করোনাভাইরাস সংকটে আয় বন্ধ লক্ষাধিক যৌনকর্মীর
2020.05.15
ঢাকা

ঢাকা থেকে শত কিলোমিটার দূরের পূর্বপাড়া দেশের সর্ববৃহৎ যৌনপল্লি, এটি দৌলতদিয়া যৌনপল্লি নামে পরিচিত। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ এড়াতে গত ২০ মার্চ থেকে এলাকাটি ‘লকডাউন’ করে রাখায় সেখানকার যৌনকর্মীদের উপার্জন পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে।
রাজবাড়ী জেলার গোয়ালন্দ উপজেলায় অবস্থিত এই যৌনপল্লির একটি মাত্র প্রবেশপথ খোলা, বাকিগুলো বন্ধ। নিরাপত্তা ও নজরদারি বাড়াতে পুলিশের পাহারা জোরদার করা হয়েছে।
বৃহস্পতিবার ওই পল্লিতে সরেজমিন এই চিত্র দেখা যায়। ১৪ বছর বয়স থেকে সেখানে আছেন সালেহা বেগম, এখন তাঁর বয়স ৫৫। বেনারকে জানালেন, গত চার দশকে এই পল্লিতে এমন নিস্তব্ধতা দেখেননি।
“কেউ করোনায় মরবে, কিন্তু আমরা এখানে মরব ভাতের অভাবে,” বেনারকে জানান সালেহা।
ওই যৌনপল্লিতে কর্মীর সংখ্যা এক হাজার তিনশ। তাঁদের সংগঠন অসহায় নারী ঐক্যের সভানেত্রী ঝুমুর বেগম বেনারকে বলেন, “করোনাই আমাদের বুঝিয়েছে অভাব, অনাদর, কষ্ট এবং অনাহার কাকে বলে।”
“নিজেদের ভালোর জন্যই পুলিশের পরামর্শ মেনে এখানে আমরা অবরুদ্ধ আছি,” মন্তব্য করে ঝুমুর বলেন, “যৌনপল্লিতে বিভিন্ন এলাকার লোকজন আসে। তাদের মাধ্যমে কেউ আক্রান্ত হলে সেও মরবে, অন্যদেরও মরতে হবে।”
গোয়ালন্দ ঘাট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আশিকুর রহমান বেনারকে বলেন, “যেহেতু গোয়ালন্দ ঘাট দেশের ২১টি জেলার প্রবেশদ্বার এবং এখানেই দেশের সবচেয়ে বড় যৌনপল্লি, সেহেতু এখানকার কেউ করোনা আক্রান্ত হলে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া কঠিন হবে।”
“এই চিন্তা থেকেই পুরো উপজেলা লকডাউনের আগেই যৌনপল্লি লকডাউন করা হয়েছে,” বলেন তিনি।
ওসি জানান, সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে মঙ্গলবার পর্যন্ত চার দফা খাদ্য পেয়েছেন যৌনকর্মীরা। লকডাউন দীর্ঘায়িত হওয়ার কারণে তাঁদের জন্য আরও সাহায্য চাওয়া হয়েছে।
“এটা সত্য যে, পুলিশ আর প্রশাসন পাশে না থাকলে না খেয়েই মরতে হতো। অপর্যাপ্ত হলেও কিছু সহায়তা আমরা পাচ্ছি,” বলেন ঝুমুর।
ভাসমানদের সংকট বেশি
দেশে যৌনপল্লির সংখ্যা এখন ১১টি। চলমান সংকটে যৌনপল্লির বাইরে থাকা হাজার হাজার যৌনকমীরা রয়েছেন বেশি অসহায় অবস্থায়।
সরকারের সর্বশেষ (২০১৬) হিসাব অনুযায়ী, দেশে এক লাখ দুই হাজার দুইশ তিনজন যৌনকর্মী রয়েছেন। এর মাঝে যৌনপল্লিগুলোতে আছেন মাত্র তিন হাজার ৮৫৬ জন।
এর বাইরে ভাসমান ৪১ হাজার ৩৫০, বাসাবাড়িতে ৩৯ হাজার ৭৮, হোটেলে ১৭ হাজার ৯৭৬ কর্মী যৌন সেবা দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন।
“ভাসমান, হোটেল এবং বাসাবাড়ির যৌনকর্মীরা সামাজিক কারণে পরিচয় লুকিয়ে রাখেন। যে কারণে সরকারি–বেসরকারি অনুদান বা খাদ্য সহায়তা তাঁরা পান না,” বেনারকে বলেন সেক্স ওয়ার্কার নেটওয়ার্ক অব বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক আলেয়া আক্তার লিলি।
তিনি বলেন, “এদিক বিবেচনায় যৌনপল্লির কর্মীরা কিছুটা হলেও সুবিধাজনক অবস্থানে আছেন।”
যৌনকর্মীদের অধিকার নিয়ে গত দেড় যুগ ধরে কাজ করছেন উন্নয়নকর্মী সেলিমা সুলতানা। বেনারকে তিনি বলেন, পতিতাবৃত্তিতে নিয়োজিতরা সাধারণত দারিদ্র সীমার কাছাকাছি থাকেন। এদের সঞ্চয় থাকে না।
“কোভিড-১৯ প্রতিরোধে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে, এটাই যৌনকর্মীদের উপার্জনে বড় প্রতিবন্ধকতা। এখন তাঁরা খদ্দেরের কাছে যেতে পারছেন না,” বলেন সেলিমা।
সরকারিভাবে যৌনকর্মীদের জন্য আলাদা কোনো কর্মসূচি নেই বলে বেনারকে জানান সমাজসেবা অধিদপ্তরের সামাজিক নিরাপত্তা অধিশাখার উপপরিচালক (ডিডি) আইয়ুব খান।
তিনি বলেন, “আমরা শুধু যৌনকর্মীদের পুনর্বাসন নিয়ে কাজ করি। পুলিশ বা আদালতের মাধ্যমে আমাদের হেফাজতে আসলে তাঁদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, পুনর্বাসন কেন্দ্রে পাঠানো হয়।”
শিশুদের নিয়েই দুশ্চিন্তা
যৌনকর্মীদের অনেকেই নিজের শিশুকে পতিতালয়ের বাইরে রেখে বড় করছেন। বিভিন্ন এনজিও অর্থের বিনিময়ে তাঁদের এই সুবিধা দিয়ে আসছে। লকডাউনের পর টাকার অভাবে সেই সন্তানদেরও নিজেদের কাছে নিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছেন অনেকেই।
দৌলতদিয়ার পূর্বপাড়ায় এখন প্রায় তিনশ শিশু রয়েছে জানিয়ে ঝুমুর বলেন, “লকডাউন কী, তা বাচ্চারা বোঝে না। আর সন্তানের কোনো আবদার যখন মা পূরণ করতে পারে না, তখন কেমন লাগে সেটা সবারই বোঝার কথা।”
নিজের সাত, আট ও ১২ বছর বয়সী তিন ছেলেকে দেখিয়ে পাড়ার ২৪ বছরের পুরানো বাসিন্দা পূর্ণিমা বেনারকে বলেন, এখানকার মায়েরা খুব অসহায় অবস্থায় আছেন।
টাঙ্গাইলের কান্দাপাড়া পল্লির চিত্র
দৌলতদিয়া ছাড়াও টাঙ্গাইলে একটি বড় যৌনপল্লি রয়েছে। টাঙ্গাইলের যৌনকর্মীদের সংগঠন নারী মুক্তি সংঘের সভানেত্রী আকলিমা বেগম আঁখি বেনারকে বলেন, কান্দাপাড়া যৌনপল্লি ২০ মার্চ থেকে লকডাউন রয়েছে।
তিনি জানান, বৃহস্পতিবার পর্যন্ত দুই দফায় ৪০ কেজি চাল, এক কেজি পিঁয়াজ, এক কেজি ডাল আর এক কেজি করে লবণ পেয়েছেন সেখানকার যৌনকর্মীরা।
“চাল-ডাল কি শুধু পানিতে ধুয়ে খাওয়া যাবে। রান্না করতে কেরোসিন লাগে। সাথে মসলা, তরকারিও দরকার। অধিকাংশেরই এগুলো কেনার সামর্থ্য নেই,” বলেন আঁখি।
আঁখি জানান, সেখানে প্রায় ৭০ জন শিশু রয়েছে। মায়েদের উপার্জন না থাকায় ওই শিশুরাও ঝুঁকিতে পড়েছে।
সেক্স ওয়ার্কার নেটওয়ার্কের আলেয়া আক্তার জানান, যৌনকর্মীদের শুধু সন্তান নয়, অনেকের মা-বাবা এবং ভাই-বোনও তাঁদের আয়ের ওপর নির্ভরশীল।
“কিন্তু ওদের কেউ কেউ সাহায্য পায় একজন হিসেবে, অন্যদের কথা ভাবা হয় না,” বলেন আলেয়া।