পরিবহন ধর্মঘটে থমকে গেছে বাংলাদেশ, আম–জনতার অবর্ণনীয় দুর্ভোগ
2017.02.28

কিডনি চিকিৎসার জন্য বৃদ্ধা মাকে নিয়ে রংপুর থেকে ঢাকায় এসেছিলেন বিপুল বিশ্বাস। ফেরার পথে বিপত্তি বেঁধেছে। সকালে গাবতলী বাসস্ট্যান্ডে এসে দেখেন গাড়ি নেই; ধর্মঘট।
মাকে নিয়ে কোথায় যাবেন, কোথায় থাকবেন—এ নিয়ে দিশেহারা বিপুল বেনারকে বললেন, “আটকা পড়ছি। কয়দিন যে থাকা লাগে।”
আকস্মিক ধর্মঘটের কারণে বাস চলাচল বন্ধ থাকায় চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন বিপুল বিশ্বাসের মতো অসংখ্য মানুষ। যাঁরা আগাম টিকিট করে রেখেছিলেন তারাও গন্তব্যে যেতে পারেননি। টার্মিনালে এসে গাড়ি না পেয়ে ভোগান্তিতে পড়েছেন যাত্রীরা।
আইনজ্ঞরা বলছেন, এভাবে যাত্রীদের জিম্মি করে আদালতের রায় বদলানোর কৌশল নিয়েছে পরিবহন মালিক-শ্রমিক সংগঠনগুলো।
বিভিন্ন বেসরকারি টেলিভিশনের সরাসরি সম্প্রচারে দেখা যায়, বাস থেকে যাত্রীদের নামিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ধর্মঘটের সমর্থনে দেশের বিভিন্ন বাস স্ট্যান্ড ও গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে অবস্থান নিয়ে পিকেটিং করছেন শ্রমিকরা।
আদালতের রায়ের প্রতিবাদে ধর্মঘট
সড়ক দুর্ঘটনায় চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদ ও এটিএন নিউজের প্রধান নির্বাহী মিশুক মুনীরসহ পাঁচজন নিহত হওয়ার ঘটনায় গত ২২ ফেব্রুয়ারি চালক জমির উদ্দিনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। এরপর গত রবিবার সকাল থেকে ধর্মঘটে যায় দক্ষিণাঞ্চলীয় খুলনা বিভাগের ১০ জেলার শ্রমিকেরা।
অনির্দিষ্টকালের এই ধর্মঘট প্রত্যাহারের জন্য প্রশাসনের সঙ্গে সমঝোতাও হয়েছিল শ্রমিক সংগঠনগুলোর। এর মধ্যেই ট্রাক চাপা দিয়ে এক নারীকে হত্যার দায়ে সোমবার আরও একজন ট্রাক চালকের মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণা করে আদালত। পরদিন মঙ্গলবার থেকে সারা দেশে ধর্মঘট শুরু করে পরিবহন মালিক-শ্রমিকেরা।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ মঙ্গলবার বেনারকে বলেছেন, “গত রাতে আমরা আলোচনায় বসে সমস্যার প্রায় সমাধান করে ফেলেছিলাম। এ সময় শোনা গেল দুর্ঘটনার মামলায় ঢাকা জজ কোর্টে এক ট্রাক চালকের ফাঁসির রায় হয়েছে। ফলে বিক্ষুব্ধ শ্রমিকেরা অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘট শুরু করেছে।”
পরিবহন সংকট চরমে
ধর্মঘটে সব ধরনের যাত্রী ও পণ্যবাহী যান চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রতিবাদে বাম দলগুলোর হরতালের কারণে গতকাল সকাল থেকেই রাজধানীতে পরিবহন সংকট ছিল। বিকেলে পরিবহন শ্রমিকদের বাধার কারণে সরকারি উদ্যোগে পরিচালিত বিআরটিসির বাস ছাড়া আর কোনো যানবাহন চলেনি।
ফলে মারাত্মক দুর্ভোগে পড়ে মানুষ। গাবতলী, সায়েদাবাদ ও মহাখালী টার্মিনাল থেকে দূরপাল্লার বাস ছাড়েনি। মাইক্রোবাস চলাচলেও বাধা দিয়েছে শ্রমিকেরা।
চালকের মৃত্যুদণ্ড যে কারণে
সাভারে ইচ্ছাকৃতভাবে ট্রাকচাপা দিয়ে খোদেজা বেগম নামক এক নারীকে হত্যা করায় চালক মীর হোসেনের ফাঁসির আদেশ হয়েছে বলে বেনারকে জানিয়েছেন আদালতে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী গোলাম দস্তগীর।
মামলার বিবরণ অনুযায়ী ২০০৩ সালের ২০ জুন খোদেজার বাড়ির সামনের পারিবারিক রাস্তা দিয়ে ট্রাকে করে মাটি নিয়ে যাচ্ছিলেন প্রতিবেশী ট্রাকচালক মীর হোসেন।
খোদেজা ও তার স্বামী নুরু তাঁদের পারিবারিক রাস্তা দিয়ে মাটির ট্রাক চলাচলে বাধা দেন। এ নিয়ে চালকের সঙ্গে তাদের বাদানুবাদ চলে। একপর্যায়ে তারা ট্রাকের সামনে এসে দাঁড়ান। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে ট্রাকচালক মীর হোসেন তাঁদের ওপর দিয়ে ট্রাক চালিয়ে দেন। নুরু সরে যেতে সক্ষম হলেও খোদেজা ট্রাকের নিচে চাপা পড়ে ঘটনাস্থলেই নিহত হন।
দীর্ঘ শুনানির পর ঢাকার অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ প্রদীপ কুমার রায় ইচ্ছাকৃত হত্যার দায়ে চালকের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেন।
দুর্ঘটনার জন্য যাবজ্জীবন ও ধর্মঘট কেন?
আইনজীবীরা জানিয়েছেন, দুর্ঘটনার জন্য বাসচালককে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়ার রায়টি দেশের বিচারিক ইতিহাসে সর্বোচ্চ সাজা। ২০১১ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীরসহ পাঁচজন নিহত হওয়ার ঘটনায় মানিকগঞ্জের আদালত এই রায় দেয়।
আসামিপক্ষ এ ঘটনাকে সড়ক দুর্ঘটনা হিসেবে ব্যাখ্যা করলেও আদালতের পরিভাষায় একে বলা হচ্ছে ‘দণ্ডনীয় নরহত্যা, কিন্তু খুন নয়।’
রায়টি পর্যালোচনা করে বিশিষ্ট আইন বিশ্লেষক ও কলামিস্ট মিজানুর রহমান খান বেনারকে বলেছেন, “দণ্ডবিধির যে বিধির আওতায় খুনখারাবির বিচার হয়, সেই ধারাটিই এখানে প্রয়োগ হয়েছে। আদালতে বাদীপক্ষ প্রমাণ করেছে যে, চালক তাঁর বাসটিকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছেন।”
তিনি বলেন, “মানুষ খুন করা চালকের উদ্দেশ্য ছিল না। উদ্দেশ্য ছিল দায় দায়িত্বহীনভাবে ছুটে যাওয়ার। এর ফলে সামনে মানুষ পড়ুক বা অন্য কোনো জীবজন্তু পড়ুক, কিছুতেই তাঁর কিছু যায়-আসে না, মানুষ পড়লে মরবে, কেউ আহত হলে হবে।”
বিশিষ্ট আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মী শাহদীন মালিক বেনারকে বলেছেন, “রায়টা আইনের বিধান অনুযায়ী হয়েছে। আদালত দৃষ্টান্তমূলক সাজা দিয়েছে, যাতে ভবিষ্যতে অন্যরা সতর্ক হয়।”
তিনি বলেন “আইন ও বিচারের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ না থাকায় চালক ও পরিবহন মালিকেরা ধর্মঘটে গেছে। তাদের ধারণা বিচারকে প্রভাবিত করা যায় এবং রাজনৈতিক বিবেচনায় রায় পাওয়া যায়।”
তবে আইনজীবীরা বলছেন, সাভারের যে ঘটনায় চালকের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ হয়েছে সেটি সড়ক দুর্ঘটনা ছিল না।
“দুর্ঘটনা নয়, এটা ছিল নিছক হত্যাকাণ্ড,” স্থানীয় সাংবাদিকদের বলেছেন পাবলিক প্রসিকিউটর গোলাম দস্তগীর ।
দুর্ঘটনায় নিত্যদিনের প্রাণহানি
প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও দুর্ঘটনা ঘটছে। গত সোমবার দেশের বিভিন্ন স্থানে দুর্ঘটনায় তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। রাজশাহীর পুঠিয়া উপজেলায় একজন, নাটোরের বড়াইগ্রামে একজন এবং বরিশাল শহরে একজন মারা গেছে।
এর আগে গত সোমবার মারা গেছে নয়জন। গত সোমবার বাংলা দৈনিক প্রথম আলো ১৭ দিনে ১৮১ জন মারা যাওয়ার তথ্য প্রকাশ করেছে।
বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্যমতে, গত বছর গড়ে প্রতিদিন ১১ জন সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে। যানবাহনের বেপরোয়া গতি, গাড়ির ফিটনেস না থাকা ও চলাচল তদারকির অভাবই দুর্ঘটনার প্রধান কারণ হিসেবে বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদনে চিহ্নিত হয়েছে।