুত্তাপ ছিলেন। রায় ঘোষণার সময় আদালতে তারেক সাঈদের বাবা মুজিবুর রহমান ও এম এম রানার শাশুড়ি উপস্থিত ছিলেন।
“স্পর্শকাতর এই মামলা নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাই না,” রায়ের প্রতিক্রিয়ায় সাংবাদিকদের বলেন মুজিবুর রহমান। রানার শাশুড়ি সুলতানা রহমান শিল্পী সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমি কোনো কিছু বলতে চাই না।’
আসামিপক্ষের এক আইনজীবী রিতা ইসলাম বেনারকে বলেন, তাঁরা খালাস পাওয়ার রায় আসা করেছিলেন। এখন তাঁরা উচ্চ আদালতে যাবেন।
এ দিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল গতকাল সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেছেন, যথাযথভাবে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছিল বলেই সাত খুনের সঠিক বিচার হয়েছে।
সাত খুনের মামলার দায় র্যাব নেবে কি-না সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন। “খুনের ঘটনা তদন্তে র্যাব সহযোগিতা করায় সঠিক বিচার সম্ভব হয়েছে। ঘটনার সঙ্গে র্যাবের কিছু বিপথগামী সদস্য জড়িত ছিল। তাই প্রতিষ্ঠান হিসেবে র্যাব কেন এ দায় নেবে?”
তিনি আরও বলেন, এ রায়ের মধ্য দিয়ে র্যাব আরও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কেউ যে আইনের বাইরে নয়, তাও প্রমাণিত হয়েছে।
নারায়ণগঞ্জে সাত খুন মামলার রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। সচিবালয়ে সাংবাদিকদের কাছে তিনি প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন।
“এই অপরাধে যে নৃশংসতার পরিচয় দেওয়া হয়েছে তার প্রমাণ আদালত পেয়েছে। আমি মনে করি, সঠিক রায় হয়েছে। এই রায়ে জনগণ সন্তুষ্ট হবে”, আনিসুল হক বলেন।
রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের বলেন, “অনেকের শঙ্কা ছিল কেউ কেউ ছাড়া পেতে পারে। তবে এ মামলায় কেউ ছাড়া পায়নি। নিম্ন আদালতের দেওয়া ফাঁসির রায় কার্যকর হয় না, যতক্ষণ না পর্যন্ত হাইকোর্ট তা কনফার্ম (অনুমোদন) করেন। বিচারিক আদালতের রায় নথিসহ হাইকোর্টে আসবে।”
উল্লেখ্য, ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার ফতুল্লায় খান সাহেব ওসমান আলী জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামের সামনে থেকে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ২ নম্বর ওয়ার্ডের তৎকালীন কাউন্সিলর ও প্যানেল মেয়র-২ নজরুল ইসলাম, তার বন্ধু মনিরুজ্জামান স্বপন, তাজুল ইসলাম, লিটন, নজরুলের গাড়িচালক জাহাঙ্গীর আলম, আইনজীবী চন্দন কুমার সরকার ও তার গাড়িচালক ইব্রাহিম অপহৃত হন। তিন দিন পর ৩০ এপ্রিল শীতলক্ষ্যা নদী থেকে প্রথমে ৬ জন এবং ১ মে সকালে একজনের পেট চেরা লাশ উদ্ধার করা হয়।
ওই ঘটনায় ২৮ এপ্রিল নজরুল ইসলামের স্ত্রী ও ১১ মে আইনজীবী চন্দন সরকারের মেয়ের জামাই বিজয় কুমার পাল মামলা করেন।
সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত
বিচারক সৈয়দ এনায়েত হোসেন সোমবার সকাল ১০টা ৪ মিনিটে রায় পড়া শুরু করেন। পাঁচ মিনিটের মাথায় বিচারক রায় ঘোষণা করেন। আদালত বলেন আসামিদের বিরুদ্ধে থাকা অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে।
রায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন; নূর হোসেন, লেফটেন্যান্ট কর্নেল তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, মেজর আরিফ হোসেন, লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মাসুদ রানা (এমএম রানা), হাবিলদার এমদাদুল হক, আরওজি-১ আরিফ হোসেন, ল্যান্সনায়েক হীরা মিয়া, ল্যান্সনায়েক বেলাল হোসেন, সিপাহি আবু তৈয়ব, কনস্টেবল মো. শিহাব উদ্দিন, এসআই পুর্নেন্দ বালা, র্যাবের সদস্য আসাদুজ্জামান নূর, আলী মোহাম্মদ, মিজানুর রহমান দিপু, রহম আলী, আবুল বাশার, নূর হোসেনের সহযোগী মোর্তুজা জামান চার্চিল, সেলিম, সানাউল্লাহ সানা, শাহজাহান, জামাল উদ্দিন, মো. মেখালেছুর রহমান, সৈনিক মহিউদ্দিন মুন্সী, আলামিন শরিফ, তাজুল ইসলাম, এনামুল কবীর। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের তিনজন এখনো পলাতক।
বাদীপক্ষের আইনজীবী সাখাওয়াত হোসেন খান রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন ।
“বিচার চলাকালীন বহু ঘাত-প্রতিঘাত, প্রতিবন্ধকতা এসেছে। শেষ পর্যন্ত সবার সহযোগিতায় একটি গ্রহণযোগ্য রায় আমরা পেয়েছি,” বেনারকে জানান সাখাওয়াত।
তিনি বলেন, একটি সুশৃঙ্খল বাহিনীর বিপথগামী সদস্যদের সাজা হওয়ায়, এ বাহিনীর অন্যান্য সদস্যরাও সতর্ক হবে। এতে মানুষের মধ্যে বিচার বিভাগের প্রতিও আস্থা বাড়বে।