কোটা সংস্কার আন্দোলন: পুলিশের হামলার মুখে শিক্ষার্থীরা
2024.07.11
ঢাকা

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের চলমান আন্দোলনের একাদশ দিনের মাথায় পুলিশের হামলায় দেশের কয়েকটি স্থানে কমপক্ষে ৩০ জন আন্দোলনকারী আহত হয়েছেন।
এদিকে বৃহস্পতিবার (১১ জুলাই) ২০১৮ সালে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলে পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করে দেয়া রায়ের কিছু অংশ প্রকাশ করেছে হাইকোর্ট।
রায়ে বলা হয়েছে, সরকার চাইলে কোটা পরিবর্তন বা পরিবর্ধন করতে পারবে এবং কোন কোটায় চাকরি প্রার্থী না পাওয়া গেলে সেই ফাঁকা পদে সাধারণ মেধা তালিকার প্রার্থীকে দিয়ে পূরণ করা যাবে।
রায় প্রকাশের কথা নিশ্চিত করে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল শেখ সাইফুজ্জামান (জামান) বেনারকে বলেন, “আদালত রায়ের যে সংক্ষিপ্ত অংশ প্রকাশ করেছে, তাতে বলা হয়েছে সরকার চাইলে সরকারি চাকরিতে কোটার হার পরিবর্তন বা বাড়াতে-কমাতে পারে বলে রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট।”
আন্দোলনে পুলিশ ও ছাত্রলীগের হামলা
বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে বৃহস্পতিবার বিকেল থেকে পূর্বঘোষিত ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচি পালন করতে নেমে কুমিল্লা ও চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্নস্থানে পুলিশ ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের হামলা ও বাধার মুখে পড়েছে আন্দোলনকারীরা।
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবি নিয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ করতে যাওয়ার পথে পুলিশের বাধার সম্মুখীন হয়েছেন কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এ সময় পুলিশের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের পাল্টাপাল্টি ধাওয়া ও সংঘর্ষের ঘটনায় শিক্ষার্থী, সাংবাদিক ও পুলিশসহ অন্তত ২০ জন আহত হন।
উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়লে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ কয়েক রাউন্ড ফাঁকা গুলি ও কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করে বলে বেনারকে জানিয়েছেন কুমিল্লার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) খন্দকার আশফাকুজ্জামান।
এদিকে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী ও আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক মোহাম্মদ সাকিব হোসাইন সাংবাদিকদের বলেন, “আমরা চেয়েছি শান্তিপূর্ণ অবস্থান। পুলিশ আমাদের ওপর পরিকল্পিতভাবে হামলা করেছে।”
পরে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশের হামলার প্রতিবাদে রাজশাহীতে রেললাইন অবরোধ করেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা।

চট্টগ্রামে কোটা বাতিলের দাবিতে সড়ক অবরোধ করতে বের হয়ে পুলিশের লাঠিপেটার মুখে পড়েন শিক্ষার্থীরা।
এই ঘটনায় কমপক্ষে ১০জন শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন জানিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক মোহাম্মদ রাসেল আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, নগরীর টাইগারপাস মোড় থেকে শিক্ষার্থীরা মিছিল নিয়ে ষোলশহর ২ নম্বর গেট এলাকায় পৌঁছালে পুলিশ তাদের লাঠিপেটা করে।
এদিকে ঢাকায় কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলরত শিক্ষার্থীরা পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে রাজধানীর শাহবাগ মোড়ে অবস্থান নিয়ে কয়েক ঘণ্টা অবরোধ করে রাখেন। বিকেলে পুলিশের ব্যাপক প্রস্তুতি থাকলেও পরে বিপুলসংখ্যক উপস্থিতির মধ্যে তারা এলাকা ছেড়ে চলে যান।
অপরদিকে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের নেতা–কর্মীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রে রাজু ভাস্কর্যের সামনে কোটা সংস্কার নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি ও আদালতের রায় মেনে আহ্বান জানিয়ে বিশাল সমাবেশ করেন।
বরিশাল-কুয়াকাটা মহাসড়ক অবরোধ করেন বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
পুলিশ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে শিক্ষার্থীদের মহাসড়ক অবরোধ করে জনভোগান্তি সৃষ্টি না করার জন্য অনুরোধ করা হলেও কয়েকশ শিক্ষার্থী মিছিল নিয়ে ক্যাম্পাস থেকে বেরিয়ে কয়েক ঘণ্টার জন্য মহাসড়ক অবরোধ করে রাখেন।
শুরুতে পুলিশের বাধার মুখে পড়লেও পরে ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
সরকার ও ক্ষমতাসীনদের হুঁশিয়ারি
আন্দোলন শুরুর প্রথম ১০দিন কিছুটা নমনীয় থাকলেও বৃহস্পতিবার ১১দিনের মাথায় এসে কিছুটা কঠোর হওয়ার পাশাপাশি নানা হুঁশিয়ারি দিয়েছে ক্ষমতাসীন দল ও সরকার।
বৃহস্পতিবার ঢাকায় আওয়ামী লীগ সভাপতির কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে কোটা নিয়ে সরকারের অবস্থান তুলে ধরে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, “শিক্ষার্থীদের আবেগকে পুঁজি করে কোনো মহল যদি দেশে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চায় তাহলে সরকারকে অবশ্যই আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে।”
কোটা বিরোধী আন্দোলনকে বিএনপি সরকার বিরোধী আন্দোলনে রূপ দিতে চায় দাবি করে তনি বলেন, “তাদের সে খায়েশ পূরণ হতে দেবে না আওয়ামী লীগ।”
শিক্ষার্থীদের নিজ নিজ শিক্ষাঙ্গনে ফিরে যাওয়ার অনুরোধ করে সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, “অনেকে শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করতে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছে। পানি ঘোলা করার চেষ্টা করছে। শিক্ষার্থীরা ভুলপথে যাবেন না...শিক্ষার্থীরা লিমিট ক্রস করে যাচ্ছেন।”
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) ড. মহিদ উদ্দিন বলেছেন, বাংলা ব্লকেডের নামে যারা সড়ক অবরোধ করবে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সড়ক অবরোধের মাধ্যমে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করা বিদ্যমান আইনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ উল্লেখ করে তিনি বলেন, “গতকাল (বুধবার) সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ চার সপ্তাহের স্থিতাবস্থা দিয়ে ২০১৮ সালের সার্কুলার বহাল রেখেছেন। ফলে সার্কুলারটি এই সময় পর্যন্ত কার্যকর থাকবে। তাই বিক্ষোভের মাধ্যমে জনদুর্ভোগ সৃষ্টির কোনো যৌক্তিকতা নেই।”
হামলার প্রতিবাদে নতুন কর্মসূচি
টানা চারদিন ’বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচি পালন শেষে বৃহস্পতিবার রাতে রাজধানীর শাহবাগ মোড়ে কোটা সংস্কার বৃহস্পতিবার আন্দোলনকারীদের ওপর বিভিন্ন স্থানে হামলার প্রতিবাদে শুক্রবার (১২ জুলাই) সারা দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিক্ষোভ সমাবেশ ও মিছিলের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।
আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়কারী নাহিদ ইসলাম সংবাদ সম্মেলনে এই ঘোষণা দিয়ে বলেন, “সারা দেশে যেসব জায়গায় আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা চালানো হয়েছে তার নিন্দা জানাই। আমরা শুরু থেকেই বলছি কোটা একটি সরকারি নীতির বিষয়।”
২০১৮ সালের পরিপত্রের ত্রুটি থাকার কারণে হাইকোর্ট তা অবৈধ ঘোষণা করেছে দাবি করে তিনি বলেন, “আমরা বলে আসছি হাইকোর্টের সঙ্গে আমাদের আন্দোলনের কোনও সম্পর্ক নেই। আমাদের দাবি সব গ্রেডে কোটার যৌক্তিক সংস্কার। সরকার আইন পাস করে এই দাবি পূরণ করতে পারে।”
বৃহস্পতিবার সরকারি চাকুরিতে কোটা বহাল রেখে বাড়ানো কমানোর বিষয়ে সরকারের দায়িত্ব বলে আদালতের দেয়া রায়কে স্বাগত জানিয়েছেন আন্দোলনকারীরা।