কাজের প্রলোভন দেখিয়ে নারী পাচার: বাংলাদেশ ও ভারতে গ্রেপ্তার ১৩
2021.06.04
ঢাকা ও কলকাতা

সম্প্রতি বাংলাদেশের এক নারীকে ভারতে নির্যাতনের ভিডিও প্রকাশের সূত্র ধরে দুই দেশে গ্রেপ্তার আন্তর্জাতিক মানব পাচার চক্রের ১৩ সদস্যের দেয়া তথ্যে বিস্মিত মানবাধিকার কর্মীরা।
আন্তসীমান্ত নারী পাচার চলমান থাকার কথা স্বীকার করেছে উভয় দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী। এই কর্মকাণ্ড প্রতিরোধে প্রচেষ্টা থাকার দাবি করেছেন দুই দেশের কর্মকর্তারা।
তবে ভারতীয় মানবাধিকার সংগঠন মানবাধিকার সুরক্ষা মঞ্চের সম্পাদক কিরীটি রায়ের মতে, “সীমান্তে পাচার চালু থাকার জন্য দায়ী দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ ও বিজিবি, উভয় বাহিনীর ব্যর্থতার কারণে এটা থামছে না।”
বাংলাদেশের তিন সীমান্তবর্তী জেলায় সম্প্রতি গ্রেপ্তার পাচারকারীদের স্বীকারোক্তির বরাত দিয়ে চলতি সপ্তাহে পৃথক সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা মহানগর পুলিশ এবং র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়ন (র্যাব) জানিয়েছে, সংঘবদ্ধ চক্রটি গত সাত-আট বছরে দেড় হাজারের বেশি বাংলাদেশি নারীকে ভারতে পাচার করেছে। এদের একাংশকে দুবাইসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে পাচার করা হয়েছে।
এই চক্রটির মূলোৎপাটনে দুই দেশের আইনশৃঙ্খলাবাহিনী এরই মধ্যে কাজ শুরু করেছে বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।
গত কয়েক বছরে দেড় হাজার নারী পাচার
বাংলাদেশি এক তরুণীকে ভারতে আটকে রেখে বিবস্ত্র করে নির্যাতনের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর গত ২৭ মে কর্ণাটক রাজ্যের রাজধানী বেঙ্গালুরু থেকে ওই পাচার চক্রের ছয় সদস্যকে গ্রেপ্তার করে সেখানকার পুলিশ, যাদের সবাই বাংলাদেশি।
তাঁদের জেরা করে বেঙ্গালুরু নির্যাতিতাকে প্রতিবেশী কেরল রাজ্যর পতিতালয় থেকে পুলিশ উদ্ধার করে। বর্তমানে তাঁকে সেফ হোমে রাখা হয়েছে বলে বেঙ্গালুরুর পুলিশ জানায়।
এদিকে ঢাকার হাতিরঝিল থানায় গিয়ে ওই তরুণীর বাবা মানব পাচার ও পর্নোগ্রাফি আইনে পাঁচজনকে আসামি করে মামলা করেন।
একই চক্রের ১২ জনকে আসামি করে গত সোমবার একই থানায় আরেকটি মামলা করেন ওই পাচারকারীদের হাত থেকে পালিয়ে দেশে ফেরা আরেক কিশোরী।
প্রথম মামলাটির পরিপ্রেক্ষিতে সোম ও মঙ্গলবার ঝিনাইদহ, যশোর ও বেনাপোলে অভিযান চালিয়ে চক্রের ‘মূল হোতা’ আশরাফুল ইসলাম ওরফে বস রাফি (৩০) এবং তার তিন সহযোগীকে গ্রেপ্তার করে র্যাব।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন গত মঙ্গলবার গণমাধ্যমকে জানান, জিজ্ঞাসাবাদে আশরাফুল পাঁচ বছরে পাঁচ শতাধিক নারীকে ভারতে পাচার করার কথা জানিয়েছেন, যাদের একাংশকে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে ও অন্যদের দুবাইসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে বিক্রি করা হয়েছে।
একইদিন দেশে ফেরা কিশোরীর মামলায় তিনজনকে সাতক্ষীরা থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তাঁদের মধ্যে মেহেদী হাসান বাবু গত সাত-আট বছরে (৩৫) এক হাজারের বেশি নারীকে অবৈধ পথে ভারতে পাচারের সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছেন বলে বুধবার সাংবাদিকদের জানান পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের ডিসি।
মামলা দুটির তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) মোহাম্মদ মহিউদ্দিন ফারুক বেনারকে জানান, সাতক্ষীরা থেকে গ্রেপ্তার তিন পাচারকারীকে বৃহস্পতিবার ঢাকার আদালত পাঁচদিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেছে। এর আগে গ্রেপ্তার চার পাচারকারীকে বুধবার থেকে পাঁচদিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেছে পুলিশ।
পরিসংখ্যান ‘আসল ভয়াবহতাকে’ আড়াল করে দেয়
পাচারকারীদের বরাত দিয়ে র্যাব ও পুলিশ যে সংখ্যা প্রকাশ করেছে তা মানতে নারাজ বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। বিজিবির পরিচালক (অপারেশন্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফয়জুর রহমান।
তিনি বেনারকে বলেন, “পুলিশ ও র্যাবের হাতে আটক হওয়া পাচারকারীরা জিজ্ঞাসাবাদে নিজেদের পাচার চেষ্টার কথা সম্ভবত স্বীকার করেছে। তাঁদের যেসব চেষ্টা সফল হয়নি, সেগুলোর কথাও হয়তো বলেছে।”
অবৈধভাবে সীমান্ত অতিক্রমের চেষ্টাকারীদের কেউই বিজিবির চোখ ফাঁকি দিতে পারছে না দাবি করে এই কর্মকর্তা আরো বলেন, “যে সময়কালে ওই এক হাজার বা পাঁচশকে পাচারের কথা তারা কথা বলেছে, সেই সময়ে ওইসব সীমান্ত অতিক্রমের চেষ্টাকালে বিজিবির কাছে আটক হওয়া বাংলাদেশির সংখ্যাও প্রায় কাছাকাছি।”
তবে আটক হওয়াদের দেওয়া পাচার হওয়া নারীদের সংখ্যা সঠিক কি না তা “এখনও যাচাই–বাছাইয়ের পর্যায়ে আছে,” বলে বেনারকে জানান পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মো. শহিদুল্লাহ।
এদিকে পাচারকারীদের দেওয়া “সংখ্যাটা আসলেই উদ্বেগজনক” মন্তব্য করে গবেষণা ও উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান ইনসিডিন বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক একেএম মাসুদ আলী বেনারকে বলেন, “তবে মানব পাচারের ক্ষেত্রে পরিসংখ্যান ঘটনার আসল ভয়াবহতাকে আড়াল করে। একটি মানুষ, একটি মুখ বা একটি পরিবারকে ঘিরে যে যন্ত্রণা তা সংখ্যার তলায় চাপা পড়ে যায়।”
“এটাকে স্রেফ পরিসংখ্যান হিসেবে না দেখে প্রতিটি সংখ্যার পিছনে যে মুখটি রয়েছে, সেটি দেখা প্রয়োজন,” যোগ করেন তিনি।
বিজিবির ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম চার মাসে ৬৯৮ জনকে অবৈধভাবে সীমান্ত অতিক্রমের সময় আটক করে থানায় সোপর্দ করেছে তারা।
“তাদের মধ্যে কেউ পাচারের শিকার হচ্ছিল কিনা তা যাচাইয়ের সক্ষমতা বিজিবির নেই। তাই উদ্ধারের পর পরবর্তী আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য আমরা সবাইকে পুলিশের হাতে সোপর্দ করি,” বেনারের প্রশ্নের জবাবে বলেন বিজিবির কর্মকর্তা ফয়জুর রহমান।
বাংলাদেশ ও ভারতে পাচার সিন্ডিকেট সক্রিয়: বিএসএফ
ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বিএসএফ স্বীকার করেছে, বাংলাদেশ থেকে ভারতে নারী ও কিশোরী পাচারের ঘটনা ঘটছে, এটা বন্ধেরও চেষ্টা চলছে।
বিএসএফের দক্ষিণ বঙ্গ ফ্রন্টিয়ারের মুখপাত্র ডিআইজি সুরজিৎ সিং গুলেরিয়া শুক্রবার বেনারকে বলেন, এ বছরের প্রথম পাঁচ মাসে বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়ে আসা ২৩ নারী ও চার কিশোরীকে উদ্ধার করা হয়েছে, এসব ঘটনায় ২৪টি মামলা হয়েছে।”
“সব ক্ষেত্রে আটককৃতরা জেরার সময় বিএসএফকে পাচার হয়ে আসা ও ভারতে বিক্রি হওয়ার করুণ কাহিনী তুলে ধরে,” জানান বিএসএফ মুখপাত্র।
বিএসএফ সূত্রে বলা হয়, “সর্বশেষ গত ৩ জুন ও ২৯ মে সীমান্তের দুটি এলাকায় বেশ কয়েকজন নারীকে আটক করার পর জিজ্ঞাসাবাদে তারা জানান, ভালো কাজের লোভ দেখিয়ে দালালচক্র তাঁদের ভারতে নিয়ে এসে পতিতালয়ে বিক্রি করে দেয়।”
বিএসএফ-এর দাবি, বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় ও সীমান্তবর্তী এলাকায় মানব পাচারের সিন্ডিকেটগুলো রীতিমত সক্রিয়। ভারতেও সিন্ডিকেটগুলো সমানভাবে সক্রিয়। এরা প্রচুর অর্থের লোভে নারী ও কিশোরীদের পাচার করে এনে পুনে, সুরাট, চেন্নাই, দিল্লি, কলকাতাসহ বিভিন্নস্থানে পাঠিয়ে দেয়।
নারী পাচার বন্ধ করতে বিএসএফ কতটা সক্রিয়, সে ব্যাপারে গুলেরিয়া বলেন, বিএসএফে পাচার রোধে আলাদা অ্যান্টি ট্রাফিকিং ইউনিট রয়েছে। এ ছাড়া বিএসএফের নিজস্ব গোয়েন্দা বিভাগও এ ব্যাপারে সক্রিয় থাকে।
মানবাধিকার সুরক্ষা মঞ্চের সম্পাদক কিরীটি রায় বেনারকে বলেন, “প্রতি বছর শত শত নারী ও কিশোর ভারতে পাচার হয়ে আসছে। অনেকে ধরা পড়লেও বাকিদের দালালরা পাঠিয়ে দেয় ভারতের বিভিন্ন শহরে। সেখানে তাদের বিক্রি করে দেওয়া হয়।”
কাজের প্রলোভন দেখিয়ে বাংলাদেশ থেকে নারী ও কিশোরীদের পাচার করে ভারতে এনে তাঁদের “পতিতাবৃত্তিতে লাগানো হয়,” বলে মন্তব্য করেন কিরীটি রায়।
তাঁর মতে এর বাইরে “পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরার বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী কারাগারগুলোতে “প্রচুর বাংলাদেশি নারী রয়েছেন,” যারা পাচারের শিকার হবার পর বৈধ কাগজপত্র ছাড়া আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর হাতে ধরার পড়ার পর অবৈধ অভিবাসী হিসেবে জেল খাটছেন।
মানব পাচারের শিকার তিন শতাধিক মানুষকে ভারত থেকে ফিরিয়ে আনার অভিজ্ঞতা রয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের রেসকিউ, রিকভারি, রিপ্যাট্রিয়েশন এবং ইন্টিগ্রেশন (আরআরআরআই) টাস্কফোর্সের সদস্য সংস্থা জাস্টিস অ্যান্ড কেয়ার বাংলাদেশের, প্রতিবেশী দেশের ৪৪টি সংস্থা যাদের সহযোগী।
সংস্থাটি ভারতে নির্যাতিত হবার পর উদ্ধার হওয়া মেয়েটিকে দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য সেখানকার কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করছে। তবে সেই নারী সেখানে সংঘটিত অপরাধের প্রধান সাক্ষী হওয়ায় তিনি কবে দেশে ফিরে আসতে পারবেন তা ভারতের আদালতের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করবে বলে বেনারকে জানান সংস্থাটির কান্ট্রি ডিরেক্টর মোহাম্মদ তরিকুল ইসলাম।