স্কুল-কলেজ জাতীয়করণের দাবিতে আমরণ অনশনের ঘোষণা

পুলক ঘটক ও জেসমিন পাপড়ি
2018.01.11
ঢাকা
নিবন্ধন পাওয়া সব স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসার শিক্ষকরা জাতীয়করণের দাবিতে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে আমরণ অনশন কর্মসুচি চালিয়ে যাচ্ছেন। নিবন্ধন পাওয়া সব স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসার শিক্ষকরা জাতীয়করণের দাবিতে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে আমরণ অনশন কর্মসুচি চালিয়ে যাচ্ছেন। ৯ জানুয়ারি ২০১৮।
মনিরুল আলম/বেনারনিউজ

স্বীকৃতিপ্রাপ্ত নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের আন্দোলন থেকে ফেরানো গেলেও এবার জাতীয়করণের দাবিতে আন্দোলনে নেমেছেন এমপিওভুক্ত (বেতনের সরকারি অংশ পাওয়া) বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, কলেজ ও মাদ্রাসার শিক্ষকেরা।

বেসরকারি শিক্ষা জাতীয়করণ লিয়াজো ফোরামের আহ্বানে বৃহস্পতিবার দ্বিতীয় দিনের মতো লাগাতার অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছেন তাঁরা। শনিবারের মধ্যে দাবি না মানা হলে পরদিন থেকে আমরণ অনশনে যাওয়ার ঘোষণাও দিয়েছেন সংগঠনটির নেতারা।

এদিকে মাদ্রাসা বোর্ডের রেজিস্ট্রেশন পাওয়া সব স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসা জাতীয়করণের দাবিতে ওই সব মাদ্রাসার শিক্ষকদের আমরণ কর্মসূচিও চলছে প্রেস ক্লাবের সামনে। টানা আট দিন অবস্থান কর্মসূচিতেও দাবি পূরণ না হওয়ায় ৯ জানুয়ারি থেকে আমরণ অনশনের ঘোষণা দেন তাঁরা। তিন দিনের অনশনে এ পর্যন্ত ৭৪ জন শিক্ষক অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।

বছরের শুরুতে বিনা মূল্যের বই হাতে পেয়ে শিক্ষার্থীরা যখন পূর্ণ উদ্যমে স্কুলে যাওয়া শুরু করেছে, ঠিক সেসময় শিক্ষকদের এ আন্দোলনে শিক্ষা কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

একের পর এক শিক্ষকদের আন্দোলনে সরকারও কিছুটা অস্বস্তিতে। তবে সরকারের গত মেয়াদে গৃহীত জাতীয় শিক্ষানীতি অনুযায়ী সকল শিক্ষকের জন্য পৃথক বেতন কাঠামো না করা আর কোনো নিয়মনীতি ছাড়াই পরিস্থিতি সামলানোর ফলে এ ধরনের বিশৃঙ্খল অবস্থা তৈরি হয়েছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী বেনারকে বলেন, “শিক্ষানীতিতে শিক্ষকদের পৃথক বেতনকাঠামো করাসহ অন্যান্য বিষয়ে স্পষ্ট কিছু নির্দেশনা থাকলেও গত ৭ বছরেও সেগুলো বাস্তবায়ন করা হয়নি। তারই ফল একের পর এক শিক্ষক আন্দোলন।”

শিক্ষকেরা যে দাবি নিয়ে আন্দোলন করছেন, সেটা ন্যায্য বলে মনে করেন শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের এই অধ্যাপক বেনারকে বলেন, “শিক্ষা খাত নিয়ে গতানুগতিক চিন্তা থেকে আমরা বের হতে পারিনি। শিক্ষকেরা মোটামুটি হতদরিদ্র হবেন, এমন চিন্তা সমাজ এখনও ধারণ করে। এ কারণেই সমস্যা।”

তবে সরকার শিক্ষকদের দাবিগুলো গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছে বলে জানিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ।

তিনি বেনারকে বলেন, “শিক্ষকদের অনেক দাবি পূরণ করা হয়েছে। সবগুলো দাবি পূরণ করতে হলে প্রচুর অর্থ দরকার। বিশেষ করে জাতীয়করণের দাবি বাস্তবায়ন করা কঠিন।”

“তবু এমপিওভুক্তির জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ ও সংস্থান সামর্থ্য পর্যালোচনার জন্য অর্থ প্রতিমন্ত্রী এম এ মান্নানের নেতৃত্বে কমিটি হয়েছে। কমিটির প্রতিবেদনের ভিত্তিতে পদক্ষেপ নেওয়া হবে,” বলেন শিক্ষামন্ত্রী।

জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে আমরণ অনশনরত বাংলাদেশ স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসা শিক্ষকরা। ১১ জানুয়ারি ২০১৭।
জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে আমরণ অনশনরত বাংলাদেশ স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসা শিক্ষকরা। ১১ জানুয়ারি ২০১৭।
নিউজরুম ফটো

 

আমরণ অনশনে যাওয়ার হুমকি

শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয়করণ হলে শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধি পাবে। ছাত্রছাত্রীদের বেতন দিয়ে পড়তে হবে না। ফলে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মাঝে মানসম্মত শিক্ষা ছড়িয়ে দেওয়া সহজ হবে। আর এ কারণেই এই আন্দোলন,” বেনারকে বলছিলেন লিয়াজো ফোরামের নেতা সাইদুল ইসলাম।

প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে দাবি পূরণের ঘোষণা না আসা পর্যন্ত তাঁরা এ কর্মসূচি চালিয়ে যাবেন বলেও জানান এই শিক্ষক নেতা।

“আগামী ১৩ জানুয়ারি পর্যন্ত এ কর্মসূচি চলবে। এ সময়ের মধ্যে দাবি না মানা হলে পরদিন থেকে আমরা আমরণ অনশনে যাব,” বেনারকে বলেন লিয়াজো ফোরামের উপদেষ্টা ও বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির একাংশের সভাপতি নজরুল ইসলাম রনি।

আমরণ অনশনেও আশ্বাস পাননি মাদ্রাসা শিক্ষকেরা

জাতীয় প্রেসক্লাবের মূল ফটকের পশ্চিম পাশে ফুটপাত ও সামনের সড়কের একটি অংশে আমরণ অনশন কর্মসূচি পালন করছেন স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসার শিক্ষকেরা। নারী, পুরুষ সবাই মিলে তীব্র শীতের রাতেও খোলা আকাশের নিচে অবস্থান করছেন তাঁরা। অসুস্থ কয়েকজন শিক্ষককে ফুটপাতেই স্যালাইন দিয়ে রাখা হয়েছে।

“আট দিন অবস্থান কর্মসূচির পরে অনশনের তিন দিন পেরিয়ে গেছে। আজও অর্ধশতাধিক শিক্ষক অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তবুও সরকারের পক্ষ থেকে আমাদের দাবি পূরণের বিষয়ে কোনো আশ্বাস পাইনি। তবে আমরা অনশন চালিয়ে যাব,” বেনারকে বলেন স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসা শিক্ষক সমিতির মহাসচিব কাজী মোখলেছুর রহমান।

এ সমিতির সভাপতি আলহাজ রুহুল আমিন চৌধুরী বৃহস্পতিবার বেনারকে বলেন, “প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে সুনির্দিষ্ট আশ্বাস ছাড়া আমাদের আন্দোলন অব্যাহত থাকবে। প্রয়োজনে আমরা প্রাণ দেবো তবু আন্দোলন থামবে না।”

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব এবং প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সচিবকে বুধবার স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসা-সংক্রান্ত তথ্য দেওয়া হয়েছে বলে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে। সেখানে ৩ হাজার ৪৩৩টি স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসায় ১৫ হাজার ২৪৩ জন শিক্ষক রয়েছেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

তবে মাদ্রাসা বোর্ড থেকে নিবন্ধিত স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসা ১৮ হাজার ১৯৪টি হলেও ১০ হাজারের মতো চালু রয়েছে বলে জানিয়েছেন আন্দোলনকারী শিক্ষকেরা।

এর আগে ধারাবাহিক অবস্থান কর্মসূচি এবং টানা ছয় দিন আমরণ অনশনের পর গত ৫ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর শেখ হাসিনার আশ্বাসের প্রেক্ষিতে আন্দোলন প্রত্যাহার করেন নন-এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীরা।

আন্দোলনে নামছে নতুন জোট

ভিন্ন ভিন্ন শিক্ষক গোষ্ঠীর আন্দোলনের মাঝে শিক্ষা জাতীয়করণসহ কয়েকটি দাবিতে নতুন জোট গঠন করেছে ১৬টি শিক্ষক-কর্মচারী সংগঠন। বেশ কিছু কর্মসূচিও ঘোষণা করেছে ‘স্বাধীনতা শিক্ষক কর্মচারী ফেডারেশন’ নামে গঠিত নতুন জোট।

বৃহস্পতিবার জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে এই কর্মসূচি ঘোষণা করেন নতুন জোটের প্রধান সমন্বয়কারী মো. শাহজাহান আলম।

ঘোষিত কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে ১৪ থেকে ১৮ জানুয়ারি সারা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গণসংযোগ, ২১ জানুয়ারি উপজেলায় মানববন্ধন ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি প্রদান, ২৫ জানুয়ারি জেলায় মানববন্ধন ও জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপি এবং ২৭ জানুয়ারি ঢাকায় গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন।

এরপর আগামী ৩ মার্চ ঢাকায় প্রতিনিধি সভা ডেকে পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করবে নতুন এই ফেডারেশন।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।