প্রশ্ন ফাঁস তদন্তে উচ্চ আদালত দুটি কমিটি করে দিলো

জেসমিন পাপড়ি
2018.02.15
ঢাকা
এসএসসি পরীক্ষার ফাঁস হওয়া প্রশ্ন মোবাইলে দেখা যাচ্ছে। ঢাকার একটি কেন্দ্র থেকে তোলা। এসএসসি পরীক্ষার ফাঁস হওয়া প্রশ্ন মোবাইলে দেখা যাচ্ছে। ঢাকার একটি কেন্দ্র থেকে তোলা। ৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮।
নিউজরুম ফটো

নানামুখী উদ্যোগ নিয়েও একের পর এক পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস ঠেকাতে সরকারের ব্যর্থতা শেষ পর্যন্ত আদালতে গড়িয়েছে। এসএসসিসহ বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা তদন্তে দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করে দিয়েছে বাংলাদেশের উচ্চ আদালত।

বৃহস্পতিবার একটি রিট আবেদনের শুনানি শেষ এই আদেশ দেন বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরী ও বিচারপতি মো. ইকবাল কবিরের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ।

টানা কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশে বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা ঘটছে। এবারও চলমান এসএসসি পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁস ঠেকাতে সরকারের নেওয়া উদ্যোগকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে প্রতিটি বিষয়ের প্রশ্ন পরীক্ষার আগেই ফেসবুকে পাওয়া যাচ্ছে। এমনই প্রেক্ষাপটে উচ্চ আদালতের এই আদেশ এল।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদের নেতৃত্বে প্রশাসনিক কমিটি এবং ঢাকা জেলা ও দায়রা জজের নেতৃত্বে বিচারিক তদন্ত কমিটি গঠন করে দিয়েছে আদালত।

আদালতের লিখিত আদেশ পাওয়ার সাত দিনের মধ্যে কমিটিকে কাজ শুরু করতে বলা হয়েছে। পাঁচজন করে সদস্য নিয়ে গঠিত কমিটি দুটিকে পরবর্তী ৩০ দিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করতে বলা হয়েছে।

আদালতে শুনানিতে রিট আবেদনের পক্ষে ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া এবং রাষ্ট্রপক্ষে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এস এম মনিরুজ্জামান অংশ নেন।

“রায়ে আদালত প্রশাসনিক এবং বিচারিক দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করে দিয়েছে। বিচারিক কমিটি প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে কারা জড়িত, প্রশ্ন কীভাবে ফাঁস হচ্ছে, কোন কোন মাধ্যমে হচ্ছে—এসব বিষয় খুঁজে বের করবে এবং তাদের বিরুদ্ধে কী শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া যায় সে সুপারিশ করবে,” বেনারকে বলেন ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া।

ঢাকা জেলা ও দায়রা জজের নেতৃত্বে বিচারিক কমিটিতে নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরের চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট এবং আইন ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন করে উপ-সচিব থাকবেন।

“একই সঙ্গে আদালত যে প্রশাসনিক কমিটি গঠন করে দিয়েছেন তার কাজ হলো, প্রশ্ন ফাঁস প্রতিরোধের জন্য কী কী ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে এবং কী পদ্ধতি অনুসরণ করলে ভবিষ্যতের পাবলিক পরীক্ষাগুলোতে যাতে প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা আর না ঘটে সেসব নির্ধারণ করা,” বলেন জ্যোতির্ময় বড়ুয়া।

এই কমিটির নেতৃত্ব দেবেন ড. কায়কোবাদ। এছাড়া আরো থাকবেন বুয়েটের অধ্যাপক সোহেল রহমান, মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরে মহাপরিচালক, কম্পিউটার সোসাইটির একজন বিশেষজ্ঞ এবং সিআইডির ডিআইজি পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা।

এর আগে বুধবার চলমান এসএসসি পরীক্ষা বাতিল করে নতুন প্রশ্নপত্র দিয়ে পুনরায় পরীক্ষা নেওয়ার নির্দেশনা, প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায় বিচারিক ও প্রশাসনিক তদন্ত কমিটি গঠন এবং প্রশ্ন ফাঁসের অপরাধ দমনে আইন প্রণয়নের নির্দেশনা চেয়ে রিট আবেদন করেন সুপ্রিম কোর্টের কয়েকজন আইনজীবী।

বৃহস্পতিবার সকালে একদফা শুনানি শেষে দুই সপ্তাহের মধ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সচিব, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় সচিব, আইন মন্ত্রণালয় সচিব, আইন মন্ত্রণালয়ের ড্রাফটিং উইংয়ের সচিব, স্বরাষ্ট্রসচিব, তথ্য প্রযুক্তি সচিব, বিটিআরসি’র সচিব-চেয়ারম্যান, বিটিসিএল’র চেয়ারম্যান, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এবং ঢাকা, রাজশাহী, কুমিল্লা, যশোর, চট্টগ্রাম, বরিশাল, সিলেট ও দিনাজপুর মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক ও মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান এবং পুলিশের মহাপরিদর্শককে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।

“বর্তমানে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রশ্নফাঁস যেভাবে মহামারি আকার ধারণ করেছে, তা মাদকাসক্তির চেয়ে ভয়ানক বলে শুনানিতে বলেছেন আদালত,” সাংবাদিকদের বলেন রিট আবেদনকারী মাহমুদুর রাজি।

৬ বছরে ৮০ বার প্রশ্নপত্র ফাঁস

গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, ২০১২ সালের পর থেকে গত ছয় বছরে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষায় কমপক্ষে ৮০ বার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে। ২০১৫ সালে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের প্রতিবেদনে চার বছরে বিভিন্ন পরীক্ষায় ৬৩টি বিষয়ে প্রশ্নপত্র ফাঁসের কথা বলা হয়।

কেবল পাবলিক পরীক্ষা নয়, ২০০৩ সাল থেকে এ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত বিসিএসসহ বিভিন্ন চাকরির নিয়োগ পরীক্ষায়ও অর্ধশতাধিক প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা ঘটেছে। বাদ যায়নি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বার্ষিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্রও। যার ফলশ্রুতিতে গত ডিসেম্বরে তিন শ’র বেশি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বার্ষিক পরীক্ষা স্থগিত করতে হয়।

এবারও প্রশ্ন ফাঁস রোধে এসএসসি পরীক্ষার আগে ইন্টারনেট ও ফেসবুক বন্ধ রাখার মতো সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। তবে শেষ মুহূর্তে সেটা কার্যকর হয়নি। পরে প্রশ্ন ফাঁসকারীকে ধরিয়ে দিলে ৫ লাখ টাকা পুরস্কারও ঘোষণা করা হয়। তাতেও কাঙ্ক্ষিত ফল না আসায় প্রশ্ন ফাঁস ঠেকাতে ধরপাকড় শুরু করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। গত এক সপ্তাহে প্রশ্ন ফাঁসের দায়ে পরীক্ষার্থীসহ প্রায় একশ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

বর্তমান পদ্ধতিতে প্রশ্ন ফাঁস ঠেকানো সম্ভব নয়

প্রশ্ন ফাঁস নিয়ে রীতিমতো বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছে সরকার।

বৃহস্পতিবার শিক্ষাসচিব মো.সোহরাব হোসাইন সাংবাদিকদের বলেন, “এই প্রক্রিয়ায় প্রশ্ন ফাঁস রোধ করা সম্ভব নয়। আমাদের নতুন এমন কোনো প্রক্রিয়া, এমন কোনো পদ্ধতিতে যেতে হবে, যেখানে প্রশ্নপত্র ফাঁসের সুযোগ থাকবে না।”

আগামী বছর থেকে নতুন পদ্ধতিতে এসএসসি পরীক্ষা নেওয়া হবে বলেও তিনি জানান।

প্রশ্ন ফাঁসের জন্য ইন্টারনেট ও মানুষের নৈতিক অবক্ষয়কে অনেকাংশে দায়ী করে সোহরাব হোসাইন বলেন, “প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধের জন্য প্রশ্ন প্রণয়নে নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবনের চেষ্টা করছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। আমাদের যারা গুণী ব্যক্তিরা আছেন, তাঁদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে নতুন কোনো পথ যদি উদ্ভাবন করা সম্ভব হয়, তাহলে পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁস রোধ করা সম্ভব।”

এ ক্ষেত্রে এমসিকিউ বাতিলের ইঙ্গিতও দেন তিনি।

হাই কোর্টের রুলের বিষয়ে শিক্ষাসচিব বলেন, “আদালতের আদেশ আমরা অবশ্যই পরিপূর্ণভাবে প্রতিপালন করব। আমাদের কোনো নিষ্ক্রিয়তা থাকলে সেই বিষয়ে আমাদের বক্তব্য অবশ্যই আদালতের কাছে উপস্থাপন করব।“

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. নেহাল করিম বেনারকে বলেন, “পরীক্ষার নামে যে প্রহসন দেশের নতুন প্রজন্মের সঙ্গে হচ্ছে, তা একটি জাতি ধ্বংস হওয়ার জন্য যথেষ্ঠ।”

“আজ যারা এসএসসি বা এইচএসসি পরীক্ষার্থী, কয়েকবছর পরে তারাই দেশের কর্ণধার হবে। অথচ তারা বেড়ে উঠছে অনৈতিকতার মধ্য দিয়ে। তাই প্রশ্ন ফাঁস রোধে কঠোর হওয়া প্রয়োজন,” বলেন তিনি।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।