সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গন থেকে ভাস্কর্য সরানোর পক্ষে প্রধানমন্ত্রী
2017.04.12
ঢাকা

হেফাজতে ইসলামসহ অন্যান্য ইসলাম ধর্মভিত্তিক দলের দাবি অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্ট চত্বর থেকে ভাস্কর্য অপসারণ করতে যাচ্ছে সরকার। আলেম–ওলামাদের দাবি অনুযায়ী, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ বিষয়টি নিয়ে প্রধান বিচারপতির সাথে কথা বলার আশ্বাস দিয়েছেন।
দেশের প্রগতিশীল রাজনীতিক ও নাগরিকদের অনেকেই প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যে ক্ষোভ ও বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। এর প্রতিক্রিয়ায় বুধবার তাঁরা বলছেন, ভোটের রাজনীতির কারণে সরকার ধর্মভিত্তিক দলগুলোর সঙ্গে এমন আপস করছে।
সম্প্রতি হেফাজতে ইসলামের দাবি অনুযায়ী পাঠ্যবইয়ে পরিবর্তন আনা এবং সর্বশেষ গত মঙ্গলবার রাতে আলেম–ওলামাদের সঙ্গে বৈঠকে কওমি মাদ্রাসার সর্বোচ্চ স্তরকে সরকারি স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ রাজনীতিবিদ ও নাগরিক সমাজকে ভাবিয়ে তুলেছে।
বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন মনে করেন, ভাস্কর্য সরানোর মধ্য দিয়ে কিছুটা হলেও মৌলবাদী শক্তির কাছে মাথা নত করেছে সরকার।
“আমি আগেও বলেছি, এখনো বলছি হেফাজতের মাথায় হাত বুলিয়ে লাভ নেই। তারা কখনোই অন্ধ মতবাদ থেকে বেরিয়ে আসবে না,” বেনারকে জানান মেনন।
দাওরায়ে হাদিসের স্বীকৃতি দেওয়া প্রসঙ্গে মেনন বলেন, “এটা জাতীয় শিক্ষা নীতির বিরুদ্ধে। তাদের স্বীকৃতি দেওয়ার এই সিদ্ধান্ত সঠিক হয়নি।”
ভাস্কর্য অপসারণ হবে!
ন্যায় বিচারের প্রতীক হিসেবে গত ডিসেম্বরে সুপ্রিম কোর্ট চত্বরে গ্রিক দেবী থেমিসের আদলে ভাস্কর্যটি স্থাপিত হয়।
এরপর থেকেই এটি সরানোর দাবি জানিয়ে আসছে কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক কট্টরপন্থী সংগঠন হেফাজতে ইসলাম ও সমমনা দলগুলো। ভাস্কর্যটি অপসারণের দাবিতে সারা দেশে ধারাবাহিক কর্মসূচির ডাকও দেয় তারা। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন ওলামা লীগও তা অপসারণের দাবি জানিয়ে আসছিল।
গত মঙ্গলবার রাতে কওমি মাদ্রাসার আলেমদের সঙ্গে এক বৈঠকে তাদের সঙ্গে একমত পোষণ করে শেখ হাসিনা বলেন, ভাস্কর্যটি সরাতে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে কথা বলবেন তিনি। সরকারি বার্তা সংস্থা বাসসসহ বিভিন্ন গণমাধ্যম প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্য প্রকাশ করে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, “সত্য কথা বলতে কি আমি নিজেও এটা পছন্দ করিনি। কারণ গ্রিক থেমেসিসের মূর্তি আমাদের এখানে কেন আসবে? এটাতো আমাদের দেশে আসার কথা না।”
এটি সরানোর বিষয়ে ইতিমধ্যেই প্রধান বিচারপতিকে জানানো হয়েছে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, “খুব শিগগিরই আমি ওনার (প্রধান বিচারপতি) সঙ্গে এ বিষয় নিয়ে বসব। আলোচনা করব। আমি নিজেও ব্যক্তিগতভাবে মনে করি এটা এখানে থাকা উচিত নয়।”
এ বিষয়ে কোনো হইচই না করে ওলামাদের তাঁর ওপর ভরসা রাখার অনুরোধ করেন জানান প্রধানমন্ত্রী।
প্রসঙ্গত, সুপ্রিম কোর্ট চত্বরের ভাস্কর্য সরানোর দাবি জানিয়ে আগামী ৫ মে মতিঝিলে ফের সমাবেশের হুমকি দিয়ে আসছিল হেফাজত। প্রধানমন্ত্রীর এই আশ্বাসের পর সে সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে কিনা সে বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্ত জানায়নি দলটি।
তবে প্রধানমন্ত্রীর এ সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছেন প্রগতিশীল ব্যক্তি ও বিভিন্ন সংগঠন। ধর্মভিত্তিক সংগঠনগুলোর এ ধরনের দাবি মেনে নেওয়ার বিষয়টি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার পরিপন্থী বলে মনে করছেন তাঁরা।
“আমাদের যাপিত জীবনে হয়তো শেষ পেরেকটাই ঠুকে দিলেন প্রধানমন্ত্রী। এতে করে ধর্মান্ধতা, সাম্প্রদায়িকতা আরও বেশি করে ছড়াবে। এর ফল হবে ভয়াবহ এবং অচিরেই,” বেনারকে জানান উইমেন চ্যাপ্টারের সম্পাদক সুপ্রীতি ধর।
“আমরা এগোচ্ছি না, পিছিয়ে যাচ্ছি ক্রমশ,” সুপ্রীতি ধর বলেন।
এ প্রসঙ্গে সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার বেনারকে বলেন, “ভাস্কর্য সরানোর এই সিদ্ধান্ত কোনোভাবে মানা যায় না। তবে শৈল্পিক বিবেচনায় সুপ্রিম কোর্ট চত্বরের ভাস্কর্যটা সরিয়ে অন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বসানো যেতে পারে। এটা না করলে আপাতদৃষ্টিতে এই ভাস্কর্য সরানো মৌলবাদী শক্তির কাছে হার মানার নামান্তর হবে।”
দাওরায়ে হাদিস সনদকে মাস্টার্স সমমান
কওমি মাদ্রাসাগুলোর দাওরায়ে হাদিস ডিগ্রিকে মাস্টার্স সমমানের স্বীকৃতি দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। দীর্ঘদিন ধরেই এই স্বীকৃতি আদায়ের চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন কওমি নেতারা।
সরকারের সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশে প্রায় ১৪ হাজার কওমি মাদ্রাসা রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ১৪ লাখ।
এই মাদ্রাসা থেকে পাস করা শিক্ষার্থীরা সনদের সরকারি স্বীকৃতি না থাকায় দেশে–বিদেশে চাকরি পেতে সমস্যায় পড়েন। গত কয়েক দশক ধরে কওমি মাদ্রাসার নেতারা সনদের নিঃশর্ত স্বীকৃতি চেয়ে আসছিলেন। সরকার এই স্বীকৃতি দিতে চাইলেও পাঠ্যবই, সিলেবাস, পরীক্ষাপদ্ধতি প্রভৃতি বিষয়ে নিয়ম–নীতি মেনে চলার শর্ত দিয়ে আসছিল। শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী এসব শর্ত তুলে নিয়ে ধর্মভিত্তিক দলগুলোর দাবিই মেনে নিলেন।
“কওমি মাদ্রাসার দাওরায়ে হাদিসের ইসলামিক স্টাডিজ এবং আরবি সনদকে মাস্টার্স সমমান প্রদান করা হলো,” বৈঠকে ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী।
অনুষ্ঠানে হেফাজতে ইসলামির আমির আল্লামা আহমেদ শফিসহ আলেম–ওলামারা উপস্থিত ছিলেন।
“কওমি শিক্ষাকে সরকারের স্বীকৃতি দেওয়ার উদ্যোগটি ভালো। তবে সরকার-নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে শিক্ষাক্রম তৈরি করে তার আলোকে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে এই ডিগ্রি না দিলে এর গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে,” বেনারকে জানান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক অধ্যাপক মোহাম্মদ সিদ্দিকুর রহমান।