কাজে ফিরলেন ইন্টার্ন চিকিৎসকেরা

প্রাপ্তি রহমান
2017.03.06
ঢাকা
দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে কর্মবিরতি পালন করেন ইন্টার্ন চিকিৎসকেরা। দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে কর্মবিরতি পালন করেন ইন্টার্ন চিকিৎসকেরা।
ফোকাস বাংলা

প্রায় ৭২ ঘণ্টার কর্মবিরতি শেষে কাজে ফিরেছেন দেশের শিক্ষানবিশ চিকিৎসকেরা। গতকাল সোমবার সকালে এক বৈঠক শেষে মন্ত্রণালয় থেকে এ খবর নিশ্চিত করা হয়।

তবে এ জন্য হাসপাতালে রোগীর স্বজনকে মারধরের ঘটনায় চার শিক্ষানবিশ চিকিৎসকের বিরুদ্ধে নেওয়া শাস্তিমূলক ব্যবস্থা সরকারকে প্রত্যাহার করতে হয়েছে।

বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজের চার ইন্টার্ন চিকিৎসকের শাস্তি মওকুফ ও চিকিৎসকদের জন্য নিরাপদ কর্মপরিবেশের দাবিতে গত ৪ মার্চ থেকে দেশের সরকারি হাসপাতালগুলোয় ধর্মঘট পালন করছিলেন ইন্টার্ন চিকিৎসকেরা।

গত ১৯ ফেব্রুয়ারি বগুড়া শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজে এক রোগীর স্বজনকে নির্যাতনের অভিযোগ ওঠে শিক্ষানবিশ চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে। ওই ঘটনা তদন্তে মন্ত্রণালয়ের গঠিত তিন সদস্যের কমিটি অভিযুক্ত চিকিৎসকদের ইন্টার্নশিপ ছয় মাসের জন্য স্থগিত করার সুপারিশ করে। ২ মার্চ এ খবর প্রকাশ হওয়ার পর আন্দোলনে নামেন ইন্টার্ন চিকিৎসকেরা।

সূত্রগুলো বলছে, গতকাল সকালে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের ধানমন্ডির বাসায় এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ, সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ইন্টার্ন চিকিৎসক পরিষদের নেতারা উপস্থিত ছিলেন।

বৈঠক শেষে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম সাংবাদিকদের বলেন, “চিকিৎসকেরা কাজে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তাঁদের স্বাগত জানাই।”

তিনি বলেন, “রোগীদের ভোগান্তিতে ইন্টার্ন চিকিৎসকেরা দুঃখ প্রকাশ করেছেন। আরও আগেই দুঃখ প্রকাশ করা উচিত ছিল।”

বৈঠকে অংশ নেওয়া স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের সভাপতি এম ইকবাল আর্সলান বলেন, “স্বাস্থ্যমন্ত্রী চার ইন্টার্ন চিকিৎসকের ইন্টার্নশিপ ছয় মাস স্থগিত করার যে ঘোষণা দিয়েছিলেন তা প্রত্যাহার করে নিয়েছেন।”

“ইন্টার্ন চিকিৎসকেরাও ভবিষ্যতে হাসপাতালে যাতে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে, সে বিষয়ে সচেষ্ট থাকার প্রতিশ্রুতি দেন। এরপরই স্বাস্থ্যমন্ত্রী ইন্টার্নদের দাবি মেনে নেন,” বলেন এই চিকিৎসক নেতা।

চিকিৎসকদের সনদ প্রদানকারী সংস্থা বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি) এর নিবন্ধক জেড এইচ বসুনিয়া বেনারকে বলেন, “এমবিবিএসের পর কমপক্ষে ছয় মাস ইন্টার্নশিপ করলে একজন ব্যক্তি চিকিৎসক হিসেবে নিবন্ধন পান।”

যেভাবে ঘটনার সূত্রপাত

গত ১৯ ফেব্রুয়ারি বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণজনিত কারণে ভর্তি হয়েছিলেন আলাউদ্দীন নামে এক রোগী। রাত সাড়ে ৩টার দিকে ফ্যানের সুইচ বন্ধ করা নিয়ে ওয়ার্ডে কর্মরত এক নারী চিকিৎসকের সঙ্গে বাগ বিতণ্ডায় জড়ান রোগীর ছেলে আবদুর রউফ সরকার।

একপর্যায়ে তিনি ওই নারী চিকিৎসকের সঙ্গে অশালীন আচরণ করেন বলে অভিযোগ ওঠে। এতে হাসপাতালে উপস্থিত অন্য ইন্টার্ন চিকিৎসকেরা আবদুর রউফকে প্রথমে কান ধরে ওঠবস করান ও পরে মারধর করেন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ঘটনার দুদিন পর গত ২১ ফেব্রুয়ারি নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ওই রোগী মারা গেলেও স্বজনেরা ভয়ে তাঁর লাশ নিতে যাননি।

২২ ফেব্রুয়ারি শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজর পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাসুদ আহসান প্রেস বিজ্ঞপ্তি দিয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার জন্য হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও চিকিৎসকদের পক্ষ থেকে দুঃখ প্রকাশ করেন।

তবে তদন্ত কমিটি নূরজাহান বিনতে ইসলাম নাজ, মো আশিকুজ্জামান আসিফ, মো. কুতুবউদ্দীন ও এম এ আল মামুনের ইন্টার্নশিপ ছয় মাসের জন্য স্থগিত করেন। তাঁরা ওই চারজনকে আলাদা আলাদা মেডিকেল কলেজে ইন্টার্নশিপ করতে পাঠানোর সুপারিশ করেন।

অভিযুক্ত চিকিৎসক মো. কুতুবউদ্দীন বেনারকে বলেন, “তদন্ত কমিটি অন্যায়ভাবে তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছিল। নারী চিকিৎসককে অশালীন কথা বলার ঘটনায় কোনো বিচার হয়নি।”

রোগীদের দুর্ভোগ

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেবে, ছয়শ’ মানুষের জন্য একজন চিকিৎসক থাকার কথা। বাংলাদেশে দুই হাজার ৩৯ জনের বিপরীতে আছেন একজন চিকিৎসক। তাই হাসপাতালের সেবা অনেকটাই নির্ভর করে ইন্টার্ন চিকিৎসকদের ওপর।

ধর্মঘট ডেকে ইন্টার্ন চিকিৎসকেরা দেশের কমপক্ষে ১০টি হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা বন্ধ করে দেন। এ সময় দুর্ভোগে পড়েন হাসপাতালগুলোর রোগীরা।

রোগীদের দুর্দশার কথা জানিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজের সার্জারি বিভাগের একজন নবীন চিকিৎসক আশিকুর রহমান বেনারকে বলেন, “ঢাকা মেডিকেল কলেজে সব সময় ধারণক্ষমতার তিনগুণ রোগী থাকেন। অস্ত্রোপচারও চলে ২৪ ঘণ্টা। আজ (সোমবার) সকাল থেকে ইন্টার্নদের পাশাপাশি নবীন চিকিৎসকেরাও কাজে হাত লাগাননি। সিরিয়ালে থাকা অর্ধেক রোগীর অস্ত্রোপচার হয়নি।”

বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজে চিকিৎসাধীন নওগাঁর নূর আলম বেনারকে বলেন, “শুক্র ও শনিবার কোনো চিকিৎসকই আমাকে দেখেননি। রবি ও সোমবার একবার একজন চিকিৎসক এসেছেন।”

রোগীদের জিম্মি করে ধর্মঘট পালন কতটা যুক্তিযুক্ত জানতে চাইলে চিকিৎসকদের সংগঠন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) এর মহাসচিব ইহতেশামুল হক চৌধুরী বেনারকে বলেন, “নবীন চিকিৎসকেরা মনে করছেন তাঁরা সুবিচার পাচ্ছেন না।”

“রোগীদের অভিযোগ চিকিৎসকেরা তাঁদের যথেষ্ট সময় দেন না। তদবির ছাড়া সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা পাওয়া যায় না। তবে সত্যিকার অর্থে ফাঁকিবাজ চিকিৎসকের সংখ্যা কম। বহু রোগী তদবির ছাড়াই ভর্তি হন ও চিকিৎসা পান। ঢালাও অভিযোগ চিকিৎসকেরা আর নিতে পারছেন না,” বলেন ইহতেশামুল।

ডাক্তার-রোগী সম্পর্ক তলানিতে ঠেকেছে

এমন পরিস্থিতিতে দেশে ডাক্তার-রোগী সম্পর্ক তলানিতে ঠেকেছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। এ পরিস্থিতি থেকে বের হতে দুপক্ষকেই দায়িত্বশীল আচরণের পরামর্শ দিয়েছেন তাঁরা।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের ডিন এ বি এম আবদুল্লাহ বেনারকে বলেন, “সরকারি হাসপাতালে প্রচুর রোগী, চিকিৎসকেরা হিমশিম খান। রোগীরা মনে করেন তাঁরা যথেষ্ট মনোযোগ পাচ্ছেন না। কোথাও কোথাও চিকিৎসকের গাফিলতি থাকে, এটা সত্য। তবে দু’পক্ষেরই সহনশীল আচরণ করা দরকার।”

এই ধরনের বিশৃঙ্খলা আবারও দেখা দেওয়ার আশঙ্কা জানিয়ে তিনি বলেন, “আস্থার সম্পর্কে ফাটল ধরেছে। সম্পর্কের উন্নতি না হলে পরিস্থিতির অবনতিও হতে পারে।”

এর আগে ২০১৪ সালে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মো. নাসিম স্বাস্থ্য সুরক্ষা আইন করার উদ্যোগ নিলেও এখন পর্যন্ত চিকিৎসকদের বাধায় আইনটি চূড়ান্ত হয়নি। ওই আইনে রোগী ও চিকিৎসক—দুপক্ষেরই সুরক্ষা নিশ্চিত করার কথা জানিয়েছে সরকার।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।