সরিয়ে ফেলা হলো সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণের ভাস্কর্য, চার প্রতিবাদকারী গ্রেফতার

জেসমিন পাপড়ি
2017.05.26
ঢাকা
ভাস্কর্য সরানোর প্রতিবাদকারীদের ওপর কাঁদুনে গ্যাস ছোড়ে পুলিশ। ভাস্কর্য সরানোর প্রতিবাদকারীদের ওপর কাঁদুনে গ্যাস ছোড়ে পুলিশ। মে ২৬, ২০১৭।
স্টার মেইল

ইসলাম ধর্মভিত্তিক সংগঠনগুলোর দাবির মুখে সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণ থেকে ভাস্কর্য সরিয়ে নেওয়ায় বাংলাদেশে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। প্রতিবাদকারীদের ওপর হামলা চালিয়ে চারজনকে আটক করেছে পুলিশ। তবে সরকারের পক্ষ থেকে ভাস্কর্য অপসারণের দায় অস্বীকার করে বলা হচ্ছে সুপ্রিম কোর্টের সিন্ধান্তেই কাজটি হয়েছে।

“ভাস্কর্য অপসারণের বিষয়টি সরকারের এখতিয়ারে নেই। সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্তেই এটি হয়েছে,” গতকাল এক অনুষ্ঠানে বলেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।

“বৃহস্পতিবার দুপুরে প্রধান বিচারপতি সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী নেতাদের সঙ্গে ভাস্কর্যটির বিষয়ে বৈঠক করেন। বৈঠক থেকে ভাস্কর্যটি সরানোর পক্ষে মত আসে,” সাংবাদিকদের জানান অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।

তবে ভাস্কর্য অপসারণ করায় প্রধানমন্ত্রীকেই ধন্যবাদ জানিয়েছে হেফাজতে ইসলাম। এর আগে সরকারের পক্ষ থেকে ভাস্কর্য অপসারণে ধর্মভিত্তিক সংগঠনগুলোর দাবি সর্বপ্রথম সমর্থনও করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

“সুপ্রিম কোর্টের সামনে থেকে গ্রিক মূর্তি অপসারণ করায় আল্লাহ পাকের সঙ্গে সঙ্গে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকেও ধন্যবাদ জানাই,” শুক্রবার বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের সামনে আয়োজিত এক সমাবেশে বলেন হেফাজতের ঢাকা মহানগর কমিটির সভাপতি মাওলানা নূর হোসাইন কাসেমী।

“আমি নিজেও ব্যক্তিগতভাবে মনে করি এটা (ভাস্কর্য) এখানে থাকা উচিত নয়,” গত ১১ এপ্রিল কওমি মাদ্রাসার আলেমদের সঙ্গে এক বৈঠকে ভাস্কর্য সরানোর বিষয়ে একমত পোষণ করে বলেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে সুপ্রিম কোর্ট চত্বর থেকে ভাস্কর্যটি সরানোর কাজ শুরু হয়। মে ২৫, ২০১৭।
বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে সুপ্রিম কোর্ট চত্বর থেকে ভাস্কর্যটি সরানোর কাজ শুরু হয়। মে ২৫, ২০১৭।
নিউজরুম ফটো
প্রসঙ্গত, ন্যায় বিচারের প্রতীক হিসেবে গত ডিসেম্বরে সুপ্রিম কোর্ট চত্বরে গ্রিক দেবী থেমিসের আদলে ভাস্কর্যটি স্থাপনের পর থেকেই এটি সরানোর দাবি জানিয়ে আসছে কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক কট্টরপন্থী সংগঠন হেফাজতে ইসলাম ও সমমনা দলগুলো।

ভাস্কর্যটি অপসারণের দাবিতে সারা দেশে ধারাবাহিক কর্মসূচির মধ্যেই প্রধানমন্ত্রীর শরণাপন্ন হয় হেফাজতে ইসলাম। গত এপ্রিলে সংগঠনটির নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিষয়টি নিয়ে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে কথা বলার আশ্বাস দেন। নিজে প্রধান বিচারপতিকে ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধও জানান।

এরপর রোজা শুরু হওয়ার মাত্র কদিন আগেই বৃহস্পতিবার রাতের আঁধারে ভাস্কর্যটি সরিয়ে ফেলা হলো। তবে এটি সুপ্রিম কোর্টের ভেতরের দিকে ভিন্ন একটি স্থানে বসানোর কাজ চলছে।

আপসের রাজনীতির ‘খারাপ দৃষ্টান্ত’

কট্টরপন্থীদের দাবির মুখে ভাস্কর্যটি সরিয়ে দেশে ‘খারাপ দৃষ্টান্ত’ স্থাপন হয়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।

এ প্রসঙ্গে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির বেনারকে বলেন, “এই কলঙ্ক জাতির ওপর, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ওপর আঘাত এনেছে। এরপরে হেফাজত দেশে সরিয়া আইন চালুর দাবি নিয়ে আসবে।”

আর পুরো বিষয়টিকে আপসের রাজনীতি হিসেবে দেখছেন মানবাধিকার কর্মী সুলতানা কামাল।

তিনি বেনারকে বলেন, “শুধু ভাস্কর্য অপসারণ নয়, পাঠ্যপুস্তকে পরিবর্তনের মতো বিষয়েও তাদের সুপারিশ গ্রহণ করেছে ক্ষমতাসীন সরকার। যারা মুখে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের কথা বললেও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধীদের সঙ্গে আপস করে যাচ্ছে।”

ভাস্করের তত্ত্বাবধানেই অপসারিত হলো

সুপ্রিম কোর্টের মূল ভবনের সামনে ফোয়ারা সংলগ্ন স্থানে গত ডিসেম্বর মাসে গ্রিক দেবী থেমিসের আদলে বাংলাদেশি নারী মূর্তিটি তৈরি করেন ভাস্কর মৃণাল হক।

অন্যরা সরাতে গেলে যাতে নিজের এই সৃষ্টির ক্ষতি না হয় সেই আশঙ্কা থেকে নিজেই ভাস্কর্যটি সরানোর সময় উপস্থিত ছিলেন তিনি।

“ওপরের চাপে ভাস্কর্যটি সরাতে হচ্ছে,” বৃহস্পতিবার রাতে সাংবাদিকদের জানান ভাস্কর মৃণল হক।

কারা চাপ দিয়েছে—জানতে চাইলে অপারগতা প্রকাশ করে তিনি বলেন, “আমার হাত-মুখ বাঁধা। মাফ চাই, আমি কিছু বলতে পারব না।”

উল্লেখ্য, বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে ১০-১২জন শ্রমিক নিয়ে ভাস্কর্য অপসারণের কাজ শুরু হয়। রাত সাড়ে ১২টার দিকে ভাস্কর্য সরানোর খবর পাওয়ার পর বিভিন্ন এলাকা থেকে সুপ্রীম কোর্টের সামনে ছুটে আসেন বিভিন্ন প্রগতিশীল রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতা-কর্মীরা। মধ্যরাতেই ঘটনাটি টেলিভিশন এবং সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।

রাত দুইটার দিকে দোয়েল চত্বরের দিক থেকে ২০/২৫ জনের একটি মিছিল সেখানে আসে। এ অবস্থায় রাত ৩টার দিকে ভাস্কর্য সরানোর কাজ কিছুক্ষণ বন্ধ রেখে আশপাশের বাতিগুলো নিভিয়ে দেওয়া হয়। অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়।

ভোররাত ৪টার দিকে ভাস্কর্যটি ভাঙার কাজ শেষ হয় এবং ক্রেনের সাহায্যে ট্রাকে তোলা হয়। এ সময় ভাস্কর মৃণাল হক প্রধান ফটকের সামনে আসলে সাংবাদিকেরা তাঁর সঙ্গে কথা বলেন।

“এই ঘটনা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরাজয়। দেশের মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তি, সংস্কৃতিপ্রেমী এবং স্বাধীনচেতা মানুষদের গালে এটা একটা চপেটাঘাত,” সাংবাদিকদের বলেন ভাস্কর মৃণাল হক।

ভাস্কর্য অপসারণ করায় প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়ে রাজধানীতে আনন্দ মিছিল করে বিভিন্ন ইসলামী দল। মে ২৬, ২০১৭।
ভাস্কর্য অপসারণ করায় প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়ে রাজধানীতে আনন্দ মিছিল করে বিভিন্ন ইসলামী দল। মে ২৬, ২০১৭।
স্টার মেইল

‘সন্তুষ্ট’ হেফাজত দেশের সব ‘মূর্তি’ অপসারণ চায়

এদিকে সুপ্রিম কোর্ট চত্বর থেকে ভাস্কর্য সরানোয় দেশবাসী ও প্রধানমন্ত্রীর প্রতি সন্তোষ প্রকাশ করে সারা দেশে স্থাপিত সকল ‘মূর্তি’ সরানোর দাবি জানিয়েছে হেফাজতে ইসলাম।

শুক্রবার জুমার নামাজ শেষে বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের সামনে এক সংক্ষিপ্ত সমাবেশে এ দাবি জানান সংগঠনটির ঢাকা মহানগর শাখার নেতারা।

“এই দেশে মূর্তি সংস্কৃতি চলবে না। …কাজেই যত মূর্তি স্থাপন করা হয়েছে, সমস্ত অপসারণ করা হোক,” বলেন মাওলানা কাসেমী।

হেফাজতের নেতা মাওলানা মুজিবুর রহমান হামিদি দেশের কোথাও আর কোনো ‘মূর্তি’ স্থাপন করা যাবে না বলেও হুঁশিয়ারি দেন।

একই কারণে প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়ে মিছিল বের করে বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন। সংগঠনটির নেতা মুফতি রেদওয়ানুল বারি সিরাজী বলেন, “আমরা চাই, বাংলাদেশ থেকে যত মূর্তি আছে সব অপসারণ করা হোক।”

রাতভর বিক্ষোভ, সকালে আটক চার

বৃহস্পতিবার রাতে ভাস্কর্য সরানোর খবর পেয়ে ছুটে এসে আদালত ফটকের সামনে বিক্ষোভ করেন বিভিন্ন প্রগতিশীল রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতা-কর্মীরা।

শুক্রবার সকালেও চলে বিক্ষোভকারীদের প্রতিবাদ। তবে এক পর্যায়ে পুলিশি বাধার মুখে পড়েন তাঁরা। রাজধানীর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় সমাবেশ শেষে বিক্ষোভকারীরা একটি মিছিল নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করলে কাঁদানে গ্যাসের শেল ও জল কামান নিক্ষেপ করে তাঁদের ছত্রভঙ্গ করে দেয় পুলিশ।

বিক্ষোভকারীরা জানান, আটক চারজনের মধ্যে ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক লিটন নন্দী রয়েছেন। এ ছাড়া পুলিশের বাধায় অন্তত পাঁচজন আহত হয়েছেন বলেও দাবি করেন তাঁরা।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা মহানগর পুলিশের রমনা বিভাগের উপকমিশনার মারুফ হোসেন সরদার সাংবাদিকদের বলেন, “হাইকোর্টের সামনে কেউ বিক্ষোভ করতে পারেন না। তাই নিরাপত্তার স্বার্থে বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করা হয়।”

প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন পুলক ঘটক

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।