বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যৌন নিপীড়নের ঘটনা বাড়লেও সক্রিয় নয় অভিযোগ সেল

অয়ন আমান
2024.03.19
ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যৌন নিপীড়নের ঘটনা বাড়লেও সক্রিয় নয় অভিযোগ সেল যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে এবং নিপীড়কদের শাস্তির দাবিতে ঢাকার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ প্রদর্শন। ১৬ মার্চ ২০২৪
[সুদীপ্ত সালাম/বেনারনিউজ]

মানবাধিকার সংস্থার মতে, শিক্ষকের হাতে ছাত্রীদের যৌন নিপীড়নের ঘটনা বাড়লেও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যৌন নিপীড়ন অভিযোগ সেল বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কোনো কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারছে না।  আবার বাড়তি হয়রানির আশঙ্কায় সেলের কাছে অভিযোগ করছেন না ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীদের অনেকেই।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মস্থলে যৌন হয়রানি ও নিপীড়ন প্রতিরোধে প্রায় দেড় দশক আগে উচ্চ আদালতের নির্দেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অভিযোগ সেল গঠন করে। 

সেসব সেল প্রায় অকার্যকর থাকা, ছাত্রী নিপীড়নের অভিযোগ সামনে আসা এবং সর্বশেষ ১৫ মার্চ ঢাকার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী নিপীড়নের শিকার হয়ে মৃত্যুর ঘটনায় নতুন করে হাই কোর্টের আলোচিত সেই আদেশের বিষয়টি সামনে এসেছে।  

মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) বলছে, চলতি বছরে গত দুই মাসে শিক্ষকের কাছে হয়রানির শিকার হয়েছেন ১৫ ছাত্রী।  ২০২৩ সালে ৩০ শিক্ষার্থী হয়রানির শিকার হয়েছিলেন, যার মধ্যে ১৯ জন কোথাও অভিযোগ করেননি।  

তার আগের বছর ২০২২ সালে হয়রানির শিকার হয়েছিলেন ২৩ শিক্ষার্থী, অভিযোগ করা থেকে বিরত ছিলেন ১৯ ছাত্রী।

এর কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, যৌন নিপীড়ন অভিযোগ সেল শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা ও সুষ্ঠু বিচারের নিশ্চয়তা দিতে পারছে না।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ফওজিয়া মোসলেম বেনারকে বলেন, “অভিযোগ কমিটি যে শিক্ষার্থীর নিরাপত্তা দিতে পারবে এবং সুষ্ঠু বিচার করতে পারবে এটা কিন্তু আমরা প্রমাণ করতে পারিনি। বরং অভিযোগ করতে গেলে নানা রকম বিব্রতকর হয়রানির শিকার হতে হয়।”

ফওজিয়া বলেন, “২০০৯ সালে হাইকোর্টের নির্দেশনা ছিল অভিযোগ সেল গঠন করার পাশাপাশি আইন করতে হবে।  যত দিন আইন না হচ্ছে, ততদিন সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অভিযোগ কমিটি গঠন করতে হবে।

“সে অনুযায়ী অভিযোগ কমিটি গঠন হয়নি। অভিযোগ কমিটির বিষয়ে ছাত্র-শিক্ষক সবাই অবহিত নন। অভিযোগ কমিটিগুলো কোনোভাবেই সক্রিয় হতে পারছে না।  এখন পর্যন্ত আইন করার কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি,” যোগ করেন তিনি।

ফওজিয়া আরও বলেন, “মানবাধিকার কমিশন নারী সংগঠনগুলোর সঙ্গে বসে আইনের একটি খসড়া প্রস্তুত করে মহিলা বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে।  এখন মন্ত্রণালয়কে উদ্যোগ নিতে হবে।  এই খসড়াটি বিল আকারে জাতীয় সংসদে উত্থাপন করে আইন হিসেবে পাস করতে হবে।  একটা আইন হলে আরেকটু জোর পাবো আমরা।”

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মস্থলে যৌন হয়রানি ও নিপীড়ন প্রতিরোধে বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি ২০০৮ সালে হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন।  বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি কামরুল ইসলাম সিদ্দিকী ২০০৯ সালের ১৪ মে রিটের পক্ষে রায় দেন।

ওই রায়ের প্রেক্ষাপট হিসেবে ১৯৯৮ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে ছাত্র-শিক্ষকদের বহুল আলোচিত বিক্ষোভের কথা তুলে ধরা হয়।  এ ধরনের নিপীড়নের বিচার করতে তখন আইনি কাঠামোর দাবি তোলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রগতিশীল শিক্ষকেরা।  

নামকাওয়াস্তে অভিযোগ সেল

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) তথ্য অনুযায়ী, দেশের ৬১টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ৪৫টি ও ১১৪টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ৯৭টিতে যৌন নিপীড়ন অভিযোগ সেল রয়েছে।  কিন্তু এগুলোর বেশিরভাগই কার্যকর নয়।

ইউজিসি’র উপপরিচালক ও অভিযোগ প্রতিকার ব্যবস্থার ফোকাল পারসন মৌলি আজাদ বেনারকে বলেন, “ছয় মাস পরপর হয়রানির তথ্য পাঠাতে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে চিঠি পাঠিয়েছি।  কিন্তু বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে আমরা তথ্য পাইনি। যে কারণে হয়রানির ঘটনায় সুনির্দিষ্ট তথ্য আমাদের কাছে নেই।”

তিনি বলেন, “হাইকোর্ট বলেছিল, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পত্র দিয়ে কমিটি গঠন করে দেবে।  কমিটিগুলোর কার্যক্রম পর্যবেক্ষণের দায়িত্ব রিট আবেদনকারী সংগঠন অর্থাৎ বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতিকে দিয়েছিল আদালত।”

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি সালমা আলীও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলেন।  তিনি বলেন, “যৌন নিপীড়ন সেলের প্রতি বছর প্রতিবেদন দেওয়ার কথা থাকলেও তারা তা দেয় না।”

তিনি আরও বলেন, “আমরা পর্যবেক্ষণ করতে গেলে কমিটির কথা শুনি।  কিন্তু কার্যক্রমের কোনো তথ্য পাই না।  বিশ্ববিদ্যালয়ের সেল থেকে সাধারণত  প্রতিবেদন দেয়া হয় না।  আদালতের নির্দেশনা কেউ অনুসরণ করছে না।”

যদিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌন নিপীড়ন অভিযোগ সেলের আহ্বায়ক অধ্যাপক জিনাত হুদা বলেন, “ইউজিসির পক্ষ থেকে যৌন নিপীড়ন অভিযোগ সেলের তথ্য-উপাত্ত চেয়ে কোনো চিঠি পাইনি।  আমার দুই বছর দায়িত্ব পালনকালে তিনটি অভিযোগ এসেছিল, দুটি অভিযোগের বিষয়ে আমরা যে সুপারিশ করেছিলাম, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে।”

 

অভিযোগ ও প্রতিকারের হার কম

যৌন নিপীড়ন অভিযোগ সেল কোনো শান্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে না।  যাচাই করে অভিযোগের সত্যতা পেলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে সুপারিশ করে।

যৌন হয়রানি ও নিপীড়ন নিরোধ নীতিমালা-২০১০ অনুযায়ী, অপরাধের মাত্রা অনুসারে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে মৌখিক বা লিখিতভাবে সতর্ক করা, ১-২ বছরের বহিষ্কার (শিক্ষার্থী), চাকরিচ্যুত, প্রশাসনিক কাজ থেকে বিরত রাখা, অর্থদণ্ড দেওয়া (শিক্ষক ও কর্মচারী) এবং ক্যাম্পাসে চলাচল নিষিদ্ধ (বহিরাগত) করার বিধান রয়েছে।

গত ১৫ মার্চ ঢাকার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীর অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়। মৃত্যুর আগে ওই শিক্ষার্থী জানিয়েছিলেন, যৌন নিপীড়নের অভিযোগ করেও তিনি প্রতিকার পাননি।

ওই ঘটনায় ১৬ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবাদে মুখর হন তাঁর সহপাঠীরা।

আন্দোলনকারিদের একজন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শওরীন হাসান নীরা বেনারকে জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারি প্রক্টরকে স্থায়ীভাবে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করতে হবে।  সুষ্ঠুভাবে তদন্ত পরিচালনা করতে হবে।   অভিযুক্ত শিক্ষক ও ছাত্রকে বিচারিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এমন শাস্তি দিতে হবে যা দেখে এ ধরনের যৌন নিপীড়নের কথা আর না শোনা যায়।”

শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের মুখে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন অভিযুক্ত সহকারী প্রক্টর ও অস্বাভাবিক মৃত্যুর শিকার শিক্ষার্থীর এক সহপাঠীকে সাময়িক বহিষ্কার করে।  পুলিশ হেফাজতে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ চলছে।

কিছু শাস্তি হয়েছে

যৌন নিপীড়নের অন্তত দশটি ঘটনা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, যেসব নিপীড়নের ঘটনা নিয়ে হই চই হয়, সেগুলোর শাস্তি হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনিক ভবন থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, শিক্ষার্থী নিপীড়নের ঘটনায় চলতি বছরে বিশ্বদ্যিালয়ের চার শিক্ষকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এসব ঘটনা নিয়ে গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে, শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করেছে।

গত ১৪ মার্চ যৌন হয়রানির অভিযোগে ময়মনসিংহে কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সাজন সাহাকে বরখাস্ত ও বিভাগীয় প্রধান রেজোয়ান আহমেদ শুভ্রকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। অভিযোগ ওঠার পর ক্যাম্পাসে আন্দোলন হয়।

এর আগে ১২ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক নাদির জুনায়েদের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ উঠলে সমালোচনার মুখে তাকে তিন মাসের বাধ্যতামূলক ছুটি দেওয়া হয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে হলেও গত ২৭ ফেব্রুয়ারি ছাত্রীকে যৌন হয়রানির অভিযোগে রাজধানীর শীর্ষস্থানীয় ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের আজিমপুর শাখার গণিতের শিক্ষক মুরাদ হোসেন সরকারকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।  ওই কলেজের ছাত্রীরা আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন।

ভুক্তভোগীরা সাধারণত অভিযোগ করেন না

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আব্দুল আলীম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানির বিষয়ে ২০২৩ সালের অক্টোবর পর্যন্ত এক বছর গবেষণা পরিচালনা করেন। মোট ২০০ শিক্ষার্থীর সাক্ষাৎকার নেন তিনি।

“স্ট্র্যাটেজিস ফর প্রিভেন্টিং মাসকুলিনিটি অ্যান্ড জেন্ডার বেজড ভায়োলেন্স ইন হায়ার এডুকেশনাল ইনস্টিটিউশন ইন বাংলাদেশ: আ স্টাডি অব রাজশাহী ইউনিভার্সিটি” শিরোনামের ওই গবেষণায় বলা হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌন নিপীড়কদের মধ্যে নয় শতাংশই শিক্ষক।

গবেষণায় অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের তথ্য মতে, নির্যাতনের ৩০ শতাংশ বাজে মন্তব্য ও ৬০ শতাংশ সাইবার হয়রানির শিকার।  নিপীড়নের ঘটনায় মাত্র ১০ শতাংশ ছাত্রী অভিযোগ করেছেন।  বিভাগের শিক্ষকের কাছে পাঁচ শতাংশ ও বাকি পাঁচ শতাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিযোগ সেলে অভিযোগ করেছেন।

হয়রানির সেলে অভিযোগ করেননি বলে জানিয়েছেন ৯০ শতাংশ শিক্ষার্থী।

এ প্রসঙ্গে অধিকার কর্মী খুশি কবীর বেনারকে বলেন, “কিছু অভিযোগ সামনে আসছে। কিন্তু যখন দীর্ঘসূত্রিতায় কর্তৃপক্ষ বা আইনের কাছে ফলাফল পাওয়া যাচ্ছে না এবং অভিযোগ প্রমাণের জন্য হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে, তখন শিক্ষার্থী মনে করেন এটা করে আরও বেশি সমস্যা পড়বো কি না।  অভিযোগকারী ছাত্রীর দিকেই অনেক সময় আঙুল তোলা হয়।”

দৃষ্টান্ত হিসেবে তিনি বলেন, প্রশাসনিক জটিলতায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই শিক্ষার্থী যৌন নিপীড়ন অভিযোগ সেলে অভিযোগ করতে পারেনি।  আবার বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন নিপীড়নের শিকার হলেও বাড়তি হয়রানির ভয়ে অধিকাংশই অভিযোগ করতে চান না।

তিনি বলেন, “শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষার্থীবান্ধব হওয়া উচিত, যাতে তাঁরা অভিযোগ নিয়ে আসতে পারেন।  শিক্ষার্থীরা যেন মনে করেন যে, এখানে গেলে আমি বিচার পাব; এই আস্থাটা আগে অর্জন করতে হবে।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।