আবারও ডুবল কয়লাবাহী জাহাজ, হুমকিতে সুন্দরবন
2017.01.13

বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সুন্দরবনের কাছে এক হাজার টনেরও বেশি কয়লা নিয়ে একটি জাহাজ ডুবে গেছে । এই নিয়ে গত চার বছরে সুন্দরবন ও এর সংলগ্ন এলাকায় মোট চারটি দুর্ঘটনা ঘটল।
ওয়াকিবহাল সূত্রগুলো বলছে, জাহাজটি হিরণ পয়েন্ট থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে বঙ্গোপসাগরের মোহনায় ডুবেছে। জায়গাটির অবস্থান জুলফিকার চ্যানেলের পশ্চিমে। দুর্ঘটনায় প্রাণহানির কোনো ঘটনা ঘটেনি। তবে এর কারণে সুন্দরবনের কী ক্ষতি হয়েছে বা হতে পারে তা এখনই বলা যাচ্ছে না।
“শুক্রবার সকাল সোয়া ৯টার দিকে লাইটার জাহাজটি ডুবে যায় । এতে ১৪ জন ক্রু ছিলেন। তাঁদের একটি বাণিজ্যিক জাহাজে করে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে,” টেলিফোনে বেনারকে জানান মোংলা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবদুর রহমান বিশ্বাস।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ইন্দোনেশিয়া থেকে কয়লা নিয়ে জাহাজটি বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিয়ে আসে। সেখান থেকে পশুর নদী হয়ে জাহাজটি যশোরের নোয়াপাড়া যাওয়ার কথা ছিল। তার আগেই দুর্ঘটনাটি ঘটে।
ধারণা করা হচ্ছে, প্রচণ্ড ঢেউয়ের তোড়ে লাইটার জাহাজটি ডুবে গেছে। দুর্ঘটনার খবর পাওয়ার পরপরই কোস্টগার্ডের দুটি টহল দলকে ঘটনাস্থলে পাঠানোর কথা জানিয়েছেন কোস্ট গার্ডের (পশ্চিম) অপারেশনস অফিসার রাহাতুজ্জামান।
“বেলা সোয়া ১১টার দিকে দুটি টহল দল দুর্ঘটনাস্থলে পাঠানো হয়েছে। এগুলো ফিরে আসার পর পূর্ণাঙ্গ তথ্য দেওয়া সম্ভব হবে,” বেনারকে বলেন রাহাতুজ্জামান।
তবে এখন পর্যন্ত বন বিভাগের কোনো দল ঘটনাস্থলের উদ্দেশে রওনা হয়নি। এ বিষয়ে বিভাগীয় বন কর্মকর্তা সাইদুল ইসলামের সঙ্গে কথা হয়। উপযুক্ত জাহাজের অভাবে বন বিভাগ ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে পারেনি বলে দাবি করে তিনি আরও বলেন, দুর্ঘটনাটি সংরক্ষিত বনভূমির ২০ কিলোমিটার দূরে বলে তাঁরা এখনো খুব একটা চিন্তিত নন।
“যে জায়গায় দুর্ঘটনাটি ঘটেছে, সেটি মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের আওতাধীন এবং সুন্দরবন থেকে বেশ কিছুটা দূরে । বঙ্গোপসাগরের সঙ্গে পশুর নদীর সংযোগস্থল ওটি। ওখানে একই সঙ্গে সাতটি নদী বঙ্গোপসাগরে মিশেছে। আমরা আশা করছি সুন্দরবনের কোনো ক্ষতি হবে না,” বেনারকে বলেন সাইদুল।
গত তিন বছরে সুন্দরবন ও এর সংলগ্ন এলাকায় আরও তিনটি দুর্ঘটনা ঘটেছে। গত বছরের ১৯ মার্চ ও এর আগের বছর ২৮ অক্টোবর সুন্দরবনের ভেতরে শ্যালা ও পশুর নদীতে কয়লাবাহী দুটি লাইটার জাহাজ ডুবে যায়।
নদী ও পরিবেশ নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংস্থা ওয়াটার কিপার বাংলাদেশের সমন্বয়ক শরীফ জামিল বলছিলেন, সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে নৌযানের বাণিজ্যিক চলাচল কোনো শুভ ফল বয়ে আনছে না। কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে পুরোপুরি উদাসীন।
এর আগেও ২০১৪ সালে শ্যালা নদীতে তেলবাহী একটি জাহাজ ডুবে যায়। সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্যকে রক্ষা করতে শ্যালা নদীর ভেতর বাণিজ্যিক নৌযান চলাচল বন্ধের দাবিতে পরিবেশকর্মীরা সে বছর লম্বা সময় ধরে আন্দোলন করেন। এক পর্যায়ে সরকার পরিবেশবাদীদের দাবির মুখে সুন্দরবনের ভেতর শ্যালা নদীতে বাণিজ্যিক নৌচলাচল বন্ধ করতে বাধ্য হয়।
“শ্যালা নদীতে বাণিজ্যিক নৌযানের চলাচল বন্ধ হলেও পশুর নদীতে নৌ চলাচল করছে । নৌযানগুলো পোড়া তেল নদীতে ফেলছে, স্থানীয় লোকজন সংগ্রহ করে সেই তেল বিক্রি করছে। সবই ঘটছে প্রশাসনের চোখের সামনে,” বেনারকে বলেন শরীফ জামিল।
পরিবেশবাদীদের আশঙ্কা গতকাল যে দুর্ঘটনাটি ঘটেছে তাতে করে দীর্ঘ মেয়াদে সুন্দরবনের ক্ষতি হতে পারে। কয়লা পরিবহনের নীতিমালা মানা হয় না বলেই তাঁদের এই আশঙ্কা।
হাজার টনের ওপর কয়লা থেকে সালফার নদীর পানিতে মিশে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি করতে পারে বলে তাঁরা মনে করছেন।
তবে বন বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, এর আগে যে দুটি দুর্ঘটনায় কয়লাসহ জাহাজ ডুবে গিয়েছিল, সে দুর্ঘটনাগুলোর পর মালিকপক্ষ কয়লা তুলে নিয়ে গেছে। কয়লার মান ভালো হওয়ায় সুন্দরবনকে ক্ষতির মুখে পড়তে হয়নি। তাঁরা নদীর পানি পরীক্ষা করে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন।
তবে কয়লা নিম্নমানের হলে সালফার ও অন্যান্য রাসায়নিক দ্রুত পানিতে মিশে যায়। সে ক্ষেত্রে সংরক্ষিত বনভূমি থেকে বেশ কিছুটা দূরে ঘটনাস্থল হলেও আশঙ্কা থেকে যায় বলে মনে করছেন বন বিভাগের কর্মকর্তারা। তাঁরা নমুনা হাতে পাওয়ার পর এ ব্যাপারে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া দেবেন বলে জানান।
সুন্দরবন রক্ষায় হরতাল
দেশের পরিবেশবাদীরা নানা ঘটনায় সুন্দরবন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছে। সুন্দরবন রক্ষায় আগামী ২৬ জানুয়ারি অর্ধদিবস হরতালের সমর্থনে গতকাল শুক্রবার ঢাকায় পদযাত্রা সমাবেশ ও প্রচারপত্র বিতরণ করেছে তেল–গ্যাস–খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ–বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি। গতকাল বিকেলে রাজধানীর প্রেসক্লাব, মিরপুর, মোহাম্মদপুর ও ধানমন্ডিতে সমাবেশ ও পদযাত্রা করে প্রচারপত্র বিলি করা হয়।
সমাবেশ থেকে নিজ নিজ গাড়ি, কাজ ও প্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখে সর্বাত্মক অর্ধদিবস হরতাল পালন করার আহ্বান জানানো হয়। সমাবেশ থেকে বলা হয়, রামপাল–ওরিয়ন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পসহ শতাধিক বাণিজ্যিক বনগ্রাসী–ভূমি গ্রাসী প্রকল্প ঘিরে ফেলেছে বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনকে। প্রকল্পে প্রতিবছর ৪৭ লাখ টন কয়লা পোড়ানো হবে। এর ফলে তৈরি হবে আট লাখ টন ছাইসহ বিষাক্ত দ্রব্য। যার কারণে প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটানোর পাশাপাশি ওই অঞ্চলের লাখ লাখ মানুষ তাঁদের জীবিকা হারাবে।
রামপাল প্রকল্পসহ সুন্দরবন বিনাশী সকল প্রকল্প বাতিল ও বিদ্যুৎ–গ্যাস সমস্যা সমাধানে সাত দফা চুক্তি বাস্তবায়নের দাবিতে তেল–গ্যাস–খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ–বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি আগামী ২৬ জানুয়ারি সকাল ছয়টা থেকে বেলা দুইটা পর্যন্ত অর্ধদিবস হরতাল ডেকেছে।