ন্যায়বিচারের ভাস্কর্য স্থাপন ও পুনঃস্থাপন নিয়ে নাটকীয়তা

পুলক ঘটক
2017.05.30
সুপ্রিম কোর্ট চত্বরে স্থাপিত ভাস্কর্যটি মধ্যরাতে সরানো হচ্ছে। সুপ্রিম কোর্ট চত্বরে স্থাপিত ভাস্কর্যটি মধ্যরাতে সরানো হচ্ছে। মে ২৫, ২০১৭।
নিউজরুম ফটো

বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে লেডি জাস্টিসের ভাস্কর্যের স্থানান্তর নিয়ে ধর্মনিরপেক্ষ ও ইসলামপন্থী উভয় পক্ষই নাখোশ হয়েছে। হেফাজতে ইসলামসহ ধর্মভিত্তিক কয়েকটি সংগঠনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে কোর্টের লিলি ফোয়ারা চত্বর থেকে ভাস্কর্যটি সরিয়ে ফেলা হয়েছিল। এরপর শনিবার রাতে সেটি কোর্টেরই বর্ধিত ভবনের (অ্যানেক্স) সামনে পুনরায় স্থাপন করা হয়।

“এটি প্রদর্শন না করার মতোই। কারণ আদালতে আসা মানুষজন ছাড়া এটি আর কেউ দেখতে পাবে না,” পুনঃস্থাপিত ভাস্কর্য সম্পর্কে সোমবার এক প্রতিক্রিয়ায় বেনারকে বলেন ভাস্কর মৃণাল হক।

এর আগে মৌলবাদীদের দাবির প্রেক্ষিতে ভাস্কর্যটি সরিয়ে ফেলার ঘটনাকে “দেশের প্রগতিশীল মানুষের মুখে একটি কশাঘাত” বলে উল্লেখ করেছিলেন তিনি।

প্রসঙ্গত, হেফাজতে ইসলামের প্রধান শাহ আহমেদ শফীসহ আরও কয়েকজন আলেমের সঙ্গে গত ১১ এপ্রিল এক বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভাস্কর্যটি সরিয়ে ফেলার আশ্বাস দিয়েছিলেন। বৈঠকে তিনি ভাস্কর্যটির বিষয়ে নিজের অপছন্দের কথা জানান এবং ইসলামি দলগুলোর আরও কিছু দাবি মেনে নেন।

কিন্তু অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম গত সোমবার বেনারকে বলেন, ভাস্কর্যটি সরানোর সিদ্ধান্ত প্রধান বিচারপতি নিয়েছেন। তিনি বলেন, “সরকারের এখানে কিছুই করার নেই।”

সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের রেজিস্ট্রার সাব্বির ফয়েজও ভাস্কর্যটি সরানোর সিদ্ধান্ত প্রধান বিচারপতির বলে স্বীকার করেন।

অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, প্রধান বিচারপতি জ্যেষ্ঠ আইনজীবীদের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছেন। ভাস্কর্যটি নিয়ে কোনো ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা তিনি এড়াতে চেয়েছেন।

“যেহেতু ভাস্কর্যটি জাতীয় ঈদগাহর পার্শ্ববর্তী জায়গায় তাই এটি সরিয়ে নেওয়াই বিচক্ষণতা হবে বলে আমরাও মতামত দিয়েছিলাম।”

তবে সুপ্রিম কোর্টের সামনে থেকে ভাস্কর্যটি সরিয়ে ফেলায় ইসলামি দলগুলো গত শুক্রবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানিয়ে মিছিল করেছিল।

ধর্মনিরপেক্ষরা বিষয়টিকে আতঙ্কিত হওয়ার মতো ঘটনা বলে মনে করছেন। এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বেনারকে বলেন, “আমরা আতঙ্কিত হওয়ার মতো কিছু ঘটনা প্রত্যক্ষ করছি। ইসলামী মৌলবাদীদের উত্থান এবং তাদের চাপের কাছে আওয়ামী লীগ সরকারের মাথা নত করা খারাপ সংকেত দেয়।”

অন্যদিকে, দাবি অনুযায়ী ভাস্কর্যটি না ভেঙ্গে পুনঃস্থাপন করে ধর্মীয় অনুভূতি নিয়ে উপহাস করা হচ্ছে বলে এখন সরকারকে দোষারোপ করছে ধর্মীয় সংগঠনগুলো।

এ প্রসঙ্গে হেফাজতের আমির শাহ আহমদ শফি গত রোববার এক বিবৃতিতে বলেছেন, “ভাস্কর্যটি পুনঃস্থাপন করা জাতির ধর্মীয় বিশ্বাস ও অনুভূতিকে নিয়ে খেলা ছাড়া আর কিছু নয়।”

কওমি মাদ্রাসা কেন্দ্রিক সংগঠনটির প্রধান আরও বলেন, “গ্রিক দেবতার ভাস্কর্যটি সরাতে হবে। মুসলিম প্রধান বাংলাদেশে এর স্থান নেই।”

ভাস্কর্য স্থাপন ও পুনঃস্থাপন

ন্যায়বিচারের প্রতীক গ্রিক দেবী থেমিসের আদলে নির্মিত ভাস্কর্যটি গত ডিসেম্বরে সুপ্রিম কোর্টের সামনের প্রাঙ্গণে স্থাপন করা হয়েছিল। চোখ বাঁধা, শাড়ি পরিহিত ভাস্কর্যটির বাম হাতে একটি দাড়িপাল্লা এবং ডান হাতে একটি তলোয়ার রয়েছে।

ধর্মীয় সংগঠনগুলোর দাবির মুখে শুক্রবার ভোর রাতে ভাস্কর্যটিকে সুপ্রিম কোর্টের প্রবেশপথের সামনে থেকে নামানো হয়। ভাস্কর্যটি নামানোর খবর ছড়িয়ে পড়লে প্রায় একশ লোক মধ্যরাতেই সুপ্রিম কোর্টের সামনে অবস্থান নেন। তারা সেখানে রাতভর বিক্ষোভ করেন।

সরকারে ওপর চরমপন্থী গোষ্ঠীর ক্রমবর্ধমান প্রভাবের কারণে ভাস্কর্য অপসারণের ঘটনায় বাংলাদেশ জুড়ে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের মন্তব্যগুলোতে ছিল ব্যাপক সমালোচনা।

ভাস্কর্য নামানোর প্রতিবাদে গত শুক্রবার বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন, সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী এবং বামপন্থিরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল করেন। পুলিশ বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে টিয়ার গ্যাসের শেল এবং জলকামান থেকে পানি নিক্ষেপ করে।

বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক লিটন নন্দীসহ চারজন বিক্ষোভকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়। জামিনে মুক্তি পাওয়ার পর গত সোমবার লিটন নন্দী ভাস্কর্য পুনঃস্থাপনের ঘটনাকে বেনারের কাছে ধর্মনিরপেক্ষ প্রতিবাদকারীদের ‘ন্যূনতম বিজয়’ হিসেবে উল্লেখ করেন।

তবে জঙ্গিবাদের উত্থান এবং মৌলবাদীদের সাথে সরকারি জোটের সম্পর্ককে তিনি ‘জাতির ভবিষ্যতের জন্য মারাত্মক হুমকি’ বলে মন্তব্য করেন।

ভাস্কর্যটি প্রায় দেড় দিন সুপ্রিম কোর্টের বর্ধিত (অ্যানেক্স) ভবনের পেছনে একটি পানির পাম্পের সামনে রাখা হয়। এরপর গত শনিবার রাতে সেটি বর্ধিত ভবনের সামনে পুনরায় স্থাপন করা হয়। নতুন জায়গাটি আগের জায়গা থেকে কয়েকশ মিটার দূরে একটু ভেতরের দিকে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।