স্বজন হারানোর বেদনা থেকে অগ্নিসৈনিক

কলকাতা থেকে পরিতোষ পাল
2017.02.10
পশ্চিমবঙ্গ অগ্নিনির্বাপন ও জরুরি পরিষেবা দপ্তর থেকে বিপিনকে দেওয়া পরিচয়পত্র। পশ্চিমবঙ্গ অগ্নিনির্বাপন ও জরুরি পরিষেবা দপ্তর থেকে বিপিনকে দেওয়া পরিচয়পত্র। ফাইল ছবি।
পরিতোষ পাল/বেনার নিউজ

চোখের সামনে যখন নিজের সহোদর আগুনে পুড়ছিল তখন কিছুই করতে পারেনি বারো বছরের কিশোর। কিন্তু ভাইয়ের সেই মৃত্যুস্মৃতিই আজ তাকে করে তুলেছে রাষ্ট্রীয় সম্মানে ভূষিত অগ্নিসৈনিক।

“বারো বছর বয়সে দাদাকে আগুনের গ্রাসে নিভে যেতে দেখেছি। সেই থেকেই মনের কোণে আগুন নেভানোর বাসনা চেপে বসে। এখন আগুনই আমাকে টেনে নিয়ে যায়।”

বেনারকে বলছিলেন মধ্য কলকাতার দেবেন্দ্র মল্লিক স্ট্রিটে বসবাসকারী গুজরাটি পরিবারের সন্তান বিপিন গনত্রা। কলকাতার এই বাড়িতেই জন্মেছেন ৬০ বছর বয়স্ক এই স্বেচ্ছাসেবী অগ্নিসৈনিক।

পেশায় তিনি একজন সামান্য উপার্জনকারী ইলেক্ট্রিশিয়ান।

গত চল্লিশ বছরে কলকাতায় একশটিরও বেশি আগুন নেভানোর কাজ করেছেন তিনি। এমনকি ১৯৯৪ সালে বাইপাস হার্ট সার্জারির পরও নিরলসভাবে আগুনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন।

পশ্চিমবঙ্গ দমকলের সাবেক অতিরিক্ত ডিরেক্টর জেনারেল ডিপি বিশ্বাস বেনারকে বলেন, “গত চার দশকে কলকাতার সব কটি বড় আগুন নেভানোর কাজে বিপিনের অবদান রয়েছে।”

বিপিনের এই নিঃস্বার্থ সমাজ সেবার স্বীকৃতি হিসেবে ভারত সরকার এ বছর তাকে ভারতের চতুর্থ সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান ‘পদ্মশ্রী’ দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছে।

কলকাতা পুলিশের দেওয়া ক্রেস্ট হাতে বিপিন। ফেব্রুয়ারি ০৭, ২০১৭।
কলকাতা পুলিশের দেওয়া ক্রেস্ট হাতে বিপিন। ফেব্রুয়ারি ০৭, ২০১৭।
ছবি: পরিতোষ পাল/বেনার নিউজ
প্রশিক্ষণ না থাকলেও আছে আগ্রহ

বিপিন পেশাদার ফায়ার ফাইটার নন। আগুন নেভানোর কোনো প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণও নেই তার। কিন্তু নিজের আগ্রহ আর দীর্ঘদিন দমকল বাহিনীর সাথে কাজের অভিজ্ঞতা থেকেই এখন তিনি আগুনের রং চেনেন। আগুনের শব্দ বোঝেন।

“আগুনের লাল ও নীল রং দেখে বুঝে নিতে হবে ভেতরে কী ধরনের বিপদ রয়েছে। নীল রঙের আগুন দেখলেই বুঝতে হবে ভেতরে রাসায়নিক পদার্থ বা ওই জাতীয় কিছু রয়েছে। শব্দ থেকে বোঝা যায় আগুন কী ধরনের ক্ষতি করছে।” বেনারকে জানান বিপিন।

৬০ বছর বয়সেও তিনি সারা দিন টিভির পর্দায় নজর রাখেন আগুন লাগার খবর জানতে। দমকলের কন্ট্রোল রুমে ফোন করে খোঁজ নেন। সাধারণ মানুষও তাঁকে খবর দেন।

আগুন লাগার খবর পেলেই বিপিন ছুটে যান অনেকের আগে। দমকল কর্মীদের আগেই নিজের মতো করে আগুন নেভানোর জন্য প্রস্তুতিমূলক কাজ শুরু করে দেন।

“বিপিন আসলে আমাদের গাইড হিসেবে কাজ করেন। আগে পৌঁছালে আগুনের চরিত্রটা বোঝার চেষ্টা করেন। স্থানীয়দের মবিলাইজ করেন যাতে কোনও দুর্ঘটনা না ঘটে।”

বেনারকে জানান বিপিনের সঙ্গে কাজ করেছেন এমন একজন দমকল কর্মী।

ওই দমকল কর্মীর মতে, দমকল বাহিনীর যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে উদ্ধার কাজে সহযোগিতা করা কিংবা ধ্বংসস্তূপ আপসারণ করার পাশপাশি, প্রয়োজনে বিপিন ট্রাফিক সামলানোর কাজও করেন।

ডিপি বিশ্বাসের মতে, “কোনো প্রশিক্ষণ না নিয়েও বিপিন এখন পেশাদারের মতোই দমকল বাহিনীর পাশে থেকে কাজ করেন।”

মিলেছে স্বীকৃতি ও সম্মান

রাষ্ট্রীয় পদ্মশ্রী পুরস্কার পাবার আগেই পশ্চিমবঙ্গ বিপিনকে দিয়েছে স্বীকৃতি ও সম্মান।

নিঃস্বার্থ সেবার জন্য ২০০৯ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অগ্নিনির্বাপক ও জরুরি পরিষেবা দপ্তর বিপিনকে পিতলের তৈরি বিশেষ স্বেচ্ছাসেবক পরিচয়পত্র দিয়েছে। তৎকালীন দমকল মন্ত্রী নিজে এই পরিচয়পত্র তাঁর হাতে তুলে দিয়েছিলেন।

পশ্চিমবঙ্গ দমকল বিভাগ থেকে বিপিন পেয়েছেন ইউনিফর্ম ও ব্যাজ।

পশ্চিমবঙ্গ দমকলের সাবেক অতিরিক্ত ডিরেক্টর জেনারেল ডিপি বিশ্বাস বেনারকে বলেন, “বিপিন সব ধরনের সামাজিক কাজের সঙ্গে যুক্ত।”

৯ ফেব্রুয়ারি এই প্রতিবেদক বিপিনের বাড়ি গেলে ডিপি বিশ্বাসের কথার প্রমাণ পাওয়া যায়। বিপিনের ছোট্ট ঘরে আসবাবপত্র কিছু না থাকলেও ঘর ভরে আছে সামজসেবার বহু পুরস্কারে।

বিপিন অনেক গরীব মানুষের পাশে দাঁড়ান। মানুষের সেবা করেন নিজের সাধ্যমতো। এমনকি রাস্তায় ট্রাফিক সামলানোর কাজেও তাকে দেখা যায়।

আর বিপিনের সবচে বড়ো অবদান আগুন নেভানোর স্বীকৃতি হিসেবে আগামী মার্চ-এপ্রিল মাসে নয়াদিল্লিতে রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় আনুষ্ঠানিকভাবে তার  হাতে তুলে দেবেন রাষ্ট্রীয় পুরস্কার ‘পদ্মশ্রী’।

তবে বিপিনের মতে, “এই সম্মান আমার একার নয়। এই সম্মান দমকল ও পুলিশ বাহিনীর সকলের।”

কারণ তিনি মনে করেন, সকলের সহযোগিতার জন্যই তিনি তার কাজ করে যেতে পারেন।

‘অগ্নিরক্ষকদের পেছনে তাকাতে নেই’

কোথাও আগুন লাগতে দেখলে রোগা পাতলা চেহারার বিপিন অন্য মানুষ হয়ে ওঠেন।

“তখন আমি অসীম মনোবলের অধিকারী হয়ে উঠি। শান্ত মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ি,” বেনারকে জানান বিপিন।

তাঁর এই কথার সমর্থন মিলে কলকাতা পুলিশের এক শীর্ষ আধিকারিকের কথায়। তিনি বেনারকে জানান, বিপিন যেভাবে ঝুঁকি নিয়ে এগিয়ে যায় তা প্রশিক্ষিত দমকল কর্মীদের অনেকেও করতে সাহস পান না।

এই প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে বিপিন বলেন, ২০১১ সালে দক্ষিণ কলকাতার আমরি হাসপাতালে আগুন লেগে মৃত্যুর ঘটনা তার মনের কোণে জ্বল জ্বল করে। ওই অগ্নিকাণ্ডে ৮৯ জনের মৃত্যু হয়েছিল।

বিপিন জানান, ধোঁয়ার কুণ্ডলী ভেদ করে ভেতরে গিয়ে দেখেন মাটিতে ও বেডে মৃত বেশ কয়েকজন রোগী। আইসিসিইউতে বেড থেকে পড়ে মৃত্যু হয়েছে বেশ কয়েকজনের। চারদিকে শুধুই মৃতদেহ।

এই রকম মৃত্যু আরও দেখেছেন তিনি। বাঁচাতে চেষ্টা করেও বাঁচাতে পারেননি এমন ঘটনাও রয়েছে অনেক।

তবে শেষ পর্যন্ত বিপিনের একটিই কথা, “অগ্নিরক্ষকদের পেছনে তাকাতে নেই।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।